বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের দায় কার? by অধ্যাপক ড. মো: শামছুল আলম

এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। ‘আমাদের’ বললাম এ জন্য, এ দেশটি কারো একার নয়, আমাদের সবার। বর্তমান সরকারের আচরণ এবং স্বভাবগত দৃশ্য দেখে যদিও মনে হচ্ছে শাসক দল আওয়ামী লীগ এ দেশের মালিক বনে গেছে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের দেয়া একটি ‘দায়িত্ব’। এখানে শাসক শব্দটি পরিহারযোগ্য। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ‘জনসাধারণ’ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়, তারা জোরপূর্বক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জনসাধারণকে শাসন করছে। এমন অভিযোগ অসার নয় যে, গুম, খুন, হামলা, মামলা, নিপীড়ন ও নির্যাতন করে যেকোনোভাবেই হোক আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতেই হবে। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রায় ভোটারবিহীন ‘সিলেক্টিভ নির্বাচনে’ জয়লাভ করে আবার সরকার গঠন করে বলেছিলেন ‘সংবিধান ও নিয়ম রক্ষার জন্য এ নির্বাচন অপরিহার্য ছিল’। অর্থাৎ সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থেকে এ নির্বাচন আয়োজনের বিকল্প ছিল না। নির্বাচনোত্তর সার্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, বিএনপির সাথে শিগগিরই আলাপ-আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নেবো এবং সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ নির্বাচনের ব্যবস্থা করব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচন-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেশের প্রায় সব টেলিভিশন চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করায় দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করেছেন। গণমাধ্যমের সূত্রে সংযোগের মাধ্যমে যখন দেশবাসীর সামনে কেউ কোনো কথা বলেন বা অঙ্গীকার করেন, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। দেশবাসীও তা বিশ্বাস করতে চায়। নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ এবং সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করে। সে সময়ে বিএনপি শুধু নির্বাচন বর্জন নয়, নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে হরতাল, অবরোধসহ নানামুখী আন্দোলন করে। আমরা লক্ষ করেছি, বিএনপির পক্ষে শুধু নির্বাচন বর্জনই সম্ভব হয়েছে; নির্বাচন প্রতিহত করা আর সম্ভব হয়নি। মোট আসনের অর্ধেকেরও বেশি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং অবশিষ্ট আসনে প্রায় ভোটারবিহীন নির্বাচনে সিলেক্টিভ প্রার্থীরা বিজয় লাভ করেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরকারের যেকোনো সিদ্ধান্তের বিপরীতে সেটা হোক জনমত কিংবা গণবিরোধী কোনো কার্যসূচি, বিরোধী দল প্রতিহত করতে পারে না। সরকার এ ক্ষেত্রে এসব দেশের সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় পেশিশক্তি ব্যবহার করে বিরোধী দলের আন্দোলন কর্মসূচি নস্যাৎ করে দেয়। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে এমনটি লক্ষ করা যায় না, সেখানে প্রতিবাদ কিংবা সমালোচনা শুরু হলে সরকার তা বিবেচনায় নিয়ে তদনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়। বলতে দ্বিধা নেই, আমরা এ সংস্কৃতির ধারেকাছেও পৌঁছতে পারিনি। আবার শিগগির যে আমরা এ সংস্কৃতির ধারেকাছে পৌঁছে যাবো, এমন আশাও করি না। সেটা যে দলই সরকার গঠন করুন না কেন, কোনো দলের ভেতরই এমন সংস্কৃতির অনুশীলন নেই।
আমরা ধারণা করি, দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির অংশ নেয়া ছাড়া নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে খোদ শেখ হাসিনার মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। নিশ্চয়ই এ ধারণা থেকে তিনি নির্বাচনোত্তর সংবাদ সম্মেলনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা এবং দ্রুত আরেকটি নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন কথার ভিত্তিতে দেশবাসীর মতো বিএনপিও আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী তাদের চলমান হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি স্থগিত করে। শুধু তাই নয়, বিএনপি এখানে আরো আন্তরিকপূর্ণ আচরণ করে। তারা উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নেয়। দেশব্যাপী শান্তি ও স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরে আসে। তবে এ সরকারের অধীনে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার অভিজ্ঞতাটি বিএনপির জন্য সুখকর হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে নির্বাচন যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না, উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বিএনপি সেই অভিজ্ঞতা লাভ করে। প্রথম দুই দফায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা নিরঙ্কুশ জয়লাভ করলে পরবর্তী সময়ে সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থীরা বিএনপি অনুসারী ভোটারদের কেন্দ্রেই যেতে দেয়নি। এ পর্যায়ে একতরফা নির্বাচন হয় এবং এতে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা জয়লাভ করে। সরকার এবং সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থীদের এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পরও বিএনপি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বিএনপি অপেক্ষায় থেকেছে শাসক দল আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুত দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচন, যা একাদশ সংসদ নির্বাচন হিসেবে গণ্য হবে। কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে সাথে আমরা লক্ষ করলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা বেমালুম ভুলে গেলেন কিংবা এ মধ্যবর্তী নির্বাচন দেয়ার মনোভাব থেকে সরে গিয়ে বর্তমান সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের ‘সাংবিধানিক সময়’ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে চাইছেন।
সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই পারে দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে না এলে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হতো না। বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা সরকার কার্যত দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন থেকে সরে যাওয়াতে যে সৃষ্টি হয়েছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারকে সংলাপ শুরুর আহ্বান জানাচ্ছে। এ আহ্বান জানাচ্ছে দেশী-বিদেশী কূটনীতিকেরাও। কিন্তু সরকার সংলাপের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি মানতেই চাইছে না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পেট্রলবোমা মেরে যারা মানুষ পুড়িয়ে দেয়, হত্যা করে তাদের সাথে কিসের সংলাপ? আমরা সরকারের এ অভিমতটি বিবেচনায় নিতে চাই। পেট্রলবোমা কারা মারছে, খুঁজে বের করে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। ক্রসফায়ারের নামে সরকারের পাল্টা ব্যবস্থা যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, সে অভিযোগ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এখানে আরো যা বলা প্রয়োজন, তা হলো গত ৬ জানুয়ারি থেকে দেশব্যাপী এ রাজনৈতিক অনাচার শুরু হয়েছে। এর আগে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ। সরকার তখন একাদশ নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে বিএনপি এবং অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপের উদ্যোগ নেয়নি। ‘মানুষ সুখে থাকলে প্রতিবেশীরও খবর রাখে না’- আওয়ামী লীগ সরকার তা আবারো প্রমাণ করেছে। আবার মানুষমাত্রই আরাম আয়েশপ্রিয়। সুখের তরীতে যে ভেসে চলে, বাধা তার ভালো লাগে না। সরকারের মন্ত্রিপরিষদে সুখের তরীর সদস্যরা আনন্দ যাত্রায় গা ভাসিয়ে বলতে থাকলেন, কিসের সংলাপ, কিসের একাদশ সংসদ নির্বাচন? বিএনপির ট্রেন মিস করার দায় সরকার কেন নেবে? সংলাপ হবে ২০১৯ সালের নির্বাচনের পূর্বক্ষণে। সত্য হলো সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল এ সঙ্ঘবদ্ধ দলের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুর মেলানোর ফলে বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে। আবার সরকার জানে যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নির্বিঘেœ তাদের পক্ষে কুক্ষিগত করে রাখা খুব সহজ হবে না। বিএনপি সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের সমান বড় রাজনৈতিক দল। বিগত নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটই এর প্রমাণ মেলে। সরকার এ কারণে বিএনপির নেতাকর্মীদের নিষ্ক্রিয় করতে গুম, খুন, হামলা ও মামলার মধ্যে ফেলে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে দমন-পীড়নের সরকারের এ কৌশলে বিএনপি তার স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনায় বাধা পেয়েছে। রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ, অবরোধ এমনকি গণ-অনশনের মতো নিরীহ ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনেও সরকার বাধা দিয়েছে। এতদসত্ত্বেও বিএনপি ধৈর্য ধরেছে, দ্রুত একাদশ নির্বাচনের জন্য। প্রতি উত্তরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ক্ষমতার দম্ভে সংলাপ ও নির্বাচনবিরোধী মনোভাব প্রদর্শন করেছে। এখন ঘটনার ক্রম ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ‘সঙ্ঘাতপূর্ণ’ হয়ে উঠেছে। এর দায়ভার ষোলো আনাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ওপর বর্তায়। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করা হবে দেশকে ধ্বংস করার শামিল। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে জননিরাপত্তা চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে। বিদ্যমান এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাসীও তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে সরকার ও বিএনপির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। বিএনপি এ আহ্বানে সাড়া দিয়েছে, অথচ জনগণের জানমাল রক্ষায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকার কারো কোনো কথায় কর্ণপাত করছে না। এতে যেমন রাজনীতিকদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক মানসিকতার পরিচয় ফুটে উঠছে, তেমনি জনগণকেও আরো ভীতিকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা কোনোভাবেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য শুভ হতে পারে না।
আলোচ্য নিবন্ধটি শুরু করেছিলাম এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরুর আশঙ্কা নিয়ে। এখন কিছুটা সম্ভাবনার পথ দেখা যাচ্ছে। আমরা লক্ষ করছি যে, কয়েক দিন ধরে সঙ্ঘাতপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আমরা মনে করি, মধ্যবর্তী তথা একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সংলাপ শুরুর একটা তাগিদ এর পেছনে ভূমিকা রাখছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার স্বাদে আচ্ছাদিত একমাত্র আওয়ামী ছাড়া দেশী-বিদেশী সব কূটনীতিকগোষ্ঠী সংলাপ শুরুর প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। আমরা আশা করছি, সরকার যেকোনোভাবেই হোক, ক্ষমতায় থাকার মোহ ত্যাগ করে দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে সংলাপ শুরু করার উদ্যোগ নেবে। অন্যথায়, সরকারি দলের ক্ষমতায় থাকার মোহ আমাদের পিছিয়ে দেবে। ইতিহাসে এ জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী থাকবে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.