বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ৬০ নেতাকর্মী

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) নবনিযুক্ত মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর
আহমেদ বলেছেন, একটি বিশেষ মহল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এনে সেটিকে ‘সস্তা প্রচার’ হিসেবে
কাজে লাগাচ্ছে। তিনি বলেছেন, অপরাধ দমন করতেই সরকার আইনশৃঙ্খলা
বাহিনীর হাতে অস্ত্র দিয়েছে, ‘হা-ডু-ডু খেলার’ জন্য নয়
অবরোধ কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২০ দলীয় জোটের ৬০ নেতাকর্মী ও সমর্থক। এ সময় সরকার সমর্থকদের হামলায় নিহত হন আরও অন্তত ১৫ জন। এ সময় গুম হয়েছেন ২১ জন। সরকারদলীয় বেশ কয়েকজন কর্মী-সমর্থকও দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ছিল- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হওয়ার পর কথিত ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গণপিটুনি ও গাড়িচাপায় মৃত্যু। এর মধ্যে ৫ই জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে পুটিয়ায় বিএনপিকর্মী মজিরউদ্দিন, কানসাটে বিএনপিকর্মী জামশেদ আলী, নোয়াখালীতে যুবদলকর্মী মিজানুর রহমান রুবেল নিহত হন। ৭ই জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে সেনবাগে ছাত্রদলকর্মী মহিউদ্দিন বাবুর্চি নিহত হন। ১৫ই জানুয়াারি র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে কানসাটে ছাত্রদল নেতা মতিউর রহমান নিহত হন। ১৯শে জানুয়ারি মতিঝিলে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নড়াইল পৌরসভার কাউন্সিলর ইমরুল কায়েস নিহত হন। ২০শে জানুয়ারি আইনশৃঙ্খলাবাহিনী আটকের পর রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় মৃত্যু হয় যুবদলের ওয়ার্ড সভাপতি এসলাম হোসেনের। ডিবি পুলিশ গ্রেপ্তারের পর একই দিন ঢাকার খিলগাঁওয়ে ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনির লাশ পাওয়া যায়। ২৩শে জানুয়ারি র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে লক্ষ্মীপুরে মারা যান দাউদকান্দির ছাত্রদল নেতা সোলায়মান উদ্দিন জিসান। এক মাস নিখোঁজ থাকার পর ২৬শে জানুয়ারি রামপুরায় র‌্যাবের গুলিতে মারা যান আবুল কালাম আজাদ ও  রাজমিস্ত্রি সুলতান বিশ্বাস নামে দুই বিএনপি কর্মী। ২৭শে জানুয়ারি সিটি কলেজ শিবির সভাপতি আসাদুল্লাহ তুহিনকে ট্রাকচাপায় হত্যা করা হয়। পরিবার জানায়, আগের দিন তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। গোয়েন্দাদের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ২৮শে জানুয়ারি নিহত হন রাজশাহীর কলেজ শিক্ষক নুরুল ইসলাম। আগের দিন গ্রেপ্তারের পর ২৯শে জানুয়ারি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন বিএনপিকর্মী রফিকুল ইসলাম। একই দিন পুলিশেল নির্যাতনে রাজশাহীর বিএনপি নেতা আইনুর রহমান মুক্তা, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার শিবিরকর্মী সাকিব হাসান হাসপাতালে মারা যান। গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেপ্তারের পর এদিনই চরফ্যাশনের ছাত্রদল নেতা আরিফুল ইসলাম মুকুলের মরদেহ পাওয়া যায় ঢাকার রূপনগরে। ৩০শে জানুয়ারি মিরপুরের বেড়িবাঁধে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন শিবিরকর্মী এমদাদ উল্লাহ। ২রা ফেব্রুয়ারি উল্লাপাড়ায় পুলিশ হেফাজতে মারা যান ২০ দল নেতা সাঈদুল ইসলাম। ৩রা ফেব্রুয়ারি কথিত বন্দুকযুদ্ধে ২ যুবদল কর্মী যশোরের মণিরামপুরের ইউসুফ মিয়া ও একই এলাকার লিটন আলীকে নিরাপত্তা বাহিনী তুলে নেয়ার পর ট্রাকচাপায় হত্যা করা হয়। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকার ফার্মগেটে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান মোটরপার্টস বিক্রেতা ও বিএনপি সমর্থক সাখাওয়াত হোসেন ও কাওরান বাজারের সবজি বিক্রেতা মুজাহিদুল ইসলাম জিহাদ। এ ছাড়া এদিন ভাষানটেক বালুর মাঠে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে বিএনপি সমর্থক আল-আমিন মারা যান। একই দিন একই স্থানে লাশ পাওয়া যায় বিএনপি সমর্থক গাজী মোহাম্মদ নাহিদের। ৫ই ফেব্রুয়ারি মিরপুরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বুন্দুকযুদ্ধে মারা যান বিএনপি সমর্থক মনির হোসেন। ৬ই ফেব্রুয়ারি পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে চৌদ্দগ্রামে শিবির নেতা শাহাবুদ্দিন পাটোয়ারী, সাতক্ষীরার শিবিরকর্মী শহিদুল ইসলাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শাহাবুদ্দিন রিপন মারা যান। ৭ই ফেব্রুয়ারি পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান মো. বাচ্চু। ৮ই ফেব্রুয়ারি পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে শিবিরকর্মী জসীম উদ্দিন আগারগাঁও তালতলায় ও কুমিল্লায় পুলিশি হেফাজতে মারা যান বিএনপি সমর্থক স্বপন। যশোরে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান বিএনপি সমর্থক রাজু আহম্মেদ। ৯ই ফেব্রুয়ারি নিহত হন বিএনপির ৩ নেতাকর্মী। যাত্রাবাড়ীতে ডিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মোবাইল সার্ভিসিং কর্মী বিএনপি সমর্থক রাসেল সরদার মারা যান। একইদিন চৌদ্দগ্রামের বিএনপি নেতা সোহেল মিয়া ও মিরপুরের কালশীতে এক বিএনপি সমর্থকের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। ১৩ই ফেব্রুয়ারি যাত্রাবাড়ী যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলমের লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরে। পরিবার জানায়, ৮ই ফেব্রুয়ারি তাকে ডিবি বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ১৪ই ফেব্রুয়ারি বরগুনার আমতলীতে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় বিএনপি কর্মী মোজাম্মেল। একই দিন চট্টগ্রামে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান যুবদল নেতা আরিফ হোসেন। এ সময় তিনি তার সন্তনসম্ভবা স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে গিয়েছিলেন। ১৫ই ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মাগুরার শালিখা থানার ছয়ঘরিয়ার ওয়ার্ড নেতা মশিউর রহমান ও ময়মনসিংহের বিএনপি সমর্থক লিটন মিয়া নিহত হন। দিনাজপুরে বিজিবি পুলিশের যৌথ অভিযানে মারা যান স্থানীয় শিবির নেতা মতিয়ার রহমান। ১৬ই ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জে বিএনপি সমর্থক মো. ইয়াছিনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। পরিবার দাবি করে আগেই তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। ১৭ই ফেব্রুয়ারি গাইবান্ধা শহরের শিবির নেতা মোস্তফা মঞ্জিল র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। আগের দিন পুলিশ গ্রেপ্তারের পর ১৮ই ফেব্রুয়ারি যশোরের মণিরামপুরে ডুমুরিয়ার বিএনপিকর্মী আবু সাঈদ ও বজলুর রহমান কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। এদিন টেকনাফে বিজিবির গুলিতে নিহত হন বিএনপির সক্রিয় কর্মী হোসেন আহমেদ।  ১৯শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে মারা যান ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বিএনপি সমর্থক রফিকুল ইসলাম খোকন। ২১শে ফেব্রুয়ারি বরিশালের আগৈলঝড়ায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান যুবদল নেতা কবির হোসেন মোল্লা ও ছাত্রদল নেতা টিপু হাওলাদার। ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করার পর বরিশালে তাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। ২২শে ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন শ্রমিক দল নেতা আবদুল ওদুদ। একই থানা এলাকা থেকে আরও তিনজনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে সুমন ও রবিনের পরিচয় মিলেছে। একজনের লাশ এখনও মর্গে পড়ে আছে। ওই দিন ঝিনাইদহে গুলিতে নিহত হন এক বিএনপি নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলের ছেলে পলাশ এবং বিএনপিকর্মী দুলাল। পরিবার বলছে, দুই দিন আগে তাদের আটক করা হয়েছিল। ২৪শে ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে ক্রসফায়ারে নিহত হন যুবক শাহীন। পুলিশ বলছে, শাহীনের নেতৃত্বে পুলিশের ওপর হামলার পর সেখানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শাহীন নিহত হন। একই দিন মাগুরায় নিহত হয়েছেন টাইগার দাউদ। ২৬শে ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন তিন জন। এদের মধ্যে সাদ্দাম ও সোহেলের পরিচয় পাওয়া গেছে। র‌্যাবের দাবি তারা বনদস্যু। অন্যদিকে সরকার সমর্থকদের হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন- ৫ই জানুয়ারি নাটোরে গুলিতে ছাত্রদল নেতা রকিব মুন্সী ও রায়হান হোসেন, ১৪ই জানুয়ারি চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় ট্রাকের চাকায় শিবিরকর্মী জুবায়ের, ১৫ই জানুয়ারি সোনাইমুড়িতে ছাত্রদল নেতা মোরশেদ আলম পারভেজ, ১৮ই জানুয়ারি বিএনপি নেতা সিরাজুল ইসলাম, ২১শে জানুয়ারি রাঙ্গুনিয়ায় বিএনপি সমর্থক জিল্লুর রহমানকে গুলি করে হত্যা করে সরকার সমর্থকরা। ২২শে জানুয়ারি লালবাগে বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে সন্দেহজনক বোমা হামলায় নিহত হন ছাত্রদল নেতা মাহবুবুর রহমান। ২৭শে জানুয়ারি চরফ্যাশনে ছাত্রদল নেতা হারুনুর রশিদ, ৩০শে জানুয়ারি সীতাকুণ্ডে যুবদল নেতা ইমাম হোসেন, যশোরের চৌগাছার বিএনপিকর্মী আবদুস সামাদ মোল্লা, ৪ঠা ফেব্রুয়ারি খুলনা বিএল কলেজের ছাত্রদলকর্মী শেখ আবু সাঈদকে শ্বাসরোধ করে, ৬ই ফেব্রুয়ারি বেগমগঞ্জের যুবদল নেতা সোহেলকে গুলি করে, রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ছুরিকাঘাতে জামায়াত নেতার মেয়ে, ৮ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলাম তালুকদার এবং ১৯শে ফেব্রুয়ারি লক্ষ্মীপুর সদরে যুবদল নেতা মাঈনুদ্দিন বাবলুকে গুলি করে হত্যা করে সরকার সমর্থকরা। তবে সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ (বিএসপিপি) দাবি করে, চলমান অবরোধের ৫৭ দিনে বিচারবহির্ভূত ও সরকারি দল সমর্থকদের হাতে সারা দেশে ১১৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

No comments

Powered by Blogger.