সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য -১৬৭ by ড. একেএম শাহনাওয়াজ

মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইনের কতগুলো বৈশিষ্ট্য ছিল। যেমন- ১. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা গঠন। কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হয় ১৬-৬০। এর মধ্যে অনধিক ২৮ জনকে সরকার মনোনীত করতে পারবে, ২. গভর্নর জেনারেলের নির্বাহী পরিষদে (ক) পদাধিকার বলে সদস্য, (খ) মনোনীত সরকারি সদস্য, (গ) মনোনীত বেসরকারি সদস্য, (ঘ) নির্বাচিত সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার বিধান রাখা হয়, ৩. এই সংস্কারে আইনে পরিষদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়, ৪. মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা স্বীকৃত হয় এবং ৫. এ আইনে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ ভারতে প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার ধারণা স্বীকৃত হয়। আইনের ফলে মুসলমানদের দাবি অনেকাংশ স্বীকৃত হলে মুসলমান নেতৃবৃন্দ সন্তুষ্ট হন। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের মনে হতাশা সৃষ্টি হয়। ফলে এ আইন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কিছুটা ব্যবধানও গড়ে তুলেছিল।
বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১) : কংগ্রেস ও বাঙালি হিন্দুদের বিরোধিতা এবং সন্ত্রাসবাদীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে অবশেষে বঙ্গভঙ্গ প্রসঙ্গে নতুনভাবে ভাবতে হয় ইংরেজ শাসকদের। লর্ড হার্ডিঞ্জ বড়লাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট গোপনীয়ভাবে ভারত সরকারকে প্রকৃত অবস্থা জানিয়ে প্রশাসনিক পরিবর্তনের সুপারিশ করেন। এক্ষেত্রে নতুন একটি পরিকল্পনাও করা হয়। পরিকল্পনা অনুসারে প্রেসিডেন্সি, বর্ধমান, ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে পাঁচটি বাংলা ভাষাভাষী বিভাগ নিয়ে বাংলা প্রদেশ গঠনের সুপারিশ করা হয়। নতুন বাংলা প্রদেশের রাজধানী করা হয় কলকাতাকে।
১৯১১ সালের ডিসেম্বরে রাজা পঞ্চম জর্জ দিল্লিতে তার রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করে উপরে উল্লিখিত প্রস্তাব পেশ করেন। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল দুই বাংলা আবার একত্রিত হবে। বঙ্গভঙ্গ রদ করে গৃহীত নতুন ব্যবস্থাটি ১৯১২ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমানদের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারা একে সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যা দেন। পাশাপাশি বর্ণ হিন্দু ও কংগ্রেস নেতারা বিজয়োল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন। প্রচণ্ড কষ্ট ও হতাশায় নবাব সলিমুল্লাহ রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শান্ত করার জন্য আশ্বাস দেন, ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনার জন্য একটি সংস্থাও গঠন করা হয়। বাংলার অনেক হিন্দু এ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের নিপীড়িত বাংলার মুসলমানরা যেভাবে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল, ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা ঠিক সেভাবেই তাদের হতাশার অন্ধকারে টেনে নেয়। মুসলমানদের মধ্যে ইংরেজ ও কংগ্রেসবিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। ফলে হিন্দু-মুসলমান দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই কিছুটা দূরত্ব বেড়ে যায়। এ অবস্থায় হিন্দু ও মুসলমান নেতৃবর্গ খুব স্বস্তিতে ছিলেন না। তারা অনুভব করেন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার দূরত্ব ইংরেজ সরকারকে লাভবান করবে। এ কারণে উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবর্গ এ সময়ের রাজনীতিতে নতুন কিছু পদক্ষেপ নেয়ার চিন্তা করেন। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা স্থাপনের জন্য ১৯১৬ সালে লক্ষ্মৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর পরে সে সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন এদেশীয়দের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী ঐক্য গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। এভাবে এক পর্যায়ে শুরু হয় ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন। হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা সামনে রেখে ১৯২৩ সালে স্বাক্ষরিত হয় বেঙ্গল প্যাক্ট। বঙ্গভঙ্গের পরবর্তী সময়ের এই রাজনীতি ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত একই ধারা বজায় রাখে। পরে আবার রাজনীতিতে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়।

No comments

Powered by Blogger.