নেতানিয়াহু জিতেছে, হেরেছে ইসরাইল

ইসরাইলের ২০তম পার্লামেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দল, লিকুদ পার্টি। প্রাথমিকভাবে এটাকে নেতানিয়াহুর জয় হিসেবে দেখলেও চূড়ান্ত অর্থে ইসরাইল রাষ্ট্রের পরাজয় হয়েছে। এই ফলাফল নেতানিয়াহুর জন্য স্বল্পমেয়াদে ‘উত্তম কিছু’ বয়ে আনলেও দীর্ঘমেয়াদে মূল্য দিতে হবে দেশকে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধরাজনীতি বিশেষজ্ঞ ফ্রেড ক্যাপলন এসব কথা বলেছেন। ‘দ্য ইনসার্জেন্টস : ডেভিড পেট্রাস অ্যান্ড দ্য প্লট টু চেঞ্জ দ্য আমেরিকান ওয়ে অব ওয়ার’ গ্রন্থের প্রণেতা ফ্রেড ক্যাপলন বলেন, নেতানিয়াহুর জয়ে ইসরাইল-আমেরিকা সম্পর্কেই শুধু টানাপড়েন বাড়বে না, বরং বিশ্ব থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হবে তেলআবিব। নির্বাচনী প্রচারণায় নেতানিয়াহুর ঘোষণা অনুযায়ী ফিলিস্তিনের সঙ্গে দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানে হাঁটবে না ইসরাইল। অথচ তিনিই ২০০৯ সালে ঘোষণা শান্তি প্রক্রিয়ায় এমন সমাধানের কথা বলেছিলেন। এখন বিপরীত পথে হাঁটার ফলে মধ্যপ্রাচ্যের ওই অঞ্চলে অস্থিরতা ক্রমেই বাড়বে। আর তার ক্ষতি থেকে তেলআবিবও মুক্ত থাকবে না। এদিকে যুদ্ধবাজ নেতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমর্থন কমে যাওয়ায় বৈধতা সংকটে (লেজিটিমেসি ক্রাইসিস) ভুগবে ইসরাইল। আগামী ১ এপ্রিল ফিলিস্তিন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) পূর্ণাঙ্গ সদস্যের পদ পেতে যাচ্ছে। গত জুলাইয়ে ইসরাইলের গাজা হামলার যুদ্ধাপরাধ তদন্ত করবে আইসিসি। এতে ইসরাইলি নেতা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হতে পারেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবুও প্রতীকী এ রায়ে ক্ষতির মধ্যে পড়বে দেশটি। কারণ ইউরোপের অনেক দেশ যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।
১৮ মাস আগে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘আমরা দু’টি বিষয়ে খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে আসতে চাই- ইরানের পরমাণু চুক্তি ও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সম্পর্ক।’ কিন্তু ইসরাইলে মঙ্গলবারের নির্বাচন জানিয়ে দিচ্ছে, আগামী ২৪ মাসেও সংকট দু’টির কোনোটারই সুরাহা না হতে পারে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ট্রাম কার্ডে সব হিসাব উল্টে গেল। ওবামার সঙ্গে নেতানিয়াহুর মতবিরোধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সব ভেস্তে যেতে পারে। আগামী দু’বছর অন্তত এভাবেই কাটবে। কংগ্রেসের সঙ্গে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠতা বাড়লেও হোয়াইট হাউসের সঙ্গে নেতানিয়াহুর দূরত্ব বাড়বে। বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন পোস্টের এক নিবন্ধে এসব কথা বলা হয়েছে।
এ নির্বাচনের তাৎক্ষণিক ফলাফল হচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে রেষারেষি আরও বাড়বে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইতিমধ্যেই বিজয়ী নেতাকে অভিনন্দন জানাতে অস্বীকার করেছেন। এ নির্বাচনে নেতানিয়াহুর সাম্প্রদায়িক বিষোদ্গার ছড়ানো ‘ঘৃণ্য প্রচারণা’র কড়া সমালোচনা করেছে হোয়াইট হাউস। বুধবার হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জোশ আর্নেস্ট বলেছেন, ‘ইসরাইলি আরব নাগরিকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচারণায় যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’ তিনি বলেন, নেতানিয়াহুর প্রচারণা পদ্ধতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বিপন্ন করেছে। কিন্তু গণতন্ত্রই দুই দেশের সম্পর্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
ইসরাইলে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ব্রুকিং ইন্সটিটিউশনের সহ-নির্বাহী সভাপতি মার্টিন ইনডিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্কের কাচ নেতানিয়াহু পদদলিত করে ভেঙে ফেলেছেন। এখন কোনো বিষয়ে দুই দেশের যৌথ স্বার্থ ও পারস্পরিক ইচ্ছার সমন্বয় না হলে এ সম্পর্ক মেরামত হবে না।’
অতীতে ইসরাইলের যেসব নেতা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন, তাদের মূল্য দিতে হয়েছে। ১৯৯১ সালে ইঝাক শামির মাদ্রিদ শান্তি আলোচনার বিরোধিতা করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জর্জ ডব্লিউ বুশের নেয়া পদক্ষেপে শামিরের সরকার পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু এবারই ওবামার সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েও নির্বাচনে ঠিকই উৎরে গেলেন নেতানিয়াহু। তবে সব এখন ছাড় পেয়ে গেলেও ভবিষ্যতে ষোলআনা মাশুলই গুনতে হবে বলেই মনে করেছেন পশ্চিমা বিশ্লেষকরা।
মধ্যপ্রাচ্যে অশনি সংকেত
ইসরাইলের সাধারণ নির্বাচনে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিজয়কে ‘হতাশাব্যঞ্জক’ হিসেবে দেখছেন বিশ্ব নেতারা। নেতানিয়াহুর অসহিষ্ণু মনোভাব মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির জন্য অশনি সংকেত হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ ব্যাপারে ‘শীতল অভ্যর্থনা’ প্রদর্শন করেছে। খবর এএফপির।
শান্তি প্রক্রিয়া দ্বিরাষ্ট্রিক হতে হবে : ইইউ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মঘেরিনি নেতানিয়াহুকে এক টেলিফোন কলে জানিয়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করতে হবে। আর তা হতে হবে দ্বিরাষ্ট্রিক। পরে এক বিবৃতিতে তিনি জানান, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দু’পক্ষের সাহসী নেতৃত্ব দরকার।
নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে দ্বিরাষ্ট্র সম্ভব নয় : আব্বাস
বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরাইল সরকারের সঙ্গে দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান অসম্ভব বলে মনে করছেন ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, নেতানিয়াহুর বক্তব্যে এটাই প্রমাণিত হয়েছে, রাজনৈতিক সমাধানে তারা বিশ্বাসী নয়। নেতানিয়াহু সরকারের অধীনে মধ্যপ্রাচ্যে কখনও শান্তি আসবে না।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের আশা করি : জার্মানি
জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মার্টিন শাফার বলেছেন, আমরা নেতানিয়াহুর মন্তব্য ‘গুরুত্বের সঙ্গে’ নিয়েছি। আমরা আশা করি দ্বিরাষ্ট্রিক সমাধানের দিকেই বর্তমান নেতৃত্ব অগ্রসর হবে।
একমাত্র দেশ হিসাবে অভিনন্দন কানাডার
কানাডাই একমাত্র দেশ যারা নেতানিয়াহুর বিজয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার এক টুইটার বার্তায় নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা ইসরাইলের নির্বাচনী ফলাফলে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তার সরকারের সঙ্গে আমরা কাজ চালিয়ে যাব। কানাডার চেয়ে ইসরাইলের মহৎ বন্ধু নেই।’
আলোচনায় প্রভাব ফেলবে না : যুক্তরাষ্ট্র
ইসরাইলের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিজয় ইরানের সঙ্গে একটি পরমাণু চুক্তিতে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে না। বুধবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এ কথা জানায়। ইসরাইলি নেতা তেহরানের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সমঝোতার বিরোধিতা করেন। তিনি ওয়াশিংটনে যান এবং মার্কিন পার্লামেন্টে ভাষণদানকালে আলোচনাধীন চুক্তিকে ‘খারাপ চুক্তি’ বলে নিন্দা জানান। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জেন সাকি বলেন, ইরানের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমরা দীর্ঘদিন পরিচিত। আমরা মনে করি না যে, তার বিজয় ইরানের পরমাণু চুক্তির আলোচনার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলেছে বা ফেলবে। এএফপি

No comments

Powered by Blogger.