একদলীয় নৈরাজ্যের পদধ্বনি by শিমুল বিশ্বাস

শিমুল বিশ্বাস
বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারি
স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগের প্রথম শাসন আমলে দুর্নীতি, নৈরাজ্য এবং চরম দলবাজির কারণে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছিল দুর্ভিক্ষ। স্বাধীনতাকামী জনগণের স্বাধীনতাযুদ্ধের চরম আত্মত্যাগকে পদদলিত করে আওয়ামী লীগ নেতারা দেশকে দুঃশাসন আর লুণ্ঠনের নরকরাজ্যে পরিণত করেছিল। শাসক দল সে সময় বিরোধী পক্ষকে নির্বিচারে অপহরণ ও খুনের মাধ্যমে তাদের কণ্ঠ রোধ করে। প্রশাসনে অন্তহীন দলীয়করণ করা হয় ও মানুষের বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রবর্তন করা হয় একলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’। ‘বাকশাল’ সম্পর্কে নতুন করে কিছু লিখতে যাওয়া আর বেদনার মহাকাব্য লেখা সমার্থক। সরকারি দল সে সময়ে ভিন্ন মতকে দমনের জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রায় ৪০ হাজার নেতাকর্মীকে খুন করে। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের ভুক্তভোগী জনগণ হারিয়েছিল তাদের স্বাধীন মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার সব অধিকার। স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল অতি অস্বাভাবিক চাওয়া। প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়ে এক ঐতিহাসিক নিবন্ধ লিখে সারা দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত চরম নির্লজ্জের মতো সব অরাজকতা ও ব্যর্থতার জন্য বিরোধী পক্ষকে দোষারোপ করে মিডিয়ায় একতরফা মিথ্যা প্রচার করত। সংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এগুলো হলো-
  1.     অপশাসন, গুম, খুন, অপহরণ, মানবতাবিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিরোধী ও ভিন্ন মতের কণ্ঠ রোধ করা।
  2.     এক-নায়কতান্ত্রিক মতবাদ অনুসরণ করা এবং পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বোচ্চমাত্রায় দলীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থ হাছিল করা
  3.     তথাকথিত আদর্শের মোড়কে চরম ব্যক্তিবন্দনার ছদ্মাবরণে সীমাহীন অর্থলিপসা ও লুটপাট করা।
  4.     জাতীয় স্বার্থ অগ্রাহ্য করে ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি করা।
  5.     নগ্ন ও পৈশাচিক প্রতিহিংসাপরায়ণতা।
  6.     তাদের সব অপকর্মের দায় বিরোধী পক্ষের ওপর চাপানো এবং তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা ও মিথ্যা দোষারোপ করা।
  7.     বাকস্বাধীনতা হরণ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কুক্ষিগত করে মিথ্যা দলীয় প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে বোকা বানিয়ে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করার চেষ্টা করা।
  8.     সর্বগ্রাসী সন্ত্রাসের মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সাধারণ জনগণকে রাজনীতি বিমুখ রাখা।
প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম সরকারের দুর্নীতি এবং গণমাধ্যম নিপীড়নের কিছু উদাহরণ দেয়া প্রয়োজন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য মুজিবনগর সরকার কর্তৃক সংগৃহীত ৭৫ কোটি টাকার কোনো হদিস পাওয়া গেল না (সরকারিভাবে ১৭ কোটির কথা স্বীকার করা হয়েছিল)। মুক্তিযুদ্ধের নামে জোগাড় করা সেই অর্থের কোনো হিসাব কেউই দিতে পারল না। এই অর্থ কিভাবে ব্যয় হলো, কে ব্যয় করল, আর যদি ব্যয় না-ই হয়ে থাকে তবে কোথায় গেল- এই প্রশ্নগুলো উঠতে শুরু করল। (সূত্র : গণকণ্ঠ. ৪ জানুয়ারি, ১৯৭৪)
ভারত থেকে স্বাধীনতার পর ঢাকায় এসেছিলেন তৎকালীন ইন্দিরা গান্ধী প্রশাসনের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি এন হাকসার। হাকসার ঢাকায় এসে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন সরকারের সাথে। আলোচনাকালে সামনে আসে মুজিবনগর সরকারের সেই টাকার প্রসঙ্গ, যা তখন ভারতীয় ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল। মঈদুল হাসানের স্মৃতিচারণ অনুসারে, ইন্দিরা গান্ধী প্রশাসনের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি এন হাকসার বলেন, ‘ভারত সরকার এই টাকাটা ফেরত দিতে চায় কিন্তু কীভাবে আমরা ফেরত পাঠাব? ব্যাংক ড্রাফট করে পাঠাব, নাকি তোমরা জিনিসপত্র কিনবে? জিনিসপত্র কিনলে তার বিপরীতে আমরা ব্লক হিসেবে সেই টাকা দেবো। তবে আমরা বিদেশী মুদ্রায় দিতে পারব না, ভারতীয় মুদ্রায় দেবো।’ তখন আওয়ামী সরকারের পক্ষ থেকে টাকাগুলো ট্রাকে করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে বলা হয়। বিস্মিত পি এন হাকসার সরকারকে বললেন, ‘ট্রাকে করে টাকা কিভাবে দেবো? আমাদের তো সরকারি হিসাব-পদ্ধতি আছে, ব্যাংকিং নিয়ম আছে।’ তারপর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় ‘সামনে আমাদের নির্বাচন, এই টাকা সে জন্য আমাদের দরকার হবে।’ গণকণ্ঠ, ৪ ঠা জানুয়ারি ১৯৭৪
পি এন হাকসার তৎকালীন সরকারের এই নীতিবহির্ভূত আচরণ ও অর্থলিপ্সায় ব্যথিত হয়েছিলেন। তিনি মিসেস গান্ধী ও তার সহকর্মীদের এ কথা জানান। ১৯৭২ সালের জুন মাসে ভারতের তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী ডি পি ধর মঈদুল হাসানকে এ ঘটনার কথা জানান। পরে ১৯৮১ সালে খোদ পি এন হাকসারও এর সত্যতা স্বীকার করেন। (মঈদুল হাসান, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর কথোপকথন। পৃষ্ঠা-১৪৩)
গণমাধ্যমের প্রতি তৎকালীন সরকারের যে ধরনের আক্রোশ ছিল এবং যেভাবে সেই আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ১৯৭২-৭৫ সালের মধ্যে অনেক দৈনিক-সাপ্তাহিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। সাংবাদিকদের ঝাঁকে ঝাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সর্বশেষ পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাকশাল কায়েম করে দেশে চারটি সংবাদপত্র বাদে বাকি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেন, তখন অনেক সাংবাদিক চাকরি হারিয়ে জীবন-জীবিকা নিয়ে হুমকির মুখে পড়েন। স্বাধীনতা লাভের প্রথম বছরেই শেখ মুজিব সরকার পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান প্রণীত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০ পুনর্বহাল করে সংবাদমাধ্যম দলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। গণশক্তি, হক-কথা, লাল পতাকা, মুখপত্র, বাংলার মুখ, স্পোকসম্যান- এই সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো নিষিদ্ধ হয়। বেশ কয়েকটির সম্পাদকও গ্রেফতার হন। বাহাত্তর সালেই অন্তত ১০টি পত্রিকার প্রকাশনা স্থগিত এবং একটি পত্রিকা বাজেয়াপ্ত হয়। সাপ্তাহিক হক-কথার প্রকাশক ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন খোদ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৭২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সের ২৬ ধারা অনুসারে হক-কথার প্রকাশনা বাতিল হয়। পত্রিকাটির ছাপাখানা শান্তি প্রেসকে ওই অধ্যাদেশের ২৩ (ক) ধারায় বই, সংবাদপত্র না ছাপানোর নির্দেশ দেয়া হয়। এর আগেই টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত হক-কথার সম্পাদক ইরফানুল বারীকে ১৯৭২ সালের ২৩ জুন গ্রেফতার করা হয়। এর পর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৭২ সালে মওলানা ভাসানী শেখ মুজিবের প্রতি লেখা খোলা চিঠিতে আক্ষেপ করে লেখেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে পত্রিকা প্রকাশের সাধারণ অধিকারটুকুও না থাকলে আমি এ দেশে থাকতে চাই না। হয় পত্রিকা প্রকাশনার অনুমতি দানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দাও, নয়তো আমাকে এ দেশ থেকে বহিষ্কার করো। (গণমাধ্যম নিপীড়ন, হাসান শান্তনু, পৃষ্ঠা-১২ )
১৯৯৬ সালে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচিত বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় পার্টি যুগপৎভাবে আন্দোলন করেছিল। আন্দোলনের মোড়কে তারা সে সময় সন্ত্রাসের রাজ্যত্ব কায়েম করে, যার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ। তারা তখন যাত্রীবাসে গান পাউডার দিয়ে যাত্রাবাড়ীতে ১৮ জন, শেরাটন হোটেলের সামনে ১১ জন মানুষ পুড়িয়ে হত্যা ও ১২ জন দগ্ধ যাত্রী বার্ন ইউনিটে প্রাণ হারান এবং গুপ্ত হত্যার মতো ঘৃণ্য কাজ করে, যা সবাইকে হতবাক করে দেয়। তাদের আন্দোলনের কারণে এসএসসি পরীক্ষা তিন মাস পিছাতে হয়েছিল, চট্টগ্রাম বন্দর অচল এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে তারা দেশের উন্নয়নকে থমকে দেয়।
এ সময় সামরিক বাহিনীতে উসকানি দিয়ে জেনারেল নাসিমের মাধ্যমে ‘ক্যু’ সংঘটনের চেষ্টা করা হয়, যা সমসাময়িক প্রচারমাধ্যমে বিশদভাবে প্রকাশিত হয়। তখনো আওয়ামী নেতাদের নিলর্জ্জ মিথ্যাচার ও গলাবাজি কারো অজানা নয়। জাতির বৃহত্তর স্বার্থ চিন্তা করে বিএনপি সে সময় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা মেনে নেয়। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং আবার তাদের পুরনো ‘বাকশালী’ দুঃশাসনের চিরায়ত রূপে স্বদম্ভে আত্মপ্রকাশ করে। শুরু হয় বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর অপহরণ ও খুনের সেই স্বভাবসিদ্ধ সংস্কৃতি। সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে চলে নগ্ন দলীয়করণ। দেশ ক্রমেই গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে এক-নায়কতন্ত্রে রূপান্তরিত হতে থাকে। গণতন্ত্র ও উন্নয়নকামী জনতা সেই দুঃশসান থেকে মুক্তির জন্য ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আওয়ামী লীগ সেই গণ-আন্দোলনকেও কালিমা লেপনের জন্য স্বভাবসিদ্ধভাবে প্রচারমাধ্যমে মিথ্যাচার ও বিরোধী দলের কুৎসা রটনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের কোনো দুরভিসন্ধিই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী হয়নি, জাগ্রত জনতা ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পুনরায় নির্বাচিত করে। ২০০১ সালে বিএনপি নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হয় এবং আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয় জনগণের সরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ এ দেশের সাধারণ মানুষ ও ভিন্নমতকে কখনোই সম্মান ও মর্যাদা দেয়নি। তারা কখনোই দলীয় এবং ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সবার কথা ভাবতে পারেনি। আওয়ামী লীগ কখনোই সাধারণ জনগণকে নিজেদের পক্ষের শক্তি মনে না করে শত্রুপক্ষের মতো মনে করে আসছে। ফলে তারা জনগণের সম্মতি ছাড়া বাঁকা পথে ক্ষমতা দখলের হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করে থাকে। তারা গণতান্ত্রিক ধারার বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীকে উসকানি দিয়ে ২০০৭ সালে ১/১১ এর মতো অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসায়। তারা স্বভাবসুলভ কূটিলতার মাধ্যমে জনগণকে পাশ কাটিয়ে এবং নানাভাবে প্রভাবিত করে ১/১১-এর অবৈধ সরকারকে দিয়ে প্রহসনের ভোটগ্রহণের নামে ২০০৯ সালে ইচ্ছামতো সংসদীয় আসন বণ্টনের নীলনকশা বাস্তবায়ন করে। ২০০৯ সালে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা গ্রহণের পরে আটঘাট বেঁধে আওয়ামী লীগ পুনরায় বিরোধী দলশূন্য রাজনীতি চর্চার পথ অনুসরণ করে আসছে। আবার শুরু হয় শেয়ার মার্কেট, ব্যাংক, বিদ্যুৎসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, টপটেররদের দৌরাত্ম্য, অপহরণ, গুম ও খুন। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ও অন্য সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে নির্লজ্জ দলীয়করণ অতীতের সব মাত্রাকে অতিক্রম করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ জনগণের সব প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণের মাধ্যমে দলীয় অনুসারীদের অনৈতিকভাবে পদোন্নতি ও পদায়নপূর্বক চরম ক্ষত সৃষ্টি করেছে। ফলে বিডিআর বিদ্রোহের মেতো কলঙ্কজনক ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুদ্ঘাটিত থেকে যায়। এ ঘটনায় সামরিক বাহিনীর ৫৭ জন চৌকস অফিসার প্রাণ হারান এবং তাদের পরিবারবর্গ নির্যাতনের শিকার হয়।
৫ জানুয়ারি ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাদের কুকর্মের পারাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, প্রশাসন ও দলীয় লোকদের যৌথ প্রচেষ্টায় মঞ্চস্থ হয় ইতিহাসের ঘৃণতী ভোট জালিয়াতি আর কারসাজির নির্বাচন। জনগণের ভোটের অধিকার পুনর্বার লুণ্ঠিত হয়। স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ হয়ে পরে আওয়ামী দুঃশাসনের অধীন। স্বাধীন জীবন, মুক্ত চিন্তা হয়ে পড়ে শৃঙ্খলিত। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণ এই দমনপীড়ন ও জবরদখল কখনো মেনে নেবে না। জনগণ আজ ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে, তারা স্বশাসন ও মুক্তির প্রতীক ‘গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার’ ফিরে পেতে চায়। সরকার ও তাদের বশংবদ বাদে বাকি সবাই একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই কেবল জনগণের ক্ষমতাকে সংরক্ষণ ও উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে পারে। তাই এই গণ-আন্দোলনে সমগ্র দেশবাসীর সমর্থন রয়েছে। ৮৫ শতাংশের অধিক মানুষ আজ একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এই গণ-আন্দোলনকে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করতে সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে তাদের অনুগত ব্যক্তি দ্বারা বিভিন্ন নাশকতা, মানুষ পোড়ানো, অপহরণ, লুটপাট, বিরোধী পক্ষের ঘরবাড়ি পোড়ানো, খুন, সরকারি ভবনে আগুন দেয়ার মতো ঘৃণ্য কাজে মেতে উঠেছে। এবার নতুন করে যোগ হয়েছে ‘গুম ও পেট্রলবোমার সংস্কৃতি’। গুম হচ্ছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা ও সাধারণ মানুষ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে দলীয় বাহিনীর মতো সাজানো হয়েছে। তাদের সব অপকর্মের জন্য ‘মৌখিক ইনডেমনিটি’ দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। দলীয় কর্মী ও অনুগত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজশে বাংলাদেশ এখন গুমের রাজ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে ক্রসফায়ারের নামে ঠাণ্ডা মাথায় খুন, গুম, পায়ে গুলি করে অঙ্গহানি করার মতো পৈচাশিক কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। এদিকে, বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে সমস্বরে তাদের স্বভাবসিদ্ধভাবে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপানোর ধারা অব্যাহত আছে। সংবাদপত্রের নিয়ন্ত্রণের এই চরম দু’সময়েও দু’একটি প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ার কল্যাণে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে পড়ে, যা থেকে এটা সবার কাছে স্পষ্ট যে, সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা এই নাশকতা নিয়ন্ত্রণ করছে। সুকৌশলে তারা বার্ন ইউনিটে ক্ষতিগ্রস্তদের সমবেদনার নামে মেকি আহাজারি করে মানুষকে বোকা বানিয়ে মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি ভিন্ন খাতে সরানোর চেষ্টা করছে।
আমরা একটি খুন বা প্রাণহানিকেও সমর্থন করি না। আমরা ক্রসফায়ার, গুপ্তহত্যা, পেট্রলবোমাসহ সব নাশকতার নিন্দা জানাই। মানুষ পোড়ানো, ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূতভাবে মানুষ হত্যা, গুপ্ত হত্যা, গুমসহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িতদের শাস্তি চাই। চলমান আন্দোলন মানুষের ভোটের অধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য, যা ইতোমধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন অর্জন করেছে। আওয়ামী লীগকে জনগণ আর বিশ্বাস করে না, যা তাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে লোক সমাগম দেখে অতি সহজেই অনুমান করা যায়।
বিএনপি একটি শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। গণতান্ত্রিক পথে রাজনৈতিক চর্চাই তার মূল লক্ষ্য। বিএনপি আজ সব মানুষের অধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বিএনপি মূলত ‘রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের দল’; তাই মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য প্রকৃত ত্যাগ বিএনপিই করতে পারে। অপর পক্ষে, আওয়ামী নেতাদের প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে বিলাসী জীবন বেছে নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মুখে বিএনপির সমালোচনা শোভা পায় না। বিএনপি রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে গড়া প্রকৃত একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। ‘বামের ডানে এবং ডানের বামে’ সেন্টার ফরোয়ার্ড মূলধারার মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল বিএনপি। বারবার নিপীড়ন নেমে এসেছে, দলে দলে নেতাদের ভাগিয়ে নেয়া হয়েছে, তবে মূলধারার আদর্শ অনুসরণ করায় বিএনপি ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিএনপিকে নির্মূল বা দমন করার কোনো অপচেষ্টাই সফল হবে না।
গণতন্ত্রে নির্মূল মানসিকতার কোনো স্থান নেই। গণতন্ত্রে ভিন্ন মতের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের ধারা অনুসরণ করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা গঠন ও পরিবর্তন না হাওয়ার কারণেই আজ গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছে। গণতন্ত্রে একদলীয় ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার কোনো স্থান নেই। এ পথ অনুসরণকারীদের করুণ পরিণতি ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে, বিশ্বের কোথাও ন্যায্য আন্দোলন কখনো বৃথা যায়নি। এবারো জনগণের আন্দোলন বৃথা যাবে না।
দেশবাসী আবারো দেখছে আওয়ামী দুঃশাসন আজ তার সর্বোচ্চ উচ্চতায় অবস্থান করছে। সময়ের দাবি এই দুঃশাসন ও জবরদখলের হাত থেকে গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার রক্ষা করতে হবে। সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সক্ষমতা অনুযায়ী অবদান রাখতে হবে। মানুষের স্বাধীনচিন্তা বিনিময়যোগ্য নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা, গণতান্ত্রিক চিন্তা ও অবাধ ভোটের অধিকারের চলমান আন্দোলন অবশ্যই জয়লাভ করবে।
লেখক : বিআইডব্লিউটিসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারি

No comments

Powered by Blogger.