বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক- বড় আশা ছিল না, বড় হতাশাও নেই by এম হুমায়ুন কবির

দিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জেসিসি (জয়েন্ট কনসালটেটিভ কমিশন) বা যৌথ পরামর্শক কমিশনের সভা হলো। এই বৈঠকে দুদিক থেকেই নিজ নিজ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এটা তৃতীয় জেসিসি বৈঠক। এ কমিশন গঠিত হয়েছিল ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়। এটা একধরনের সহযোগিতা বিনিময়ের কাঠামো হিসেবে কাজ করে। সার্বিকভাবে দুই দেশের সম্পর্ককে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হিসেবে একে দেখা যায়।
জেসিসির এবারের সভায় যা হলো তাতে কয়েকটা বিষয় উল্লেখযোগ্য: প্রথমত, এ বৈঠক হলো দুই দেশেই নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর। গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বাংলাদেশে নতুন সরকার গঠিত হয় আর ভারতে নতুন নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকার প্রতিষ্ঠিত। অবশ্য বাংলাদেশের বেলায় সরকারের ধারাবাহিকতা থাকলেও ভারতে একেবারেই নতুন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের দিক থেকে আটজন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে বলা হয় বহুমুখী। এ ধরনের সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মন্ত্রণালয় জড়িত। তাই মন্ত্রণালয়ের সচিবদের উপস্থিতিতে কোনো সিদ্ধান্ত হলে তাঁরা এর অংশীদার হন। ফলে এর বাস্তবায়নে তা প্রভাব ফেলে। এটা ভালো পদক্ষেপ।
জেসিসির বৈঠকের পর দুই দেশের তরফে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়। এ বিবৃতিতে প্রায় ৩৬টি অনুচ্ছেদে অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে যেমন: নিরাপত্তা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সীমান্ত, জ্বালানি, নৌ ও সমুদ্র যোগাযোগ, শিল্প, মানবিক উন্নয়নসহ দুই দেশের বিরাজমান সব বিষয়ই আলোচনায় এসেছে। এগুলোকে বলা যায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের রুটিন রিভিউয়ের কর্মসূচি। তবে এবার কয়েকটা নতুন বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেমন: ভারত বাংলাদেশের পারমাণবিক প্রযুক্তি, মহাকাশসম্পর্কিত বিষয়, টেক্সটাইল, মেরিটাইম যোগাযোগ, সমুদ্রসীমা, ফিশারিজ এবং বহুল আলোচিত ব্লু ইকোনমি নিয়েও আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নিয়ে নতুন বাস্তবতায় এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হওয়া উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। ভারত যে এসব ক্ষেত্রে সহযোগিতা আদান-প্রদান করায় আগ্রহী, যৌথ বিবৃতিতে তার ছাপ রয়েছে।
এ ছাড়া উপকূলীয় নৌ–যোগাযোগ বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়েছে। অচিরেই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্রে জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ার আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর পরস্পরের দেশ সফর করার বিষয়েও কথা হয়েছে। দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষত ভারতে বাংলাদেশের পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধাগুলো দূর করতে ভারত আশ্বাস দিয়েছে। বাংলাদেশও ভারতকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দিতে আগ্রহী। এর আগে জাপান ও চীনকেও এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশ। একে তার ধারাবাহিকতা হিসেবেই দেখতে হবে। এ ধরনের অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগের জন্য হয়তোবা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে।
আমাদের জন্য আগ্রহের বিষয়গুলোর মধ্যে প্রধান হলো ভূসীমান্তবিষয়ক চুক্তি বাস্তবায়ন এবং তিস্তার পানিবণ্টনের চুক্তি। ভারত এর জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আমরা চাই বিষয়গুলোর দ্রুত সমাধান হোক। বাধাগুলো দূর করতে হবে ভারতকেই। যেমন ভূসীমান্ত চুক্তি, এটা বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন আছে। অথচ বিষয়টি অনেক দিন ধরে ঝুলে আছে। মনমোহন সিং সরকার গত বছর ডিসেম্বরে রাজ্যসভায় এ বিষয়ে একটা বিল উত্থাপন করে। সে সময় তৃণমূল কংগ্রেস এবং আসাম কংগ্রেস এর বিরোধিতা করে। বর্তমানে ক্ষমতাসীন কিন্তু তখনকার বিরোধী দল বিজেপিও নীতিগতভাবে সেই বিলের বিরোধিতা করেছিল। জেসিসির তৃতীয় বৈঠকের বিবৃতিতে এ বিষয়ে এটুকু বলা আছে যে মনমোহন সিংয়ের সে সময়ে করা চুক্তিগুলো অনুসমর্থনের (র্যাটিফাই) বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু বিস্তারিত বলা নেই যে বিষয়টি প্রক্রিয়ার কোন পর্যায়ে আছে এবং কোন সময়ের মধ্যে তা শেষ হবে। তাই আমরা যারা এ বিষয়ে দ্রুত সমাধানে আগ্রহী, তারা কিন্তু অন্ধকারেই রয়ে গেলাম।
তৃতীয় বিষয় হলো তিস্তার পানিবণ্টন। এ ক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ তাদের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। এই প্রত্যয় ব্যক্ত করা থেকে এ বিষয়ে আসলেই কোনো গতি আছে কি না, তা বোঝা যায় না। সুতরাং, এটা নিতান্তই আশ্বাস হিসেবে রয়ে গেল। তবে খেয়াল করার বিষয়, তিস্তার পানিবণ্টন প্রশ্নের সঙ্গে ভারত এবার ফেনী নদীর পানির বিষয়টি জুড়ে দিয়েছে। আমরা মনে করি, তিস্তার ইস্যু আলাদাই থাকা উচিত। এর সঙ্গে ফেনী নদীকে জুড়ে দিলে জটিলতা বাড়বে বৈ কমবে না। আমি বুঝতে পারছি না, দুটো নদীকে কেন একই ফ্রেমের মধ্যে আনা হলো।
ভারত নির্দিষ্টভাবে বলেছে, তারা নদী-সংযোগ প্রকল্প বিষয়ে বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কাজ করবে না। এটা ইতিবাচক দিক। অন্য আরেকটা বিষয়, যা দৈনন্দিনভাবেই ঘটছে, তা হলো সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা। এই ঘটনা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে দুই পক্ষই রাজি হয়েছে। কিন্তু অবাক বিষয় হলো, ওই একই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের যে জায়গায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়নি, সেসব জায়গায় কাঁটাতার দেওয়ায় বাংলাদেশও সম্মত। অতীতে বাংলাদেশ কখনোই এই বেড়া দেওয়াকে সমর্থন করেনি। আমরা মনে করি, এ ধরনের কাঁটাতার দুদেশের বন্ধুত্বের সহায়ক নয়। এখন হঠাৎ করে বাংলাদেশ কী কারণে ভারতের কাঁটাতার নির্মাণে রাজি হলো, তা বোধগম্য নয়। কোন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এটা মেনে নিল, সেটাও এক রহস্যের বিষয়।
দুদেশের সহযোগিতার আরেকটা নতুন ক্ষেত্র হলো বিসিআইএম বা ইকোনমিক করিডর। ভারত এ ব্যাপারে মোটামুটি নিস্পৃহতা দেখিয়ে আসছে। জেসিসি বৈঠকে আশা করা হয়েছে যে বিসিআইএমের পরের যে বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে এতে আরও গতির সঞ্চার হবে। বিসিআইএমের অগ্রগতির জন্য ভারতের দিক থেকে আরও উদ্যোগের দরকার হবে। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে তার বিশেষ আগ্রহের কথা বরাবরই বলে এসেছে। দুদিন আগে ভারত সফরে এসে চীনের প্রেসিডেন্টও অগ্রগতির আশা করেছেন। কিন্তু ভারত এ ব্যাপারে এখনো বিশেষ উদ্যোগী নয়।
জেসিসি বৈঠকের ঘোষণার সারাংশ হিসেবে বলা যায়, যে বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের আগ্রহ আছে, সেসব বিষয় যৌথ বিবৃতিতে এক বা দুই কথায় সংক্ষেপে এসেছে। এগুলো আরও বিশদভাবে আসা উচিত ছিল। আর ভারতের আগ্রহের কানেক্টিভিটি, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে বিশদভাবে বলা আছে। যেহেতু বৈঠকটা দিল্লিতে হয়েছে, সেহেতু ধরে নেওয়া যায় ভারতীয়রা এই বিবৃতির খসড়া তৈরি করেছে। সুতরাং তাদের আগ্রহের বিষয় সেখানে প্রাধান্য পাবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলার আছে যে এই বৈঠকের ফল উল্লেখযোগ্য বা ব্রেক থ্রু মনে হয়নি। এবারের বৈঠকে বড় কিছু প্রত্যাশা যেহেতু ছিল না, সেহেতু বড় হতাশাও নেই।
তবে, যেখানে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার এ বৈঠক থেকে লাভবান হয়েছে, সেটা হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লিতে থাকা অবস্থায় ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পানিসম্পদমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা। তাতে বর্তমান সরকারের অবস্থান তুলে ধরার সুযোগ পাওয়া গেল। আমি মনে করি, এতে করে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের লাভ হলো। আর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের দিক থেকে বলতে গেলে, এ ধরনের যেকোনো আলোচনাই দুদেশের মধ্যে বোঝাপড়া শক্তিশালী করে। তবে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের বিষয়গুলো আরও গুরুত্ব পেলে ভালো হতো, কারণ সেটাই প্রত্যাশিত।
সব দেশই তো নিজের স্বার্থের পরিপ্রেক্ষিতে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে। সুতরাং, আমাদের স্বার্থ আমাদেরই সংরক্ষণ করতে হবে। ভারত আমাদের তিন দিক বেষ্টন করে রয়েছে। ভারতের সঙ্গেই আমাদের থাকতে হবে, এটা বাস্তবতা। ভারতের অর্থনৈতিক উত্থানের সঙ্গে আমাদের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে সহযোগিতা করলে আমাদেরই লাভ। বাংলাদেশের স্বার্থকে যদি ভারতের কাছ থেকে আদায় করতে হয়, তাহলে আমাদেরও জাতীয় স্বার্থের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এ ব্যাপারে সব দল ও অংশভাগীদের মধ্যে জাতীয় সমঝোতা জরুরি। জাতীয় ঐক্য ছাড়া এ ধরনের সহযোগিতায় কাঙ্ক্ষিত ফল আসে না।
চীনের প্রেসিডেন্ট যেদিন ভারতে গিয়েছেন, সেদিনই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা সেই ডামাডোলের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হলো। এতেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ-ভারত যোগাযোগ কী পরিমাণ অসম। এ জন্যই আমাদের জাতীয় অবস্থানের যতগুলো শক্তিশালী দিক আছে, সেগুলোর চূড়ান্ত ও নিষ্ঠাবান ব্যবহারে আরও মনোযোগী হওয়া উচিত। ভারত একই সঙ্গে আমাদের জন্য সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ। কোনটা প্রাধান্য পাবে, তা নির্ভর করবে বাংলাদেশের সরকারগুলোর জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার ওপর। তা না করে যদি কোনো ক্ষুদ্র ও গোষ্ঠীস্বার্থকে সামনে আনি, তাহলে জাতীয় স্বার্থ প্রাধান্য পাবে না। তাতে আমাদের ক্ষতি হবে।
এম হুমায়ুন কবির: কূটনীতিক, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।

No comments

Powered by Blogger.