স্বজন মিলছে না পরিচয় শুধু একটি ছবি by রোকনুজ্জামান পিয়াস

ঘটনাকাল ১৯৯৬ সালের ৬ই জুলাই। ওইদিন কুয়েতে কর্মরত অবস্থায় খুন হন আজিজুর রহমান নামের এক বাংলাদেশী। খুনি ফিলিপাইনি নাগরিক জোসেফ আরবিজতোন্ডো। আদালতের বিচারে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। ১৭ বছর ধরে সেই সাজাই ভোগ করে চলেছে সে। ওই সময় সাজা মওকুফের বিকল্প ব্লাড মানি হিসেবে ৬০০০ কুয়েতি দিনার ধার্য করা হয়। এর বর্তমান মূল্যমান প্রায় ১৬ লাখ টাকা। কিন্তু খুনির পরিবার  তখন আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে সে টাকা দিতে অপারগতা জানায়। ওই টাকা না পরিশোধ করা পর্যন্ত আমৃত্যু জেলেই কাটাতে হবে তার। দীর্ঘ ১৮ বছর পর কুয়েতে অবস্থিত ফিলিপাইনি কমিউনিটি খুনিকে মুক্ত করার জন্য সমপরিমাণ টাকা যোগাড় করে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিয়েছে অন্যখানে। বাংলাদেশে আজিজুর রহমানের পরিবারের সন্ধান মিলছে না। ওই টাকা গ্রহণের জন্য পাওয়া যাচ্ছে না কোন উত্তরাধিকারী। বিস্তারিত ঠিকানাও নেই। ওই সময়ে তোলা পাসপোর্টে সংযুক্ত ছবিটিই এখন একমাত্র মাধ্যম- যা বেশ অস্পষ্ট। আজিজুর রহমানের উত্তরাধিকারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বছরখানেক আগে কুয়েতে অবস্থিত ফিলিপাইন দূতাবাস বিস্তারিত তথ্যের জন্য তাদের ঢাকাস্থ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও আজও পর্যন্ত তার হদিস মেলেনি। বিষয়টি জানার পর মাইগ্রেশন ফোরাম ইন এশিয়ার (এমএফএ) ফিলিপাইনি সদস্য সেন্টার ফর মাইগ্রেশন এডভোকেসি (সিএমএ-ফিল্‌স) খুনি জোসেফ আরবিজতোন্ডোকে মুক্ত করার জন্য বিভিন্ন কমিনিউনিটি থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। এরপর তারা এমএফএ’র মাধ্যমে আজিজুর রহমানের পরিবারের সন্ধান করতে থাকে। এমএফএ তাদের বাংলাদেশী সদস্য ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ফর দ্য রাইটস অব বাংলাদেশী ইমিগ্রেন্টস (ওয়ারবি) ডেভেলপমেন্টস ফাউন্ডেশনকে নিহত আজিজুর রহমানের উত্তরাধিকারি পিতা, মাতা ও স্থায়ী ঠিকানা জানানোর জন্য অনুরোধ করে। আজিজুর রহমানের উত্তরাধিকারীর তথ্য সংগ্রহের সুবিধার জন্য এমএফএ ওয়ারবিকে তিনটি সাপোর্টিং পেপার পাঠায়। এর মধ্যে রয়েছে পাসপোর্টের ছবি সংবলিত এক পাতার ফটোকপি যাতে আজিজুর রহমানের ঠিকানা দেয়া আছে। এতে আজিজুরের জন্মস্থান ঢাকা, জন্ম তারিখ ২/৩/১৯৬৩, পেশা ড্রাইভার, পাসপোর্টের মেয়াদ ১৯/০৬/১৯৯৬ লেখা আছে। এমএফএ পাঠানো আরবিতে লেখা সাময়িক প্রবেশের অনুমতি সংক্রান্ত আরেকটি ডকুমেন্ট পাঠানো হয়েছে। সিল ও স্বাক্ষরযুক্ত ওই কাগজে দেখা যায় আজিজুর রহমানের জাতীয়তা বাংলাদেশী, কাজের স্থান: দিয়াত আল উকু। এছাড়া আরবিতে পাঠানো অপর ডকুমেন্টে লেখা আছে- কুয়েত রাষ্ট্র: সিভিল কার্ড, নাম: মনির হাসান আলী, জাতীয়তা: বাংলাদেশী, জন্ম ১০/১১/১৯৫৬, কার্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ ২৫/১১/১৯৯৬, সম্পর্ককারীর সিভিল নাম্বার ২৫৬১১১০০১৭৯৮, আবাসন নাম্বার ১১৫৪১৫১৭৫। মালিক সালেহ আলী মোহাম্মদ আল শামুম, ঠিকানা: আল মালিবিখাত, সেকশন-২, জাদ্দাহ-১১, বিভাগ-৮০, ইউনিটের ধরন বাসা, ইউনিট নাম্বার- ফ্লোর-০০, টেলিফোন- ৪৫৮২৩৫৮, রক্তের গ্রুপ: এ+। তবে মনির হাসানের সঙ্গে নিহত আজিজুর রহমানের প্রকৃত সম্পর্কের কথা উল্লেখ নেই। ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশী মনির হাসান নিহত আজিজুর রহমানের পরিবারের পক্ষ হয়ে আপসরফা করার জন্য মধ্যস্থতা করেছিলেন। কিন্তু ওই সময় ফিলিপাইনি পক্ষ টাকা দিতে না পারায় তার অগ্রগতি হয়নি। হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন সবাই। এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে ১৭টি বছর। বর্তমান তারা ওই টাকা যোগাড় করেছেন। এখন তা আজিজুরের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছেন। এমএফএ-এর পাঠানো ওই সব ডকুমেন্ট নিয়ে ওয়ারবি আজিজুর রহমানের তথ্য জানার জন্য পাসপোর্ট অফিসে যায়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এত আগের (১৯৮৮ সাল) ইস্যুকৃত কোন পাসপোর্টের কোন তথ্য বা ডাটা তাদের কাছে সংরক্ষিত নেই। গত ১৯শে জুলাই ওয়ারবি জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)তে আজিজুর রহমানের তথ্য জানার জন্য আবেদন করে। বিএমইটি তাদের জানায়, পাসপোর্টের নাম্বারেও ভুল রয়েছে। নাম্বারে একটি ডিজিট কম রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে পাসপোর্টটি জাল ছিল। এদিকে প্রকৃত ওয়ারিশের কাছে সমুদয় অর্থ হস্তান্তর না করা পর্যন্ত মুক্তি পাচ্ছে না জোসেফ। ইমেইল বার্তায় সিএমএ-ফিল্‌স খুনিকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দিতে আজিজুর রহমানের ওয়ারিশদের খুঁজে বের করার অনুরোধ জানিয়েছে। এ ব্যাপারে ওয়ারবি’র মহাসচিব ফারুক আহমেদ বলেন, আজিজুর রহমানের প্রকৃত ওয়ারিশকে খুঁজে পেতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এ অর্থ পেলে ভিকটিমের পরিবার কিছুটা হলেও উপকৃত হতো। প্রকৃত ওয়ারিশদের সন্ধান পেলে তারা ওই ক্ষতিপূরণ পেতে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন বলেও তিনি আশ্বাস দেন।

No comments

Powered by Blogger.