ঢাবি ‘চ’ ইউনিটে ফেল ৯৭ শতাংশ -ফল নিয়ে পাল্টাপাল্টি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেলের রেকর্ড গড়ছেন ‘মেধাবী’ শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ গতকাল প্রকাশিত ‘চ’ ইউনিটের ফলে মাত্র তিন ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছেন। এর আগের ইউনিটগুলোতে ৯ থেকে ২০ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করেছে। ইংরেজি বিভাগে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে মাত্র দু’জন শিক্ষার্থী। এ নিয়ে যখন চারদিকে সমালোচনা তখন মুখ খুললেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেছেন, এমন ফলের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও পরীক্ষা পদ্ধতি দায়ী। এতে শিক্ষার্থীরা হেনস্তা হচ্ছে এবং তাদের হতাশা বাড়াচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীর এ বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বোর্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। এদিকে শিক্ষামন্ত্রীর এ মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন শিক্ষাবিদরাও।
গতকাল সচিবালয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষার মান কমেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইচ্ছা করে শিক্ষার্থীদের ফেল করাচ্ছে শিক্ষার মানকে প্রশ্নের মুখে ফেলার জন্য। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এত সংখ্যক শিক্ষার্থী ফেল এটা আমাদের বিষয় না। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেখবে। শিক্ষার্থীদের হেস্তনেস্ত করতে ফেল বলে প্রচার করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মন্ত্রী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। ছেলেমেয়েদের সর্বনাশ, হতাশাগ্রস্ত, নিরুৎসাহিত এবং বিদেশে তাদের অগ্রহণযোগ্য করার জন্য ওই ধরনের বাছাই পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্দেশে তিনি বলেন, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না। হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবেন না। শিক্ষামন্ত্রী এ বক্তব্যে কড়া সমালোচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে। এই ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। এটা নিয়ে কখনও কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে আপনার (শিক্ষামন্ত্রী) পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কারণ ওই পরীক্ষাগুলো থেকে ৮০ নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে সহায়তা করে। ভিসি আরও বলেন, পরীক্ষা পদ্ধতি আরও আধুনিকায়নে আমরা চেষ্টা করছি। একাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমরা পরীক্ষা নিয়ে থাকি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এটা নিয়ে বির্তক করার কোন অবকাশ নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার মানে গুণগত কোন পরিবর্তন আসেনি এটি তারই প্রমাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, ত্রুটি কোন জায়গায় আছে বিতর্ক না করে সেটা বের করতে হবে। ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করাটা সামগ্রিক শিক্ষার মানে নিয়ে উদ্বেগ হওয়ার মতো। এর সমাধানে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে নিতে হবে। ঢাবির সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা। বহু কষ্টে আজকের এ পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। এটি একটি পরিপূর্ণ নির্ভুল প্রক্রিয়া। শিক্ষামন্ত্রী এ ব্যবস্থাকে বিতর্কিত করতেই এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। তিনি বলেন, বর্তমানে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কিছু ঘটনার কারণে কিছু সমস্যা হতে পারে। তা উত্তরণের সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রী যখন ছাত্র ছিলেন তখনও এ পদ্ধতি ছিল। ৩০-৪০ ভাগ শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে পাস করতো। তারা বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়েও ভাল করতো। বর্তমানে শিক্ষার মানের দিকে দৃষ্টি দেয়া হচ্ছে না। কৃত্রিমভাবে পাসের হার বাড়ানো হচ্ছে। এটার লক্ষণ ভর্তি পরীক্ষায় ফেল করা।  শিক্ষাবিদ ও ঢাবির সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা যেমন বিশ্লেষণ করা দরকার তেমনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাও বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে নম্বর দেয়ার সময় উদারতা ছিল কিনা খতিয়ে দেখতে হবে। তিনি বলেন, ভর্তি পরীক্ষা আরও আধুনিকায়নের চেষ্টা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান বলেন, আমি শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত নই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সঙ্গে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদরা জড়িত। এটা কোনভাবে ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে না। উচ্চশিক্ষা নিতে আসা শিক্ষার্থীদের মান যাচাই-বাছাই করার জন্য ভর্তি পরীক্ষা। সেখানে তারা পাস করতে পারছে না মানে আমাদের সামগ্রিক মান খারাপ সেটা বুঝে নিতে হবে। ভর্তি পরীক্ষায় নির্ধারণ হচ্ছে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্য কিনা। তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রী এসব কথা বলে জাস্টিফাই করতে চাইছেন। উচ্চ মাধ্যমিকে গণহারে পাস ও জিপিএ-৫ পাওয়া সবাই মেধাবী। অতিরিক্ত জিপিএ-৫ পাওয়ার মাঝে কোন কৃতিত্ব নেই। কলা অনুষদের ডিন ও ‘খ’ ইউনিট ভর্তি কমিটির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর এ ধরনের মন্তব্য দুঃখজনক। এটা ওনার কাছ থেকে আশা করিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দেশের সেরা ভর্তি পরীক্ষা। দীর্ঘদিন ধরে এ প্রক্রিয়া চলে আসছে। তিনি বলেন, দেশের সামগ্রিক শিক্ষার মানের অবনতি হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোতে এসে শিক্ষার্থীরা ভাল করতে পারছে না। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও ‘ঘ’ ইউনিট ভর্তি কমিটির সমন্বয় অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অদ্বিতীয়। এটা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। সারা দুনিয়া এ পদ্ধতি অনুসরণ করছে। ভর্তি পরীক্ষায় পাস-ফেলের বিষয় নেই। যারা সেরা তাদের ভর্তি করানোর চেষ্টা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক ও শিক্ষা গবেষক অধ্যাপক ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পদ্ধতিতে কিছু ত্রুটি রয়েছে সত্য। তবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আরও বেশি ্‌ত্রুটিপূর্ণ। বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে চলছে তা চলতে দেয়া যায় না। পরীক্ষা পদ্ধতিতে ত্রুটি আছে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মীজানুর রহমান বলেন, ভর্তি পরীক্ষায় ত্রুটি আছে বিষয়টি সে রকম না। ভর্তি পরীক্ষার উদ্দেশ্য শিক্ষার সামগ্রিক মান নির্ণয় না, ভর্তির যোগ্যদের যাচাই করা। ভালদের মধ্যে থেকে অধিক ভালদের খুঁজে বের করা। সুতরাং এটা দিয়ে সামগ্রিক শিক্ষার মান যাচাই করার কথা বলা যাবে না। তবে গণহারে ফেলের বিষয়টিতে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ঢাবি ‘চ’ ইউনিটে ফেল ৯৭ শতাংশ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের চারুকলা অনুষদভুক্ত ‘চ’ ইউনিটের প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এ ইউনিটে পাসের হার ৩.১০ শতাংশ। ফেল করেছে ৯৭ শতাংশ। রোববার সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় ভর্তি অফিসে এই ফল ঘোষণা করেন ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন চারুকলা অনুষদের ডিন ও ‘চ’ ইউনিট ভর্তি কমিটির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড. আবুল বারাক আলভী, কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. হাসিবুর রহমান। এ বছর ১৩৫টি আসনের বিপরীতে পরীক্ষায় অংশ নেয় ৭ হাজার ২২৯ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছে মাত্র ২২৬ জন। ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে জানা যাবে। উল্লেখ্য, গত ১৩ই সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসের ৭টি কেন্দ্রে ‘চ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

No comments

Powered by Blogger.