হাজারো মানুষের নিরন্তর অপেক্ষা

গাজার বাসিন্দা মোহাম্মেদ আল নাজার অনেক শখ করে একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন পরিবারের সবাই মিলে হাত-পা ছড়িয়ে থাকবেন সেখানে। কিন্তু ইসরায়েলের হামলায় গুঁড়িয়ে গেছে তাঁর স্বপ্নের বাড়ি। বড় পরিবার নিয়ে এখন একটি কুঠুরির মধ্যে গাদাগাদি করে থাকেন তাঁরা।

গাজার এমন অনেক পরিবার এভাবে বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বাস করছেন। হাজারো মানুষের চলছে নিরন্তর অপেক্ষা—কবে নতুন করে গড়ে উঠবে বাড়ি, কবে ফিরবে সেই স্বাভাবিক জীবন।
আজ বৃহস্পতিবার এএফপিতে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ইসরায়েলে আট বছর ধরে চলা অবরোধে বসতি নির্মাণের সামগ্রী গাজায় আসে না। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় একের পর এক ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হলেও এ অবরোধের কারণে ধ্বংস হওয়া ভবন আর গড়ে ওঠেনি। এতে গাজায় পুনর্বাসনকাজ এখন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ৬০ বছর বয়সী নাজ্জার সাই বলেন, অস্থায়ী হিসেবে পাওয়া আশ্রয়কেন্দ্র এখন স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আতঙ্কে আছি যে গাজার অবরোধ কোনোদিনও উঠবে না। ইসরায়েল আমাদের বসতি নির্মাণের জন্য কোনো সামগ্রী দেবে না।’
গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনুস শহরের কাছে খুজানা এলাকায় অস্থায়ী ওই আশ্রয়কেন্দ্রে মাত্র দুটি ঘর। সেখানেই গাদাগাদি করে ছয়জনকে নিয়ে থাকেন নাজ্জার সাই। সবাই মিলে একটি ছোট রান্নাঘর আর শৌচাগার ব্যবহার করেন।
তবু নিজেদের অন্যের তুলনায় সৌভাগ্যবান মনে করেন নাজ্জার সাই। কারণ অন্য গৃহহীনরা এর চেয়েও করুণ অবস্থায় রয়েছেন।
গত জুলাই থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত চলা ইসরায়েলের হামলায় গাজার ১৮ হাজারের বেশি বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। কয়েকটি ত্রাণ সংস্থা গাজায় গৃহহীনদের জন্য ১০০টি মোবাইল ঘর নির্মাণ করে দিয়েছে। কিছু অস্থায়ী স্কুলও নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে পুনর্বাসন আদৌ সম্ভব কি না—এ নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র আদনান আবু হাসনা বলেন, ২০০৬ সাল থেকে ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় স্টিল, সিমেন্ট বা কংক্রিট আসে না। এই অবরোধ না তুললে গাজা পুনর্বাসন করতে আরও ১০ বছর সময় লাগবে।
ফিলিস্তিনের কর্মকর্তারা জানান, যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুসারে ইসরায়েল গাজায় নির্মাণসামগ্রী পাঠানোর ব্যাপারে তাদের নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু এতে খুব সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে।
নাজ্জার সাইয়ের মতো আরেক হতভাগ্য হলেন গাজার পূর্বাঞ্চলে শেজায়া শহরের বাসিন্দা সুহেলা মোহাম্মেদ। স্বামী, শিশু ও নাতি নাতনিদের নিয়ে ছোট একটি তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছেন। সুহেলা বলেন, অনেক স্বপ্ন নিয়ে ১০ বছর ধরে আমরা একটি বাড়ি করেছিলাম। কিন্তু আমাদের শিশুরা সেখানে থাকতে পারেনি।
সাধের বাড়ির পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষের পাশে দাঁড়িয়ে সুহেলা বলেন, ‘এই ঘর আবার গড়ে ওঠার আগেই আমি মারা যাব।’
নিজের বিধ্বস্ত বাড়ির সিঁড়ির কাছে ঘুমাতে হয় শোকরকে। তিনি বলেন, হামলায় বিধ্বস্ত তাঁর বাড়ি আবার ঠিক করতে আট বছরের বেশি সময় লাগবে। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘এই আট বছর আমরা কোথায় থাকব? আমাদের কোনো খাবার নেই। পানি নেই। এমনকি বিদ্যুৎও নেই।’
জাতিসংঘের শান্তিবিষয়ক দূত রবার্ট শেরি বলেন, গত মঙ্গলবার ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সে অনুসারে নির্মাণসামগ্রী গাজায় আসতে পারে। পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থিত ফিলিস্তিনের সরকার জানায়, তারা এই চুক্তি কার্যকর করতে কাজ করে যাচ্ছে।
রামাল্লা ভিত্তিক প্যালেস্টাইন ইকোনমিক কাউন্সিল ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিকনস্ট্রাকশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যদি গাজা থেকে এখন অবরোধ তুলেও নেওয়া হয় তাহলে পুনর্বাসনকাজে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লাগবে। খরচ হবে ৭৮০ কোটি ডলার।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র আবু হাসনা বলেন, অবরোধ তুলে নিতে ইসরায়েল যত বেশি সময় পার করবে, গাজার গৃহহীনদের হতাশাও তত বাড়বে।

No comments

Powered by Blogger.