দগ্ধ শ্রমিকদের পরিবারে হাহাকার by রুদ্র মিজান

কান্না থামছে না ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। দগ্ধ অসহায় মানুষগুলো লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে। গ্রাম থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছেন স্বজনদের অনেকেই। প্রিয়জনদের বীভৎস চেহারা দেখে কান্না ধরে রাখতে পারছেন না তারা। মাগুরায় পেট্রলবোমায় দগ্ধ ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছয়জনের মধ্যে পাঁচ জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
দগ্ধদের দেখার জন্য গতকাল মাগুরা থেকে ছুটে এসেছেন ফয়সাল আলম ও ইশারত হোসেন নামের দুই যুবক। তারা জানান, এ ঘটনায় মালিগ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নিম্নবিত্ত মানুষের বাসিন্দাদের ওই গ্রামে এর আগে কখনও এরকম ঘটনা ঘটেনি। কোন সহিংসতায় একসঙ্গে তিন জনের মৃত্যু ঘটেনি ওই গ্রামে। আগুনে দগ্ধ হয়নি এত লোক। ভয়াবহ এ ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে পুরো গ্রামে। মালিগ্রামের প্রায় সবাই শ্রমিক। কেউ পরিবহন শ্রমিক, কেউ দিনমজুর। এ ঘটনার পর গ্রামের অনেকেই কাজে বের হতে সাহস পাচ্ছেন না। এমনকি ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্বজনদের দেখার জন্যও বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না কেউ কেউ। আবার সাহস পেলেও টাকার অভাবে ঢাকামুখী হতে পারছেন না হতদরিদ্র স্বজনদের অনেকে। ফয়সাল আলম বলেন, গ্রামের প্রায় সবাই দিন আনে দিন খায়। এসব হতদরিদ্র মানুষগুলোর এখন কি হবে, যাদের স্বজন মারা গেছে তাদের পথে বসা ছাড়া উপায়  নেই। দগ্ধদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করাও হতদরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে সম্ভব না বলে জানান তিনি।
অগ্নিদগ্ধ ইয়াদুল মোল্লা সম্পর্কে তার স্বজনরা জানান, ২৪ বছর বয়সী ইয়াদুলের ওপর নির্ভরশীল মা ও পাঁচ বোনসহ ছয় জনের পরিবার। প্রায় ১০ বছর আগে তার পিতা জহুর আলী মারা যান। তখন সাত বোন ও মায়ের জন্য কিশোর ইয়াদুল শ্রমিকের কাজ বেছে নেন। কখনও পরিবহন শ্রমিক, কখনও দিনমজুর। দুই বোনের বিয়ের পর পাঁচ বোন ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে সুখেই ছিল তাদের সংসার। সমপ্রতি ইয়াদুলের মা লিভারজনিত রোগে আক্রান্ত হন। মায়ের ওষুধ কেনার জন্য আগের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতেন তিনি। সেই ইয়াদুল এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। পুত্রের দগ্ধ হওয়ার খবর জেনে বাড়িতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তার বৃদ্ধা মা। গতকাল ইয়াদুলের পাশে বসে সেবা করছিলেন তার বড় বোন লাভলী বেগম। লাভলী জানান, ইয়াদুল তার ছোট। কিন্তু বড় ভাইয়ের মতোই পরিবারের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। তার কিছু হলে এই পরিবারকে দেখার মতো আর কেউ থাকবে না। লাভলীর স্বামী ট্রাকচালক ইমরানের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। লাভলী বলেন, আমার ভাই, স্বামী কারও অবস্থাই ভাল না। আমাদের মতো গরিবের ওপর এ অত্যাচার কেন, কি দোষ আমাদের। এখন এদের কিছু হলে দুটি পরিবারের কি হবে, কে দেখবে আমাদের।
একই ঘটনায় দগ্ধ ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাজমুল মোল্লাকে দেখতে ছুটে এসেছেন তার পিতা শরীফুল মোল্লা। নাজমুল দগ্ধ হয়েছেন খবর পেয়ে বাড়িতে কান্নাকাটি করছেন তার মা ও স্ত্রী। নাজমুল জানান, মা-বাবার দুই সন্তানের মধ্যে একমাত্র পুত্র তিনি। তিনি দগ্ধ হয়েছেন খবর পেয়ে মা অজ্ঞান হয়ে যান। তাৎক্ষণিকভাবে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তিনি। ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে নাজমুল জানান, ঘটনার মাত্র ১০ মিনিট আগে বাড়িতে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন তিনি। মাকে বলেছিলেন, বাড়িতে আসতেছি। রান্না করে রাখো। পেটে ক্ষুধা লাগছে। মা জানিয়েছিলেন, আলু ভর্তা ও ডাল রান্না করছেন তিনি। কিন্তু মায়ের হাতে তৈরি আলু ভর্তা জুটেনি নাজমুলের ভাগ্যে। নাজমুল জানান, গত শনিবার শালিখার আড়পাড়া এলাকায় বালু নামিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ির উদ্দেশে ফিরছিলেন তারা। ট্রাকের কেবিনে ও চালকের আসনে বসে কথা বলছিলেন আগামীকালের কাজ নিয়ে। এ কথা বলার মধ্যেই পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। যশোর রোডের মঘির ঢাল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তারা আগুনে পুড়ে দগ্ধ হন। ওই এলাকায় কেউ পেট্রলবোমা ছুড়ে মারবে তা কল্পনাও করতে পারেননি তারা। নাজমুল বলেন, যাদের সঙ্গে কাজ করি। হাসি-তামাশা করি তারা লাশ হয়ে গেলো। গরিবের লাশ না পেলে বুঝি ক্ষমতায় টিকে থাকা যায় না। লাশ না হলে ক্ষমতায় যাওয়া যায় না। আমাদের জীবনের কোন মূল্য নাই ভাই। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন  তিনি। ঘটনার সময় ট্রাকে ছিলেন ৯ জন। তাদের মধ্যে নিহত হয়েছেন, শাকিল মোল্লা ও একই পরিবারের রওশন আলী বিশ্বাস এবং তার ভাইপো মতিন বিশ্বাস। দগ্ধ অবস্থায় ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি রয়েছেন, আরব আলী, নাজমুল মোল্লা, ইমরান মোল্লা, ইলিয়াস বিশ্বাস, ফারুক ও ইয়াদুল।
এদিকে, গতকাল বেলা পৌনে ৩টার দিকে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা গেছেন এনজিও কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। গত ১৫ই মার্চ সন্ধ্যা ৭টার দিকে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লার পঞ্চবটিতে সোসাইটি ফর সোশ্যাল সার্ভিস (এসএসএস) নামে এনজিও কার্যালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দগ্ধ হন তিনি। আগুনে তার শরীরের ৫০ শতাংশ পুড়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.