রাজনীতির দার্শনিক by অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

গত ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪-এর জনকণ্ঠে 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও এগিয়ে যেতে হবে এ মর্মে একটি নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম- 'রাজনীতির দার্শনিক' জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কীভাবে জাতীয় অধ্যাপক প্রয়াত নূরুল ইসলাম স্যারকে ৯ মার্চ ১৯৭৩ বলেছিলেন 'প্রফেসর সাহেব, আপনি পিজিটাকে শাহবাগ হোটেল থেকে সরিয়ে মহাখালী, সোহরাওয়ার্দী কমপ্লেক্স বা সাভারে কয়েকশ বিঘা জায়গা নিয়ে গড়ে তোলেন, আপনি দেখেননি? জিন্নাহ পোস্টগ্রাজুয়েট ইনস্টিটিউট কত বিশাল জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে'? আমি যখন জেলে যেতাম, কোনো অসুবিধা হলে আমাকেও জিন্নাহ পোস্টগ্রাজুয়েটে নেওয়া হতো। আজকে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, সম্প্রসারণ করতে গিয়ে। তবুও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যিনি ২০০০ সালে শেরাটনের সামনের ০৮ বিঘা জায়গা দিয়েছিলেন, ২০১০ সালে আবারও কেবিন ব্লক সংলগ্ন ১২ বিঘা জায়গা দিয়েছেন, ২০১৪ সালে বেতারের জায়গাটি দিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে, এখন এটা সুন্দর ক্যাম্পাসে রূপান্তরিত হবে।
রাজনীতির দার্শনিক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফার একটি দফাও যদি যুবসমাজ বা ছাত্রসমাজ এক নিঃশ্বাসে বলতে পারেন, তাহলে ভবিষ্যতে আমি আর শখের বসেও লেখাপড়া করব না। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনীতিতে এবং আন্দোলনে পাকিস্তান সরকার কোনো নির্বাচনে, সেই ১৯৫৪ থেকে শুরু করে '৭০ পর্যন্ত সামরিক শাসনের মধ্যেও জাতির জনক এবং তার দলকে হারাতে পারেনি। ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে বিএনপি নামক রাজনৈতিক ক্লাবের সদস্যরা এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের কর্মীদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল তা কোনো অবস্থাতেই ভোলা যায় না এবং সেটা ছিল ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায়। সেই নির্যাতন এবং ১৯৭১ সালের নির্যাতনের অনেক জায়গায়ই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এটাই হলো অপরিপক্ব রাজনীতির উদাহরণ। কেন বললাম, আমাদের যুবসমাজ বা ছাত্রসমাজ ছয় দফা দাবি বলতে পারবে না, তার কারণ ইতিহাসকে জানার আগ্রহ তাদের একেবারেই নেই। যেই ইতিহাসই হলো কালের সাক্ষী। অবশ্য এ দেশে '৭৫-পরবর্তী সময়ে যেভাবে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে, সংবিধান পরিবর্তিত হয়েছে, তাতে ছাত্র-যুবসমাজের আগ্রহ কমে যাওয়ার কথা।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান যার নেতৃত্বে হয়েছিল যার ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির হৃদকম্পন শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু যদি অখণ্ড পাকিস্তান চাইতেন তাহলে তার বিরুদ্ধে কেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হলো? অনেকেই বিএনপিকে অপরিপক্ব বলেন, আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে বলব এ দলটি Premature baby, যাদের সব কিছুই দেরিতে develop করে, অনেক ক্ষেত্রে বেশ কিছু system-এ disability থেকে যায়। এই disability-গুলো বিভিন্ন থেরাপি দিয়েও সঠিক পথে আনা যায় না। যেমন ধরুন, স্পিচ থেরাপির কথা। স্পিচ থেরাপি দিয়ে যাদের কথা শিখানো হয় তাদের অনেকেই Lip reading করেন। আমার মনে হচ্ছে তিনি আইএসআই নামক সংস্থাটির Lip reading নিয়ে কথা বলছেন, তাই শেখানো বুলির মতোই বলছেন।
শুনে ভালোই লাগল, এ কারণে যে বিএনপি বিজয় দিবস পালন করেছে। জামায়াত যে এতে বাধা দেয়নি, এটাই তাদের ভাগ্য। কারণ জামায়াত এখনো বাংলাদেশকে বিশ্বাস করে, আমি তা বিশ্বাস করি না। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের 'আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি তাহলে তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তুল এবং যার যা আছে কিছু তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো।'
এখান থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান তিনি তার শেষ নির্দেশনা ও সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দিয়ে গেলেন। আর 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম' তা স্বাধীনতা ঘোষণারই শামিল। ৭ মার্চের ভাষণ এবং রাজনৈতিক দর্শন, যা বিশ্লেষণে স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই বোঝা না। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পন্ন দার্শনিকদের বক্তব্য বোঝার জন্য শুধু দক্ষ, শিক্ষিত ও ত্যাগী রাজনৈতিক কর্মীর দরকার।
'৬৯-এ ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র, ১৯৭০-৭১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে যথাক্রমে গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান ছিল শুধু বঙ্গবন্ধু নামক সিংহ পুরুষের নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং অবিচল আস্থা। আরবি প্রবাদ : 'একটি সিংহের নেতৃত্বে একদল ভেড়া, একটি ভেড়ার অধীনস্থ একদল সিংহকে হত্যা করতে পারে।' সু-প্রশিক্ষিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা বাঙালিরা ২ সপ্তাহ থেকে ৮ সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নিয়ে, পাকিস্তানি সিংহীদের পরাস্ত করতে পেরেছিলাম, শুধু নেতৃত্বে ছিলেন সিংহপুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। ভেড়া বলে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের খাটো করতে চাইনি, শুধু আমাদের প্রশিক্ষণের মাত্রাকে তুলে ধরেছি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণের সঙ্গে তুলনা করেছি। ছাত্র-যুবসমাজের প্রতি অনুরোধ, ইংরেজি প্রবাদ 'প্রথমে যোগ্য হও তারপর আশা কর'। তবে আমার প্রথম অংশটির প্রতি যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কেননা বর্তমান যুবসমাজ প্রাপ্তির নেশায় বেশি আকৃষ্ট, যোগ্যতর হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে কেমন যেন অনীহা।
আমার একটা বিশাল প্রশ্ন, যে প্রশ্নের জবাব বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের পরে দুনিয়াজুড়ে সব প্রিন্ট এবং তৎকালীন ইলেকট্রিক মিডিয়াতে তার বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন। প্রশ্নটি ছিল, বঙ্গবন্ধু পালিয়ে গেলে কি হতো? ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে (সম্ভবত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে) বিবিসি থেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছিলেন এক বাক্যে 'শেখ মুজিব পালিয়ে গেলে পুরো ঢাকা শহর ইপিআর, রাজারবাগ পুলিশ লাইন বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল কিংবা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মতো হতো। বীরের বেশে সবাইকে যুদ্ধ করার প্রস্তুত নিতে বলে বীরের বেশে ধরা দেন। রোগের যন্ত্রণায় যে ডাক্তার নিজে ভোগেননি বা তার নিকটআত্মীয় ভোগেনি, সে কখনো ভালো ডাক্তার হতে পারে না। তেমনি কোনো রাজনৈতিক নেতা জেলে না গেলে, রাজনীতিতে পরিপক্বতা আসে না। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের ১৪টি বসন্ত জেলে কাটিয়েছিলেন এবং লেখাপড়া করে কাটিয়েছিলেন। আজকের অসমাপ্ত আত্মজীবনী যে কি মূল্যবান দলিল তিনি এ প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন তা পণ্ডিত ব্যক্তিরাই উপলব্ধি করতে পারবেন।
দোহাই আপনাদের, '৭১-পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি অনুরোধ, আপনারা আর যাই বলুন না কেন জাতির পিতার নামটা শ্রদ্ধার সঙ্গে মুখে আনবেন। বঙ্গবন্ধু হলেন মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা, স্টালিন, থিওডোর রুজভেল্ট বা চার্চিলের মতো। বঙ্গবন্ধু এ দেশের মাটি ও মানুষের সম্পদ, তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৭৫-এর ১৮ আগস্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন, গত সপ্তাহে সংঘটিত বাংলাদেশের ঘটনাবলি তার সরকার আকস্মিক আঘাত বলে গণ্য করে। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য আয়োজিত এক জনসভায় মিসেস গান্ধী তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'সারা বিশ্বে শেখ মুজিব একজন মহান জাতীয় নেতা এবং 'স্টেটস্ম্যান' হিসেবে স্বীকৃত। তিনি অসাধারণ সাহস ও দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে তার জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। ভারতের জনগণ তাকে এ দেশের বন্ধু এবং উপমহাদেশে শুভেচ্ছা ও সহযোগিতার উৎসাহী সমর্থক হিসেবে গভীর শ্রদ্ধা ও প্রীতির দৃষ্টিতে দেখেন'। (দি গার্ডিয়ান, লন্ডন, ১৯ আগস্ট, ১৯৭৫)।
অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত
১৯৭৫ সালে জনাব জিয়াউর রহমান সাহেব যখন ক্ষমতায় তখন তিনজনের একটা আন্তর্জাতিক সাংবাদিকের টিম বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাদের একজন ব্র্যায়ন ব্যারন। যাদের তিন দিন শেরাটনে আটকিয়ে রেখে স্বৈরশাসক সরাসরি বিমানবন্দর দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। দেশে ফিরে ব্যারন লিখেছিলেন- '১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে লিখিত তার সংবাদ বিবরণীতে বলা হয়, শেখ মুজিব সরকারিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং জনসাধারণের হৃদয়ে উচ্চতম আসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা যখন ঘটবে, তখন নিঃসন্দেহে তার বুলেট-বিক্ষত বাসগৃহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্মারক-চিহ্ন এবং তার কবরস্থান পুণ্য তীর্থে পরিণত হবে।' (দি লিস্নার, লন্ডন, ২৮ আগস্ট, ১৯৭৫)।
মরহুম মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীও বলেছিলেন, 'টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের কবর একদিন সমাধিস্থলে রূপান্তরিত হবে এবং বাঙালির তীর্থস্থানের মতো রূপলাভ করবে'।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.