চাকরি হারানোর শঙ্কায় লাখো বাংলাদেশী -এমআরপি জটিলতা by দীন ইসলাম

চাকরি হারানোর শঙ্কায় রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ওমান, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় কর্মরত অর্ধ কোটি প্রবাসী বাংলাদেশী কর্মী। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একরোখা মনোভাবের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে এসব দেশে বসবাসকারী শ্রমিকরা মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) দেখাতে ব্যর্থ হলে তাদের দেশে ফিরতে হবে। এছাড়া, বিশ্বের অন্যান্য দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও ২০১৫ সালের মধ্যে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট তুলে দিতে হবে। এমন বাস্তবতায় এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাতটি দেশে অবস্থিত ১০টি মিশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য আলাদা উইং স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে- সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও আবু ধাবি, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, ওমানের মাস্কট, কাতারের দোহা, কুয়েতের কুয়েত সিটি, সিঙ্গাপুরের সিঙ্গাপুর সিটি এবং ইতালির রোমে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন। ইতিমধ্যে এ সংক্রান্ত সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়েছে। এরপরও নিজেদের গুরুত্ব কোনভাবেই কমতে দিতে রাজি নয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বাদ সাধতে তৎপর তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশী শ্রমিকবেষ্টিত দেশগুলোতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উইং স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটার বিরোধিতা করে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করছে। এটার বাস্তবায়ন তাড়াতাড়ি না করলে বাংলাদেশী শ্রমিকরা সমস্যার মুখে পড়বেন। অনেকের চাকরিও চলে যাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত সৌদি আরবে ২৬ লাখ ৩৬ হাজার ৭৭৫ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৩ লাখ ১৮ হাজার ৪৫৭ জন, কুয়েতে চার লাখ ৮১ হাজার ৩৬২ জন, মালয়েশিয়ায় সাত লাখ আট হাজার ৪৪২ জন, সিঙ্গাপুরে পাঁচ লাখ ২১ হাজার ৭৩৫ জন, ওমানে নয় লাখ ১৩ হাজার ৫৬০ জন ও কাতারে তিন লাখ ২০ হাজার ৪৫৬ জন শ্রমিক গিয়েছেন। এসব দেশের অর্ধ কোটি শ্রমিক এখনও মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) পাননি। এমআরপি দিতে সরকারি পর্যায়ে যেসব তৎপরতা চলছে তাও আশানুরূপ নয়। এমন অবস্থার মধ্যেও নিজেদের কর্তৃত্ব খর্ব হয়ে যাবে- এমন শঙ্কায় বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য আলাদা উইং বসতে দিতে চাইছে না পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এনিয়ে গত ১৬ই সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোজাম্মেল হক খানের সভাপতিত্বে প্রবাসী বাংলাদেশী নাগরিকদের এমআরপি ও এমআরভি প্রদানসহ কনস্যুলার সেবা প্রদানের বিষয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ছয় জন কর্মকর্তা অনুমোদনকৃত উইং স্থাপন প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। পাশাপাশি গত ২১শে সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনকৃত উইং স্থাপনের বিরোধিতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে একটি চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) এম. আল্লামা সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর জন্য শ্রমঘন ২৬টি মিশনে অতিরিক্ত কন্স্যুলার সহকারীর ৫৮টি পদ সৃজন করা হয়েছে। এতে বহির্বিশ্বে কন্স্যুলার পরিসেবা প্রদানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী ভূমিকার আইনগত স্বীকৃতি ঘটেছে। এছাড়া, মিশনগুলোতে স্থানীয় ভিত্তিক জনবল বাড়ানো এবং মন্ত্রণালয় বা মিশনগুলোর শূন্যপদ পূরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রয়োজন ভিত্তিক বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা নেয়া হয়েছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরও ১০টি মিশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য আলাদা উইং স্থাপনের বিরোধিতায় মেতেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আউটসোর্সিং-এর মাধ্যমে এমআরপি ও এমআরভি’র মতো স্পর্শকাতর দায়িত্ব দিতে চায় তারা। তবুও কোন মতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলাদা উইং স্থাপনের বিরোধিতা করছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, সারা বিশ্বে ২০১৫ সালের মধ্যে এমআরপি ও এমআরভি কার্যক্রম বাস্তবায়নের বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং তবে তা নিতান্তই সাময়িক। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে, আউটসোর্সিং কার্যক্রমের দ্রুত বাস্তবায়ন, এমআরপি বা এমআরভি-র ক্ষেত্রে প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার যেমন- অনলাইনে আবেদনপত্র গ্রহণ ও যাচাই বাছাই, ঢাকাস্থ পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। এতে একদিকে যেমন নতুন পদ সৃষ্টি ও দাপ্তরিক স্থাপনা সমপ্রসারণ এড়ানো সম্ভব হবে তেমনি সরকারের অতিরিক্ত আর্থিক ব্যয়ভার পরিহার করেও উন্নত কনস্যুলার সেবা দেয়া সম্ভব হবে। ওদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলাদা উইংয়ের জন্য সৃষ্টি করা ৭৩টি পদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদ হিসেবে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোর সাংগঠনিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেছেন তারা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে কনস্যুলার সেবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। অনুমোদনকৃত পদগুলোতে মিশনগুলোর চাহিদা অনুসারে একটি কমিটির মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্বাচিত করে মিশনে পদায়িত করতে পারে। একই পদ্ধতির আওতায় অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসের এবং সংস্থার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা বর্তমানে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনগুলোতে কর্মরত আছেন। এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কূটনৈতিক বিভাগের আওতাধীন অনুমোদিত পদের প্রায় ২৫ ভাগ। এসব ৭৩টি পদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা হলে তা মিশনগুলোর জনবল বৃদ্ধির যে কার্যক্রম অব্যাহত আছে তা আরো সুসংহত হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নানা দেন-দরবারের পর সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব সি কিউ কে মুশতাক আহমেদের একক প্রচেষ্টায় সাতটি দেশের ১০টি বাংলাদেশ মিশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উইং স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদন পায়। অর্থ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক, প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির পর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উইং স্থাপনের প্রস্তাবটি। এখন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন চ্যালেঞ্জ করে প্রচারণা চালাচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটা দেশের জন্য সুখকর নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

No comments

Powered by Blogger.