অনিশ্চয়তায় অর্ধলক্ষ শিক্ষার্থী by নুর মোহাম্মদ

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) গাফিলতিতে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধলক্ষ শিক্ষার্থী। সমপ্রতি ১২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮টি শাখাকে কালো তালিকাভুক্ত করার পর সেখানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মাঝে এ অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ইউজিসির তালিকায় ৪৮টি শাখা থাকলেও প্রকৃত সংখ্যা ১৮৯টি। এই পরিস্থিতির জন্য মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সদিচ্ছার অভাবকেই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে অতীতে সব ব্যর্থতা থেকে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করে। শিক্ষার্থী ও অভিভাকরা বলছেন, আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখেই এ সব শাখায় ভর্তি করিয়েছি। এগুলো অনুমোদন নেই সরকার তো আগে বলেনি। সেখানে অধ্যয়নরত এসব শিক্ষার্থীর দায় কে নেবে? এমন প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রী  বলছেন, কতিপয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে আর সনদ বাণিজ্য করতে দেয়া হবে না। শিক্ষার্থীদের বাঁচাতেই আমাদের এই উদ্যোগ। অন্যদিকে এটাকে গা-বাঁচানোর অজুহাত আখ্যা দিয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব অপকর্ম হতো তা উন্মোচন করার পর মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি নিজেদের দায় সারাতে শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে। তারা বলছেন, টিআইবি’র অভিযোগগুলো গত কয়েক বছর সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও ঘুম ভাঙেনি সংশ্লিষ্টদের। তাদের দাবি, ইউজিসি’র এই সতর্কতা জারি আসলে কোন লাভ হয়নি। কারণ গত কয়েক দিনে ধরে এসব বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকায় নানা চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে শিক্ষার্থী টানার চেষ্টা করছে। এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সার্বিক কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে ‘মাথা ব্যথা বলে মাথা কেটে ফেলার অ্বস্থা।’ এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, এটি বলতে দ্বিধা নেই যে, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেপরোয়া হওয়ার পেছনে সরকারই দায়ী। কারণ, সঠিক সময়ে সরকার তাদের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এ কারণে তার আজ ইউজিসির বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে সাহস পায়। তিনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় আদালতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপকর্ম সঠিকভাবে উপস্থাপন না করায় বারবার তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। আদালতে সঠিক তথ্যটি উপস্থাপন করতে না পারলে আদালত ন্যায়বিচার করবে কিসের ভিত্তিতে। এ মামলাগুলো পরিচালনার জন্য ইউজিসির আইন শাখাকে আরও গতিশীল করার তাগিদ দেন তিনি। ইউজিসির সাবেক সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, গণবিজ্ঞপ্তিটি আক্ষরিক অর্থে সঠিক হলেও এটি কোন স্থায়ী সমাধান না। সরকার ইচ্ছা করলেই এক মাসের মধ্যে এই মামলাগুলোকে একটি পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু কে করবে এ কাজ? কারণ মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির অনেক কর্মকর্তা এ বাণিজ্যের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। আদালতের ‘স্টে অর্ডার নিয়ে সনদ বাণিজ্য, অননুমোদিতভাবে ক্যাম্পাস পরিচালনা, অবৈধ ক্যাম্পাস খুলে সনদ বাণিজ্য, অনুমোদনহীন কোর্স ও কারিকুলামে পাঠ্যদান, মালিকানা দ্বন্দ্ব, ট্রাস্টি বোর্ডে বিভক্তি ইত্যাদি কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশতাধিক মামলা চলছে উচ্চ আদালত ও নিম্ন আদালতে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা করে সার্টিফিকেট বিক্রি অভিযোগ রয়েছে এই ইউনিভার্সিটিগুলোর বিরুদ্ধে। এসব কারণে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সতর্ক হওয়া পরামর্শ দিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ইউজিসি। শিক্ষামন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, দেশে ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ১৫টির বিরুদ্ধে ‘শিক্ষা-বাণিজ্য’ করার অভিযোগ রয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির মওসুম শুরু হয়েছে। এই সময়টি কাজে লাগাতে পুরো ব্যস্ত সনদবিক্রিধারী এসব বিশ্ববিদ্যালয়। এ সময়টাকে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে সরকারও একটি দায়সারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে পত্রিকায়। এ বিষয়ে তারেক শামসুর রেহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে এই বিজ্ঞাপন তো আর স্থায়ী সমাধান না। সরকারকে স্থায়ী সমাধান অর্থাৎ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নিতে হবে। মন্ত্রণালয় তথ্যমতে, বর্তমানে ১৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১টি মামলা হাইকোর্টে রয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি রিট পিটিশন। ৮টি মামলা নিম্ন আদালতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্য আরেকটি সূত্রের দাবি, বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত মামলা ৪৫টি। এর মধ্যে প্রাইম ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, দারুল ইহসান, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, বিজিসি ট্রাস্ট, নর্দার্ন, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মামলা চলছে। অন্যদিকে ইউজিসি কর্মকর্তা বলছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাদেরকে কাজ করতে দিচ্ছে না। মামলা সংত্রুান্ত বিষয় দ্রুত নিষ্পত্তি করতে বারবার তাগিদ দিলেও বরাবর নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে মন্ত্রণালয়। সুপারিশ করা ছাড়া এই মুহূর্তে  ইউজিসির আর কাজ নেই। এই অবস্থায় মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির রশি টানাটানিতে চরম অনিশ্চতায় পড়েছেন এসব ক্যাম্পাসে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা। মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) ড. আতফুল হাই শিবলী জানান, আদালতের স্টে অর্ডার নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালালেও নতুন করে শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যাপারে কোন অর্ডার দেয়নি আদালত। আমাদের উদ্যোগের কারণে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ অথবা ভর্তি কার্যত্রুম বন্ধ রয়েছে বলেও দাবি তার।

No comments

Powered by Blogger.