চাঁপাই নবাবগঞ্জে রাত নামলেই আতঙ্ক by মোহাম্মদ তারেক রহমান

দিনের বেলায় পরিস্থিতি অতটা ভীতিকর নয়। অস্বস্তি থাকলেও চলাফেরা করে মানুষ। কিন্তু সূর্য ডুবতেই বদলে যায় সব। চাঁপাই নবাবগঞ্জ পরিণত হয় এক আতঙ্কের জনপদে, যৌথবাহিনীর অভিযান আর দুর্বৃত্তদের হামলা ভয় দুদিক থেকেই। গেল তিন মাসে চাঁপাই নবাবগঞ্জে শুধু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বিএনপি, ছাত্রশিবির ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৯ জন। বিভিন্ন ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিকের চেয়েও বেশি ব্যক্তি। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে পণ্যবোঝাই ও খালি ৩০টিরও অধিক ট্রাক। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ২০টিরও বেশি। বিএনপি-জামায়াতের দাবি, গেল তিন মাসে যৌথবাহিনীর অভিযানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে প্রায় ২৩৯টি বাড়িঘরে। আসামি করা হয়েছে এজাহার নামীয়সহ অজ্ঞাতনামা ১০-১৫ হাজার মানুষকে। প্রশাসন প্রতিদিন পরিচালনা করছে যৌথবাহিনীর অভিযান। তাতে আটকও হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীসহ অনেকে। বিএনপি-জামায়াতের দাবি, যৌথবাহিনীর অভিযানের নামে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে ঢুকে ভাঙচুর করা হচ্ছে বাড়ির মূল্যবান আসবাব, লুট করা হচ্ছে স্বর্ণালঙ্কারসহ টাকাপয়সা। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বিছানাপত্রসহ মূল্যবান সামগ্রী। আর যৌথবাহিনীর সঙ্গে যোগ দিচ্ছে মুখোশধারী অচেনা মুখ। তারাই শনাক্ত করে দিচ্ছে কোন বাড়িতে হামলা হবে।
যৌথবাহিনীর অভিযানে ৫ই জানুয়ারি নিহত হয় শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট এলাকার বিএনপি কর্মী জমশেদ আলী। ওই ঘটনায় গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় আরও অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। গত ৯ই জানুয়ারি রাতে কানসাট বিয়েনবাজার এলাকায় যুবলীগকর্মী মুকুলকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ১৫ই জানুয়ারি দুপুরে শিবগঞ্জ পৌর এলাকার মহদিপুরের একটি আমবাগানে পিটিয়ে আহত করা হয় স্কুল ছাত্র ও ৬ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনের ছেলে রাজন আলী রকিকে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজশাহী মেডিক্যালে ১৬ই জানুয়ারি রাতে মারা যায় সে। এছাড়া ১৫ই জানুয়ারি শ্যামপুর নারী কল্যাণ স্কুলের কাছে যৌথবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি মতিউর রহমান। ওইদিন দিবাগত রাতে খড়কপুর এলাকায় র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধে মারা যান তিনি। ২৭শে জানুয়ারি দুপুরে যৌথবাহিনীর হাতে আটকের পর রাতে ঘোড়াস্ট্যান্ড এলাকায় ট্রাক চাপায় নিহত হন আসাদুল্লাহ তুহিন নামে এক ছাত্রশিবির নেতা। ২০শে ফেব্রুয়ারি বিকালে উপজেলার শাহবাজপুর ইউনিয়নের ধোবড়া এলাকায় আওয়ামী লীগকর্মী আবুল কালাম আজাদকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ৩রা মার্চ ভোরে চাঁপাই নবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ মহাসড়কের কানসাট বাঁশপট্টি এলাকায় দুর্বৃত্তদের পেট্রলবোমা হামলায় আগুনে পুড়ে মারা যায় শিপন নামে এক ট্রাক চালক। ওই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে গুরুত্বর আহত হন ট্রাক চালকের সহকারী। ৬ই মার্চ রাতে গোমস্তাপুরে ট্রাকে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রলবোমা হামলায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান শিবগঞ্জ পৌর এলাকার জালমাছমারী গ্রামের সেলিম রেজা। সর্বশেষ গেল ১২ই মার্চ সকাল ১১টার দিকে চাঁপাই নবাবগঞ্জ পৌর এলাকার ফুলকুঁড়ি ইসলামী একাডেমির সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় চাঁপাই নবাবগঞ্জ সিটি কলেজের ছাত্র ও ছাত্রশিবির কর্মী আরিফুল ইসলামকে।
শিবগঞ্জ উপজেলায় একের পর এক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, হাত-পায়ের রগ কাটাসহ বাড়িঘর, যানবাহন ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও আহতের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে এই এলাকার কোন মানুষই স্বস্তিতে নেই। রোববার ও সোমবার টানা দুদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিবগঞ্জ বাজার, কানসাট বাজার, ধোবড়া বাজার, শ্যামপুর বাজারে দিনের বেলায় সাধারণ লোকজন চলাচল করলেও রাত ৮টার পরে জনশূন্য হয়ে পড়ে ওইসব এলাকা। সন্ধ্যা নামলেই ওইসব এলাকাতে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে বোমাবাজির ঘটনা। আর  যৌথবাহিনী চালাচ্ছে সাঁড়াশি অভিযান। অভিযানে সাধারণ মানুষসহ আটক হচ্ছে অনেকেই। সেই কারণে রাতের বেলা চলাচল করতে সাহস পাচ্ছেন না এখানকার জনগণ। বলা যায় ওইসব এলাকা রাতের বেলায় পুরো নিয়ন্ত্রণে চলে যায় প্রশাসনের। চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি অধ্যাপক শাহজাহান মিঞা মানবজমিনকে বলেন, বর্তমান সরকার সন্ত্রাস দমনের নামে দলীয় কাডারদের দিয়ে মানুষের যানমালের ক্ষতি করছে। বাড়িঘরে ভাঙচুরসহ আটক করা হচ্ছে বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীকে। তিনি অবিলম্বে এসব কর্মকাণ্ড বন্ধের জোর দাবি জানান। অন্যথায় এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি দেন। এদিকে শিবগঞ্জ পৌর জামায়াতের আমির গোলাম আযম মানবজমিনকে বলেন, গত ১৫ই জানুয়ারির পর থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের প্রায় ২৩৯টি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে যৌথবাহিনী। কয়েকটি বাড়িতে দুই থেকে তিনবারও ভাঙচুর করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে আটক করা হয়েছে কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে। তিনি প্রশাসনকে এসব ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধ করে সাধারণ মানুষসহ দলীয় নেতাকর্মীদের হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানান। এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ এমএম ময়নুল ইসলাম জানান, পুলিশ আসামি ধরার নামে কারও বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত নয়।

No comments

Powered by Blogger.