ঢাকা: দৃশ্যান্তরের বর্ণচ্ছটা by ড. মাহফুজ পারভেজ

আজ থেকে ২০ বা ৩০ বা ৪০ বছর আগের ঢাকার দৃশ্যপট যারা দেখেছেন, তারা কি সবটুকু মনে রাখতে পেরেছেন? শৈশব বা কৈশোরের ঢাকার বিবরণ আজকে শুনলে রূপকথার মতোই মনে হবে। কেউ কি এখন বিশ্বাস করবে যে, রিকশায় চড়ে পুরো ঢাকা শহর একদা পরিভ্রমণ করা সম্ভব ছিল! আশির দশকেও নীলক্ষেত থেকে সাভারের জাহাঙ্গীরনগরে ৪০-৫০ মিনিটে বাসে চলে যাওয়া সম্ভব ছিল! কেমন যেন নিজের একান্ত শহর মনে হতো ঢাকাকে। আজকে যা খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। এই ঢাকার যে দৃশ্যান্তর বা পরিবর্তন, নগরায়নের তত্ত্বে সেটা উন্নয়ন না অবক্ষয়, তা নিয়ে তুমুল তর্ক হতে পারে। ঢাকার জীবনের সমাজতাত্ত্বিক বা সাংস্কৃতিক পালাবদলও ইতিবাচকতা আর নেতিবাচকতার তুলাদণ্ডে বিশ্লেষিত হওয়ার দাবি রাখে। নাগরিক জীবনের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির নিরিখে ঢাকার বিকাশ যথেষ্ট ভাবনার বিষয়। ঢাকাকে নাগরিক-বান্ধব ও পরিবেশ-অনুকূল এবং বাসযোগ্য রাখতে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবেশবিদ, উন্নয়নকর্মী, নগরায়ন বিশেষজ্ঞরা এসব কথা হামেশাই বলছেন। যদিও এসব কথার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের পেছনে জরুরিভাবে রয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার বিষয়টি; তথাপি ঢাকা নিয়ে, এর যানজট ও জলাবদ্ধতা নিয়ে, প্রকৃতি-বিনাশ ও বিমানবিকীকরণ নিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাধররা বিশেষ কিছুই বলছেন না। তারা বরং সহস্র জনতাকে জ্যামে আটকে রেখে ভেঁপু বাজিয়ে নির্বিঘ্নে চলাচল করতেই পছন্দ করেন। ঢাকা নিয়ে অন্য কেউ ভাবুক বা না-ভাবুক, কবি আর শিল্পীরা ঠিকই ভেবেছেন। কবিতা বা কথাসাহিত্যের মতোই চিত্রকলায় ঢাকার বিবর্তন উঠে এসেছে। বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সংখ্যাতিরিক্ত-অধ্যাপক সমরজিৎ রায় চৌধুরীর ৭ম একক চিত্র প্রদর্শনীর শিরোনামও মন্তাজ বা দৃশ্যান্তর, যা উৎকীর্ণ করেছে ঢাকার পরিবর্তনমানতাকে। সমরজিৎ চড়া রঙ ব্যবহার করেন ছবিতে। ধূসর অতীতকে ধরে রাখতে চান; হারিয়ে ফেলতে নারাজ তিনি। তার একটি ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ধানমন্ডির বেঙ্গল গ্যালারিতে যখন প্রশ্ন করি, তখন শাঁখারীপট্টির আবহে আঁকা ছবিটি দেখিয়ে বললেন, ‘‘একদিন এলাকাটির এই টপোগ্রাফি বাস্তবে থাকবে না বটে। কিন্তু আমার দেখায় আর আঁকায় রয়ে যাবে।” কুমিল্লায় জন্ম নেয়া এই শিল্পীর পেশাগত বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের কিবরিয়া, রশিদ চৌধুরীর আঁকার ধরন পছন্দ করেন তিনি। পছন্দ করেন পিকাসো ও মাতিসের কাজ। ঘুরেছেন পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সবগুলো বিশিষ্ট চিত্রশালা। নিজের ছবিতে কিউবিক, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ধারার প্রয়োগেও পারঙ্গমতা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। ঢাকার নানা দৃশ্যপট, মুক্তিযুদ্ধ, প্রকৃতি ও পরিবেশ, যা একদা ছিল কিন্তু আজ আর নেই, এবারের প্রদর্শনীতে সে সবই বিষয়বস্তু হয়ে এসেছে। বললেন, “আমি রঙ আর আলো-ছায়ায় নানা দৃশ্যপটের কল্পনায় ফুটিয়ে তুলেছি। দেখার অনুভূতিকে ধরে রাখতে চেয়েছি। ঐতিহ্য ও আবহমানতা এভাবে আমার আঁকায় থেকে যাচ্ছে।”
সমরজিৎ রায় চৌধুরী মনে করেন, তথ্য-প্রযুক্তি, যোগাযোগ ও কম্পিউটারের ব্যবহারের মাধ্যমে সাম্প্রতিক প্রজন্মের তরুণতম শিল্পীরা আঁকার অনেক বড় পরিধি পাচ্ছে। বিদেশী চিত্রকলা সম্পর্কে তারা অতি দ্রুত জ্ঞাত হতে পারছে। এতে তাদের কাজের মান বাড়ারই সম্ভাবনা। তারা যদি বাংলাদেশের চিরায়ত বিষয়বস্তুকে নিজস্ব শৈলীতে ধরে রাখতে পারে, তবেই আমাদের শিল্পকলা ও চিত্রশিল্পের প্রভূত মঙ্গল হবে। ঢাকা বা বাংলাদেশ নিয়ে শিল্পীর দু’ চোখ যে বাস্তব আর কল্পনার মিশেলে দৃশ্যপটের বর্ণচ্ছটা আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছেন, তা দেখে এই নগরের বাসিন্দা আর নীতিনির্ধারণের প্রকৃত-নয়ন উন্মিলিত হলেই অবক্ষয়ের কশাঘাত থেকে বাঁচতে পারবে প্রাচ্যের এই সুপ্রাচীন নগরী। তিলোত্তমা না হোক, অন্তত হতে পারবে মানুষের বসবাসযোগ্য। প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব নান্দনিক ঢাকা শুধু স্বপ্ন, কল্পনা আর স্মৃতিচারণের নস্টালজিয়ায় না থেকে বাস্তবের বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে, এটাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হওয়া দরকার। আধুনিক মানুষ হিসেবে আমাদের জীবনযাপনের ক্ষেত্র ঢাকাকে সুন্দর ও নিরাপদ করার কাজ আর কতদিন বাকি পরে থাকবে? সমরজিৎ সম্ভবত অলক্ষ্যে এ প্রশ্নটিই সকলের চৈতন্যে পৌঁছে দিয়েছেন তার একক চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে।

No comments

Powered by Blogger.