মাদকের কবলে রাজধানীর দুই লাখ পথশিশু : জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে

মাদকের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে রাজধানীর প্রায় দুই লাখ কোমলমতি পথশিশুর জীবন। এসব পথশিশু গাঁজা, হেরোইন, ফেনসিডিল, ড্যান্ডি, ইয়াবা, পেথিডিন এমনকি সিসার মতো ক্ষতিকর মাদক গ্রহণ করছে প্রতিনিয়ত। ঠিকানাবিহীন পথশিশুরা সারাদিন কাগজ কুড়িয়ে, বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা- করে ও বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে যে পারিশ্রমিক পায় তা দিয়ে চলে এদের মাদক সেবন। নিজে সেবনের পাশাপাশি মাদক বিক্রির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু। এদের অধিকাংশের বয়স আঠারো বছরের কম। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এসব শিশু জড়িয়ে পড়ছে এ ধরনের অপকর্মে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
মাদকাসক্ত এসব পথশিশুকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।
স্বপ্ন ছাড়া বাঁচে কয়জন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অথচ আমাদের পাশেই অনেক শিশু রাস্তায় অসহায়ের মতো পড়ে আছে যারা স্বপ্ন কী জানে না। স্বপ্ন না দেখা এসব পথশিশু সাধারণত বাবা-মায়ের অবাধ্য সন্তান ও বাবা-মার বহু বিবাহ, মৃত্যু, সৎ মা-বাবা, ভূমিহীন হওয়া, আর্থিক সংকটসহ বিভিন্ন কারণে তারা আজ পথশিশু। এমন অনেক মুখ আছে সমাজের পথে-প্রান্তরে, আনাচে-কানাছে তাদের দেখা মেলে। বিশেষ করে বাস টার্মিনাল, রেলস্টেশন ও হাট-বাজারে এদের আনাগোনা বেশি। আবার কেউ কেউ সারাদিন ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের কাজে নিয়োজিত থাকে। হোটেলের বয়, কুলি, গাড়ি ধোয়া-মোছা, ফুল বিক্রি, ভাসমান যৌনকর্মী ও মাদক বহনসহ চুরি ছিনতাই করা এদের মূল পেশায় পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি সমাজের মানুষের দ্বারা নিগৃহীত হওয়ায় এসব শিশু হতাশাগ্রস্ত। এসব কারণে তারা নেশাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানা যায়।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও মোস্ট অ্যাট রিস্ক এডোলসেন্ট (এমএআরএ) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১২ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে চার লাখ ৪৫ হাজার পথশিশু আছে। এদের মধ্যে রাজধানীতে তিন লাখেরও বেশি পথশিশু বসবাস করছে। তবে সরকারি হিসাব মতে, বর্তমানে রাজধানীতে দুই লাখের মতো পথশিশু রয়েছে বলে জানা যায়। এসব পথশিশুর মধ্যে শতকরা ৮৪% ছেলে আর ১৬% মেয়ে। ঢাকায় বসবাসরত অধিকাংশ পথশিশু মাদকাসক্ত বলে বিবিসির এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
রাজধানীসহ সারা দেশের প্রতিটি অলি-গলি এমনকি বস্তিগুলোতে মাদকে ছেয়ে গেছে। সরজমিন দেখা যায়, রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা পথশিশুদের জন্য মাদকের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে কমলাপুর রেলস্টেশন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম চত্বর, সদরঘাট লঞ্চ ও বিভিন্ন বাস টার্মিনালসহ রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মাদকাসক্ত শিশু-কিশোর হরহামেশাই চোখে পড়ে। এমনকি আট থেকে বারো বছর বয়স্ক শিশুদের রাস্তায় প্রকাশ্যেই বিভিন্ন মাদকদ্রব্য সেবন করতে দেখা যায়। এসব মাদকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ গাঁজা, ফেনসিডিল, ড্যান্ডি, ইয়াবা, হেরোইন, পেথিডিন ও সিসা। সাম্প্রতিক সময়ে এসব শিশুর কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে ড্যান্ডি নামক এক ধরনের মাদকদ্রব্য।
ড্যান্ডি একধরনের আঠা যা মূলত সলিউশন নামে পরিচিত। এতে টলুইন নামে একটি উপাদান আছে। টলুইন মাদকদ্রব্যের তালিকায় আছে। এটি জুতা তৈরি ও রিকশার টায়ার টিউব লাগানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি খেলে ক্ষুধা ও ব্যথা লাগে না। অনেক পথশিশুকেই পলিথিনে মুখ লাগিয়ে প্রকাশ্যে ড্যান্ডি সেবন করতে দেখা যায়। দীর্ঘমেয়াদে ড্যান্ডি সেবন করলে মস্তিস্ক, যকৃত ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া পথশিশুদের কাছে গাঁজা একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাসস্থানহীন এসব শিশুকে সন্ধ্যার পর একসঙ্গে মিলে বিভিন্ন এলাকায় গাঁজা সেবন করতে দেখা যায়। শুধু বস্তি বা পথশিশুই নয়, মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের অনেক শিশুরা।
অপরদিকে দেখা গেছে, রাজধানীর বনানী, গুলশান, ধানম-িসহ বেশ কয়েকটি খাবারের দোকানের আড়ালে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ইয়াবা, ফেনসিডিল ও সিসা গ্রহণ করে। ছেলেশিশুদের পাশাপাশি বহু মেয়েশিশুকে মাদকে আসক্ত হতে দেখা যায়। তবে এর সংখ্যা সবার কাছে অজানা।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ১৯নং ধারায় বলা হয়েছে, শিশুদের যে কোনো ধরনের অনাচারের কবল থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। শিশুদের নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকার অধিকার জন্মগত। সে হিসেবে মাদকদ্রব্য গ্রহণ সম্পূর্ণ বেআইনি। তারপরও এই শিশুদের রাষ্ট্র অনেকাংশেই রক্ষা করতে পারছে না।
ঢাকার মানিকগঞ্জে আপন নামে বেসরকারি এনজিওর আওতায় মাদকাসক্ত শিশুদের বিনামূল্যে সেবা দিতে একটি নিরাময় কেন্দ্র থাকলেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পথশিশুদের জন্য কোনো মাদকদ্রব্য নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারিভাবে ৪টি মাদকদ্রব্য নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। তবে পথশিশুদের জন্য এসব নিরাময় কেন্দ্রে মাত্র ১০টি শয্যা রয়েছে বলে জানা যায়। অপরদিকে বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকাসহ সারা দেশের ২৬টি জেলায় ১ হাজার ১১৫ শয্যাবিশিষ্ট ৯০টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয় সরকার। ঢাকায় রয়েছে ২৪টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র। বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠান মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। অভিভাবকহীন এসব পথশিশুর মাদক সেবন নিয়ন্ত্রণে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি কোনো নিরাময় কেন্দ্র।
দেখা যায়, পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে অনেক এনজিও। এসব পথশিশু নিয়ে জানা-অজানা বহু এনজিও বছরের পর বছর কাজ করলেও প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি মাদকাসক্তের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের যথাযথ তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পথশিশু-কিশোর হিসেবে যারা ছোটকাল থেকে মাদকাসক্ত হয়ে উঠছে তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। রাজধানীতে বিভিন্ন সময়ে মানুষ খুন করা, চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ নানান অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িয়ে পড়ছে এসব পথশিশু। ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বিনিময়ে রাজনৈতিক মিছিলেও প্রতিনিয়ত ব্যবহার হচ্ছে এসব পথশিশু।
সমাজবিজ্ঞানী ড. মাহবুব উদ্দীন আহমেদ বলেন, পথশিশু ভোটার নয়। তাই রাজনৈতিকভাবে এসব শিশুর কোনো মূল্য রাষ্ট্রের কাছে নেই। সামাজিকভাবেও এরা বিবর্জিত গোষ্ঠীর সন্তান। ফলে সমাজও তাদের এড়িয়ে চলতে চায়। তিনি বলেন, পথশিশুদের মধ্যে শৈশবে নানানভাবে নির্যাতিত, যৌন হয়রানি ইত্যাদির শিকার হওয়ায় বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসার সংখ্যাই বেশি। আবার কিছু শিশুর জন্মই হয় পথে। এদের বেশিরভাগই বিপথে থাকা বড়দের কবলে পড়ে মাদকাসক্ত হয়। তবে তাদের ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই।
চিকিৎসা পুনর্বাসন প্রকল্পের পরিচালক (মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর) আবুল হোসেন বলেন, পথশিশুদের মাদক নিরাময় করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ বছর মাত্র ১০টি শয্যা চালু হয়েছে। তবে এই উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। কিন্তু এসব শিশুদের সংশোধন ও পুনর্বাসনের জন্য বিনামূল্যে সরকারি বা বেসরকারি কোনো পক্ষ থেকেই কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছি শয্যা পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আতোয়ার রহমান বলেন, বাংলাদেশে কতো শিশু মাদকাসক্ত তার পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। তবে পথশিশুদের মাদকাসক্তি থেকে ফিরিয়ে আনতে অধিদপ্তরে শিশুদের আলাদা একটি ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। সেখানে তাদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কাজ চলছে।

No comments

Powered by Blogger.