স্কটল্যান্ডে গণভোট- স্বাধীনতার স্বপ্ন মরে না!

স্কটিশ গণভোটে জনগণের মাথা কাজ করেছে। হূদয় কাজ করেনি। তারা অন্তত এ যাত্রা বড় বাঁচা বেঁচে গেছেন। স্কটল্যান্ড স্বাধীন হলে কে হতেন তার জাতির জনক? কে হতেন স্বাধীনতার ঘোষক? এ বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার বিপদ থেকে জনগণই তাদের বাঁচিয়ে  দিয়েছে। মি. স্যামন্ড (স্বাধীনতার জন্য গণভোটের জনক) ভোটের পরে বলেছেন, ‘স্কটল্যান্ডের জন্য ক্যাম্পেন শেষ হয়ে যায়নি। স্বাধীনতার স্বপ্নের কখনও মৃত্যু নেই।’ এই স্বপ্ন কি ভৌগোলিক? কেবল ভূগোল হলেই তা স্বপ্ন মেখে দিতে পারে? স্যামন্ড কোন জ্বালাময়ী বক্তব্য দেননি। স্বাধীনতার স্বপ্ন কি মাঝপথেই থমকে গেল? যে ভাবে দেখে। নেতারা যেখাবে দেখান। সেভাবেই কখনও স্বাধীনতার স্বপ্ন সৌধ আঁকা হতে পারে। যেমন এক লেবার নেতার কথায়, নতুন স্বপ্ন দেখা আটকাচ্ছে কে! “আমাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিদের গল্প করবো আমরা শুধু দেশটাকে অখণ্ডই রাখিনি, একসঙ্গে গড়েছি নতুন দেশ। এই বা কম কি!”

তবে ভোটের পরে নিউ ইয়র্ক টাইমসের সার্জ স্কিম্যান একটি অসাধারণ মন্তব্য করেছেন, ‘স্বাধীনতার পথে যাওয়ার বিতর্ক ও ভোটাভুটির পুরোটাই সভ্য, শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক আলাপ-আলোচনার মধ্যেই সীমিত থেকেছে। আর এ গণভোট একটি কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন তুলেছে যে বিশ্বায়িত এ পৃথিবীতে জাতীয় পরিচয়সত্তার প্রতি অনুগত থাকার শক্তি কতখানি? কিন্তু যা-ই ঘটে থাকুন না কেন, কোন রাজনৈতিক দল গণভোটে কারচুপির আশঙ্কা করেনি।’ স্কিম্যান এমনকি মন্তব্য করেন যে, ‘ইউক্রেনে যেমনটা সম্প্রতি দেখা গেছে সে রকম সীমান্তের ওপার থেকে এসে কেউ স্বাধীনতা বিরোধীদের হুমকি দিয়ে যায়নি।’
ঢাকাতেও স্কটল্যান্ডের গণভোট বিরাট আগ্রহ-উদ্দীপনার জন্ম দিয়েছে। তরুণ প্রজন্ম হয়তো সেখানে থেকে এই শিক্ষা নিতে পারে যে, একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা একটি জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মতোই অসামান্য তাৎপর্যপূর্ণ। প্রায় সমগোত্রীয় বৃটিশ ও স্কটিশরা স্বাধীনতার প্রশ্নে সঙ্কীর্ণ অর্থে বিভক্ত হয়ে পড়েনি। গণভোটের ফলের পরে স্বাধীনতাকামী তরুণরা বিষণ্ন বদনে বসে থেকেছে। কিন্তু তারা দাঙ্গা করেনি। দোকানপাট কিংবা গাড়িবাড়িতে আগুন দেয়নি। 
বাংলাদেশী পর্যবেক্ষকদের অনেকেই একমত যে, একটি বিশ্বাসযোগ্য ভোট ব্যবস্থা জাতীয় সঙ্কট উতরাতে সাহায্য করতে পারে। যা কোন বিদেশী বন্ধুত্ব বা সাহায্য নিশ্চিত করতে পারে না। যদি একটি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ভোট ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, তাহলে দেশের অখণ্ডতার মতো সিদ্ধান্তও সেখান থেকে লাভ করা সম্ভব। অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে দেশকে বিভক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকতে হয় না।
অবশ্য স্কটিশ স্বাধীনতাকামী নেতা স্যালমন্ড কেবল ভোটের রাজনীতি মানে সাংবিধানিক পথেই বিশ্বাসী ছিলেন। গণভোটের প্রশ্ন ছিল সোজা সাপ্টা- স্বাধীনতা চান কি চান না? ডেভিড ক্যামেরন জেনারেল ইয়াহিয়া খান হতে চাননি। ক্যামেরন সততার সঙ্গে বলেছেন, হে স্কটিশবাসী, তোমাদের ‘ছয় দফা’ আমি মানলাম। আমাদের সঙ্গে থাকলে তোমাদের স্বায়ত্তশাসন দেবো।      
স্বাধীন স্কটল্যান্ডের স্বপ্ন দেখেছিলেন তরুণ প্রজন্ম। তারা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছিলেন না। ছাত্র ধর্মঘটের মুখে তারা জনজীবন অচল করেননি। বেশির ভাগই প্রান্তিক মানুষজন, যেমন চাষি বা মৎস্যজীবী। নতুন রাষ্ট্র হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে কিছু অতিরিক্ত সুবিধা পেতেন তারা। আবেগপ্রবণ তরুণ প্রজন্মের কাছে আবার স্বাধীনতার স্বপ্নই সব চেয়ে দামি। কেউ বলেছেন, মাথা বনাম হূদয়ের লড়াইয়ে  প্রবীণদের হিসাবি পদক্ষেপই শেষ পর্যন্ত এত বড় তফাৎটা গড়ে দিল। এতটা ব্যবধান কেউ ভাবেনি। মোট ভোটারের ৫৫% আস্থা ঐক্যবদ্ধ বৃটেনে। স্বাধীনতার পক্ষে ভোট পড়েছে ৪৫%। রাজধানী এডিনবরায় না-পন্থিরা যে জিতবেন, তা স্পষ্টই ছিল। তেমনই ডান্ডি, গ্লাসগোয় স্বাধীনতার পক্ষেই যে বেশি ভোট পড়বে, তা-ও ছিল প্রত্যাশিত।
শহরের কেন্দ্রস্থলে ওয়েস্ট পার্লামেন্ট স্কোয়ার। সেখানে একটি ভাস্কর্যের মাথায় কে একটা স্কটিশ নীল পতাকা চাপিয়ে দিয়ে গিয়েছে। মূর্তির নিচের দিকে কেউ চক দিয়ে লিখে গিয়েছিল ‘ফ্রিডম ফ্রম দ্য টিরানি অব ওয়েস্টমিনস্টার’- ওয়েস্টমিনস্টারের দুঃশাসন থেকে মুক্তি চাই!
স্কটল্যান্ডবাসীই স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট দিয়ে বৃটেনের ৩০৭ বছরের জোট টিকিয়ে রাখলেন। আগের সমস্ত রেকর্ড ধুয়ে মুছে ভোট পড়ে প্রায় ৩৬ লাখ। যা মোট ভোটারের ৮৫ শতাংশ।
ফল বেরোনোর পর থেকেই যে প্রশ্নটা সব জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো, একুশ শতকে এভাবে স্বাধীনতার সুযোগ কেন হাতছাড়া করলেন স্কটল্যান্ডবাসী? ভোটের হিসাব বলছে, এ ঐতিহাসিক গণভোটে গ্রাম-শহরের ফারাক প্রকট হয়ে উঠলো আরও।
শহুরে মধ্যবিত্ত, যারা ইতিমধ্যেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত, কোনও রকম অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াতে রাজি নন তারা। তারা উঠতি মধ্যবিত্ত হলে ফলটা পাল্টে  যেতো। কোন ২২ পরিবার ছিল না। স্কটিশ জনসংখ্যার একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছেন বিদেশ থেকে আসা অভিবাসীরা। রয়েছেন অসংখ্য দক্ষিণ এশীয়। বাংলাদেশী  বংশোদ্ভূতরাও আছেন। স্বাধীনতার সঙ্গে একাত্মবোধ করার সুযোগ যেমন তাদের কম, তেমনই চেনা-পরিচিত কাঠামো ছেড়ে নতুনের সন্ধানে যাওয়াটাও বেশ ঝুঁকির।
বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন অটোনমি কার্ড খেলেছেন। স্কটল্যান্ড আলাদা হয়ে গেলে দায় ঘাড়ে নিয়ে হয়তো পদ ছাড়তে হতো তাকে। একাত্তরে ইয়াহিয়াকে গদি ছাড়তে হয়েছিল।  ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ক্যামেরন বলেন, “স্কটল্যান্ডবাসী রায় জানিয়েছেন। আমি খুশি। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আরও কাছাকাছি আসতে হবে আমাদের। স্কটল্যান্ডবাসীর কথা শুনেছি। এ বার ইংল্যান্ডের বাসিন্দাদের কথা শোনার সময় এসেছে।” ভবিষ্যতে কর, উন্নয়ন, অর্থব্যয় কিছু কিছু প্রশ্নে স্কটল্যান্ডের হয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সেখানকার পার্লামেন্ট। একই বিষয়ে এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকুক ইংল্যান্ড, উত্তর আয়ারল্যান্ড ও ওয়েলসের পার্লামেন্টেরও, চান ক্যামেরন।
স্কটিশ স্বাধীনতার নেতা অ্যালেক্স স্যামন্ড নিরবে হার স্বীকার করে নিয়েছেন। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার (স্থানীয় সরকারের প্রধান) এ অ্যালেক্স স্যামন্ড। ফল প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পরেই জানিয়ে দেন, মন্ত্রিত্ব থেকে ইস্তফা দিচ্ছেন। তার দল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) নেতা হিসেবেও পদত্যাগ করবেন তিনি। তার কথায়, “স্বাধীন স্কটল্যান্ডের জন্য প্রচার শেষ হয়নি। স্বপ্নের কখনও মৃত্যু হতে পারে না।” আগামী নভেম্বরে দলের জন্য যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজে পাওয়ার পরেই আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করবেন স্যামন্ড। তবে তারা হার থেকে শিক্ষা নেবেন না ইউরোপীয় অঞ্চল কাটালোনিয়া-র স্বাধীনতাকামী নেতা আর্তুর মাস। তিনি বলেন, স্পেনের প্রচণ্ড বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি আগামী ৯ই নভেম্বরে স্বাধীনতার জন্য গণভোটের ডাক দেবেন।
বৃটেনের অঙ্গহানি হচ্ছে না, এ খবর পাওয়া মাত্র তার প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। ইউরো আর ডলারের তুলনায় পাউন্ডের দাম বাড়তে থাকে হু হু করে। গত দু’বছরের মধ্যে পাউন্ডের দাম ইউরোর তুলনায় এতটা বেশি বাড়লো। জোট ভেঙে গেলে রয়্যাল ব্যাঙ্ক অব স্কটল্যান্ড তাদের মূল দপ্তর সরিয়ে নিয়ে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু এবার আর তার দরকার নেই, জানিয়ে দিয়েছেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। স্কটল্যান্ডবাসীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউরোপীয় কমিশনের সদস্যরা।

No comments

Powered by Blogger.