সুখ-দুঃখের চট্টগ্রাম বন্দর, তুমি কার? by সোহরাব হাসান

আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দাবি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চরম ঝুঁকি নিয়েও জাতীয় স্বার্থে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেন না। এ প্রসঙ্গে তাঁরা প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের মুখের ওপর গ্যাস রপ্তানির প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ার উদাহরণ দেন। কিন্তু সব ক্ষেত্রে যে শেখ হাসিনা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না কিংবা নিলেও সেটি জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যায় না, চট্টগ্রাম বন্দরই তার প্রমাণ।
শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় বেসরকারি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য অখ্যাত মার্কিন কোম্পানি এসভিডর সার্ভিসেস এজেন্সিকে (এসএসএ) ১৯৯ বছরের লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের মেয়র ও আওয়ামী লীগের নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে বড় ধরনের আন্দোলন হয়। তখন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অপর নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী এসএসএর পক্ষে ছিলেন। সেই আন্দোলনে চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিক, প্রগতিশীল লেখক-বুদ্ধিজীবী এবং জাতীয় তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষার জাতীয় কমিটি সক্রিয় ছিল।
আন্দোলনের মুখে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি লিজের মেয়াদ কমিয়ে প্রথমে ৯৯ বছর এবং পরে ৩৩ বছর করে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তাও মেনে নেয়নি। একপর্যায়ে বন্দরের ২২টি শ্রমিক সংগঠন জাতীয় স্বার্থে সরকারের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে রিট করলে আদালত সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করেন। বাদীদের পক্ষে ড. কামাল হোসেন এই মামলাটি লড়েছিলেন। ১৩ সেপ্টেম্বর আলাপ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম জানান, এসএসএকে টার্মিনাল নির্মাণের দায়িত্ব দিলে দেশের সর্বনাশ হয়ে যেত।

এসএসএর গল্প এখানে শেষ হলেও নিউমুরিং টার্মিনালের গল্প শেষ হয় না।

৫৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এখন ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর। কিন্তু কী পদ্ধতিতে টার্মিনাল ব্যবহার করা হবে, সে বিষয়ে গত সাড়ে পাঁচ বছরেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি আওয়ামী লীগ সরকার।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নৌপরিবহন উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিন সাইফ পাওয়ার টেক নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষামূলকভাবে অপারেশনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেই ব্যবস্থা এখনো চলছে। টার্মিনালের পাঁচটি জেটির মাত্র দুটি আংশিক ব্যবহৃত হচ্ছে। এ নিয়ে তখনই প্রশ্ন ওঠে।
প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, বন্দর কর্তৃপক্ষ যন্ত্রপাতি কিনে দেবে, না ঠিকাদারকে তার দায়িত্ব দেবে, তা নিয়ে সরকারের ভেতরেই দুই মত। ২০০৮ সালে দরপত্রের মাধ্যমে চারটি বিদেশি অপারেটরকে নির্বাচিত করা হলেও ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদীয় কমিটির সুপারিশে বন্দর কর্তৃপক্ষ তা বাতিল করে দেয়। এরপর দফায় দফায় প্রাক্যোগ্যতার দলিলপত্র সংশোধন করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ার টেক ও বিদেশি পিএসএ ইউরোপ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়। ২০১২ সালে ৩০ আগস্ট দ্বিতীয় দফায় মূল দরপত্রে পাঁচটি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। একই সময়ে দরপত্রের শর্ত সংশোধন ও বিলোপ করে দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার চেষ্টা হয়। এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দাবি, লবি ও মামলায় আটকে আছে সিদ্ধান্ত।
বিগত সরকারের (২০০৯–১৩) আমলে নৌপরিবহনমন্ত্রী, সংসদীয় কমিটি ও বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে যন্ত্রপাতি কিনে টার্মিনাল ব্যবহারের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেয়। কিন্তু দশম সংসদে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি বদল হলে তারা যন্ত্রপাতি কেনার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। তাদের যুক্তি, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতিতেই টার্মিনাল ব্যবহার করে বন্দর কর্তৃপক্ষ অধিক সুবিধা পাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বিদেশি অপারেটরকেই যন্ত্রপাতি কেনাসহ অপারেশনের সমুদয় দায়িত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী। তিনি বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করেছেন বলে শুনেছি। এই দরপত্র এখনই বাতিল করা উচিত।’
অন্যদিকে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান প্রধানমন্ত্রীর দোহাই দিয়ে তাঁর অবস্থানে অনড় আছেন। আসলে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে সরকারের মধ্যেই বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের রশি টানাটানি চলছে। নৌপরিবহনমন্ত্রীর সঙ্গে চট্টগ্রামের একাধিক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী আছেন। আছেন ব্যবসায়ী নেতাদের একাংশ। অন্যদিকে সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী বন্দরের নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই অন্যের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিরোধী। বন্দরের অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠন তাঁর সঙ্গে আছে। হজে যাওয়ার আগে মহিউদ্দিন চৌধুরী লালদীঘিতে জনসভা করে আন্দোলনের আগাম ঘোষণা দিয়ে ছিলেন। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সামনে রেখে তিনি বন্দর রক্ষার আন্দোলন করে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে চান। অন্যদিকে প্রতিমন্ত্রী সাইফুদ্দিন চৌধুরীসহ চট্টগ্রামের অধিকাংশ সাংসদ চান না, বন্দরের কাজে মহিউদ্দিন চৌধুরীর হস্তক্ষেপ বাড়ুক।
ফলে বন্দর নিয়ে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতি ফের সরগরম হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সংগঠন একে অপরের বিরুদ্ধে বিবৃতি–পাল্টা বিবৃতি দিচ্ছে। এক পক্ষের যুক্তি হলো বন্দর কর্তৃপক্ষকে যন্ত্রপাতি কেনার দায়িত্ব দেওয়া মানে চুরি ও অপচয়। অন্য পক্ষের সাফাই, বিদেশি অপারেটরদের যন্ত্রপাতি কেনার দায়িত্ব দিলে সেবাপ্রার্থীদের খরচ বাড়বে, বন্দরের আয় কমবে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী নেতার বক্তব্য হলো চট্টগ্রাম বন্দর একটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের সেবা যঁারা নেন অর্থাৎ আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের মতামত সরকার কখনোই নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। কে কীভাবে অপারেট করল, সেটি আমাদের দেখার বিষয় নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সমুদ্রবন্দরগুলো যে পদ্ধতিতে চলে, আমাদের এখানেও সে পদ্ধতিতে চলতে হবে। ব্যবসায়ীরা চান দ্রুত ও উত্তম সেবা। সরকার সেটি দিতে পারলে ব্যবসায়ীরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি দেশও। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে। আর রাজনীতি নয়। বন্দরের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের যে সক্ষমতা আছে, তার ৭০ ভাগ ব্যবহার করা হচ্ছে। বাকি ৩০ ভাগই অব্যবহৃত থেকে যাচ্ছে।
বন্দর রক্ষার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের সরকারগুলো বিদেশের সঙ্গে চুক্তি কিংবা অপারেটর নিয়োগে সব সময় ঢাক ঢাক গুড় গুড় ভাব দেখায়। বিষয়টি সংসদে বা অন্য কোনো ফোরামে আলোচনা করে না। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে যা চলছে, তা হলো মাফিয়া চক্রের দৌরাত্ম্য। সবাই ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত সুবিধার পেতে উদ্গ্রীব। কিন্তু তারা দেশ ও জনগণের স্বার্থের কথা ভাবে না।
আমরা বিশ্বায়নের কথা বলি। গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু যে বন্দরটি দেশের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি, সেই বন্দরটি পরিচালনায় কর্তৃপক্ষ যে পদে পদে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, তার প্রতিকার কী? তারা বন্দরের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায় যত আগ্রহী, বন্দর ব্যবহারকারীদের সেবা বাড়ানোর ব্যাপারে ততই নিষ্ক্রিয়। এ অবস্থায় দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটি চলতে পারে না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.