প্রশাসনিক বিভাগ সৃষ্টির দাবি ও বাস্তবতা by আলী ইমাম মজুমদার

উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া আমাদের প্রশাসনব্যবস্থায় বিভাগ একটি স্তর। একগুচ্ছ জেলা নিয়ে হয় বিভাগ। ইদানীং নতুন একটি বিভাগ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর সীমানা নির্ধারণসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিকতা শেষ হলে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাবে। তারপর প্রয়োজনীয় জনবল নিয়ে যাত্রা শুরুর কথা। তবে তৈরি করতে হবে ভৌত অবকাঠামো। এরই মধ্যে আরেকটি পুরোনো জেলা শহরে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী বলেছেন, সেই বৃহত্তর জেলাটি নিয়েও আরেকটি বিভাগ হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। অন্যান্য আরও কিছু বিভাগ করার দাবি কোথাও কোথাও হচ্ছে। দেখা গেছে, নতুন বিভাগের দাবির সঙ্গে সেই স্থানের জনগণ একাত্ম হয়ে যায়। আবার যেসব অঞ্চল নতুন বিভাগে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব আসে, সেগুলোর কোনো কোনোটি এর বিরোধিতায় নেমে পড়ে। মজার দিক হচ্ছে, এসব দাবি বা পাল্টা দাবি অনেকটাই সর্বদলীয়। অঞ্চলগুলোর জনগণের আবেগ-অনুভূতি থাকে এসব দাবির প্রতি। তাই সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে যথেষ্ট সতর্ক হতে হয়।
দেখা যেতে পারে, বিভাগ বা প্রশাসনিক অন্য যেকোনো ইউনিট প্রতিষ্ঠার দাবি কেন আসে? এর জবাবে হয়তো বলা হবে, জনগণ সেবা পেতে প্রশাসনকে তাদের কাছাকাছি চায়। তাদের এ প্রত্যাশা নেহাত যৌক্তিক। আর জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের এসব দাবির প্রতি সংবেদনশীল হওয়াই তো স্বাভাবিক। তবে সেই প্রশাসনিক ইউনিটটির সঙ্গে জনগণের সংশ্লিষ্টতা কতটুকু, আর প্রতিষ্ঠার অপরিহার্যতাও বিবেচনার আবশ্যকতা রয়েছে। কেননা, একটি বিভাগ, জেলা কিংবা উপজেলা নতুনভাবে করতে গেলে অবকাঠামোগত ব্যবস্থাদি ছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য অনেক অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হয়।
উল্লেখ্য, জাতীয় স্তরে মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অধীনস্থ পরিদপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থা থাকে। এর পরের স্তরগুলো হচ্ছে বিভাগ, জেলা আর উপজেলা। জেলা আর উপজেলায় জনগণকে যেতে হয় প্রায়ই। উন্নয়নমূলক কার্যক্রম, আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা, ভূমি প্রশাসন আর বিভিন্ন ধরনের নাগরিক পরিষেবা দান জেলা-উপজেলাতেই হয়ে থাকে।
প্রশ্ন আসবে, তাহলে বিভাগ কেন? বিভাগ মূলত একটি তদারকি স্তর। সাধারণ প্রশাসনে বিভাগীয় কমিশনার তদারকির কাজ ছাড়াও ভূমি ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত কিছু আপিল নিষ্পত্তি করে থাকেন। তবে তদারকি স্তর হিসেবে বিভাগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভাগীয় পর্যায়ের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজ পরিদর্শন ও পর্যালোচনা করে অধিকতর উন্নতি বিধানের জন্য নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। মূল্যায়ন করেন তাঁদের কার্যক্রম। তাঁরা জেলা ও জাতীয় পর্যায়ের সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে সংযোগমাধ্যম হিসেবে কাজ করেন। তবে প্রকৃত অর্থে সীমিত কিছু ক্ষেত্র ছাড়া জাতীয় পর্যায় থেকে জেলা পর্যায়ের সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়। অবহিত রাখা হয় বিভাগীয় স্তরকে। একইভাবে অনেক ক্ষেত্রে জেলা থেকেও সরাসরি জাতীয় পর্যায়ে যোগাযোগের বিধান রয়েছে। আর প্রকৃতপক্ষে মূল কাজ জেলা ও উপজেলায় হয় বলে এ ধরনের যোগাযোগই স্বাভাবিক। তবে তদারকি স্তর হিসেবে বিভাগকে উপেক্ষা করা যায় না। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে বিভাগীয় পর্যায়ের সঙ্গে জনগণের সরাসরি যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা খুবই কম।
তা সত্ত্বেও বিভিন্ন স্থান থেকে সময়ে সময়ে বিভাগ করার দাবি আসে। সেসব দাবি ক্ষেত্রবিশেষে সরকার বিবেচনায়ও নেয়। তবে বিচ্ছিন্নভাবে তা না করে গোটা দেশের বিভাগীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক স্তরটি বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে অধিকতর যৌক্তিক হবে। দেখা দরকার কয়টি নতুন বিভাগ করা প্রয়োজনীয় আর কোন কোন স্থানে। এ প্রসঙ্গে কিছুটা অতীতে যাওয়া যেতে পারে। মাঠ প্রশাসনের মূল স্তর হিসেবে এই উপমহাদেশে জেলা গঠিত হয় ১৭৭২ সালে হেস্টিংসের শাসনামলে। আর ইংরেজ শাসনাধীন অঞ্চল বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এই জেলাগুলোর তদারকি স্তর হিসেবে বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮২৯ সালে লর্ড বেন্টিংকের শাসনকালে। প্রশাসনের স্তর হিসেবে জেলা এই উপমহাদেশের সবগুলো দেশে রয়েছে। তবে বিভাগ সেভাবে নেই। ভারতেই ২৯টি রাজ্যের মধ্যে ১২টিতে নেই কোনো বিভাগ। কতগুলো রাজ্য ছোট বলে এমন হতে পারে। তবে আমাদের দেশের প্রায় সম-আয়তনের ও জনবহুল তামিলনাড়ু ও অন্ধ্র প্রদেশে নেই কোনো বিভাগ। কিছুটা ছোট রাজ্য হলেও সাড়ে তিন কোটি লোকসংবলিত ১৪টি জেলার কেরালায়ও কোনো বিভাগ নেই। অবিভক্ত বাংলায় ১৯৪৭ সালে ছিল ২৯টি জেলা আর পাঁচটি বিভাগ। পূর্ব বাংলার ভাগে ১৬টি জেলা এবং আসাম থেকে ভাগ হওয়া সিলেট পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে ছিল তিনটি বিভাগীয় সদর দপ্তর। অবশিষ্ট অঞ্চল পশ্চিম বাংলায় এখন ২০টি জেলা ও তিনটি বিভাগ। তারা মহকুমা স্তরটি বিলুপ্ত করেনি। ১৯৪৭-এর পর পূর্ব বাংলায় খুলনা বিভাগ চালু হয়। ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপি সরকার বরিশাল ও সিলেটে বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। মহাজোট সরকারের গত মেয়াদে প্রতিষ্ঠিত হয় রংপুর বিভাগ। অর্থাৎ আমাদের ৬৪টি জেলা রয়েছে সাতটি বিভাগের আওতায়।
বিভাগ থাকা আর না থাকার বিতর্ক ব্রিটিশ শাসনামলেও ছিল। অবিভক্ত বাংলার শাসনব্যবস্থা পর্যালোচনার জন্য ১৯৪৭-এর কিছু আগে রাওল্যান্ড কমিশন বিভাগ বিলুপ্তির সুপারিশ করে। তবে সেই প্রতিবেদন গৃহীত হয়নি। ভারতে একই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছিল স্বাধীনতার পর পর মধ্যপ্রদেশ ও তখনকার বোম্বাইতে (এখন মহারাষ্ট্র ও গুজরাটে বিভক্ত)। বিলুপ্ত হয়েছিল বিভাগ। আট বছর পর প্রয়োজনের তাগিদে আবারও তা গঠিত হয়। আমাদের দেশেও বিভাগীয় প্রশাসনের স্তরটির প্রয়োজনীয়তা সময়ে সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তবে একে উপেক্ষা করা যায়নি বলে এখনো টিকে আছে। শুধু তা-ই নয়, আসছে নতুন নতুন বিভাগের দাবি। তবে নতুন বিভাগ করার আগে অনেকগুলো বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে প্রস্তাবিত বিভাগটিতে কয়টি জেলা নেওয়া হবে। জেলার সংখ্যা সব বিভাগে সমান না হলেও কিছুটা সামঞ্জস্য থাকা দরকার। ভৌগোলিক নৈকট্য, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যও বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। অতীতে যা হওয়ার হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে এমনটা হতে থাকবে, এটা সংগত নয়।
আমাদের মহকুমা স্তরটি ভেঙে দেওয়ায় জেলার সংখ্যা বেড়েছে। জেলাগুলোর কার্যক্রমের সমন্বয় বিধানের জন্য বিভাগের প্রয়োজনীয়তাও নতুনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এরই মধ্যে সাতটি বিভাগ হয়ে গেছে। আরও হওয়ার প্রয়োজন থাকতে পারে। এর সমর্থনে বলা হয়, জেলার সংখ্যা বৃদ্ধি ও সরকারের কাজকর্মের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা অনেক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন প্রশাসনিক স্তরের ইউনিটগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি যৌক্তিক। উপজেলা ও জেলার প্রশ্নে জনসম্পৃক্ততার বিষয়টি থাকে; বিভাগের ক্ষেত্রে নয়। আর জেলা করতে গিয়েও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুবিবেচনার পরিচয় দেওয়া হয়নি বললে ভুল হবে না। রাজনীতির বাইরে থেকে আসা শাসকেরা বেসামরিক ক্ষমতার ভিত সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এগুলো করেছেন। কেউ করেছেন দু-তিনটি থানা নিয়ে মহকুমা। এর পরেরজন করলেন সেগুলোকে জেলা। প্রশাসনকে আমরা জনগণের দোরগোড়ায় নেওয়ার নামে কিছু ক্ষেত্রে যুক্তি ও প্রয়োজনীয়তাকে উপেক্ষা করেছি।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের অধিকতর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশাসনিক ইউনিটের সংখ্যা বৃদ্ধির যে দাবি, তা যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। জনসংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি উন্নত হয়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। এখন অতি দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়া যায়। তদুপরি তথ্যপ্রযুক্তির সম্প্রসারণ শুধু দেশ নয়, গোটা বিশ্বকেই ক্রমান্বয়ে ছোট করে ফেলছে। ঢাকার সচিবালয় থেকে কোনো একটি পরিপত্র গ্রুপ মেইলে কয়েক মিনিটে সব জেলা প্রশাসককে পাঠানো যায়। অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব সেদিনই তাঁদের কাছ থেকে জবাব পাওয়া। ভিডিও কনফারেন্স এখন জেলা ও রাজধানীর মধ্যে মতবিনিময়ের জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে। ক্রমান্বয়ে ঘটবে তথ্যপ্রযুক্তির আরও প্রসার। তা সত্ত্বেও স্থানীয় স্তরে, বিশেষ করে জেলা ও উপজেলায় প্রয়োজন হবে প্রশাসনের কার্যকর উপস্থিতি। তেমনি তাদের তদারক ও মূল্যায়নের জন্য বিভাগীয় স্তরও অপরিহার্য। তবে নতুন বিভাগ করার প্রস্তাব সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা সংগত হবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.