বিএনপির ঘাড়ে মামলার বোঝা by রিয়াদুল করিম

মামলা তিন হাজার ৭৮০টি। আসামি তিন লাখ ৫৫ হাজার ৯০৮ জন। এঁদের মধ্যে অন্তত দুই লাখ ৫১ হাজার ৮৬২ জন হলেন অজ্ঞাতনামা আসামি। আসামিদের মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মীরাও রয়েছেন। এ হিসাব ঢাকাসহ পাঁচটি মহানগর ও ৪৪টি জেলার। প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট জেলা ও মহানগরের প্রতিনিধির পাঠানো তথ্য এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ ও আদালত সূত্র থেকে এই হিসাব পাওয়া গেছে।

তবে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর থেকে জানানো হয়, ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে চার হাজার ৫৫১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অন্তত দুই লাখ ২৩ হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামির সংখ্যাও যোগ করা হয়েছে। বিএনপির দপ্তর থেকে বলা হয়, তাদের এই হিসাব ‘প্রাথমিক’। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
এদিকে সরকার এসব মামলা তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবশ্য ইতিমধ্যে বিচারের জন্য ৭২৯টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন ‘প্রতিহতের আন্দোলন’ ও তার আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে বিএনপি ও দলটির নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলনের সময় সহিংসতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে এসব মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলারই বাদী পুলিশ।
এ ব্যাপারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, এসব মামলার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিএনপিকে তৃণমূল পর্যায়ে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। তিনি বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় প্রায় সব নেতার বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হয়েছে।
মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, সরকার বিএনপির নেতাদের বিভিন্ন মামলায় সাজা দেওয়ার চেষ্টা করছে। যদি একটা মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়েও থাকে, তাতে যেন বিএনপি অংশ নিতে না পারে। এ জন্য তিন মাসের মধ্যে মামলাগুলো নিষ্পত্তির জন্য সরকার মাঠ প্রশাসনে নির্দেশনা পাঠিয়েছে।
এখন নিরপেক্ষ সরকারের অধীন মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে নতুন আন্দোলনে যাওয়ার কথা বলছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ জন্য তিনি দলের নেতা-কর্মীদের প্রস্তুত হতে বলেছেন। তিনি ঈদের পর আন্দোলনে নামার ঘোষণাও দিয়েছেন সম্প্রতি দুটি জনসভায়। কিন্তু কেন্দ্রীয় এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্দোলনের প্রস্তুতি তো দূরের কথা, এসব মামলা সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন দলটির নেতা-কর্মীরা।
এর মধ্যে যেসব নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা নেই, তাঁরাও নিশ্চিন্তে থাকতে পারছেন না। কারণ, বেশির ভাগ মামলায়ই বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে। যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাঁদের এসব ‘অজ্ঞাতনামার’ অজুহাতে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, সারা দেশে এসব মামলার কারণে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা অনেকটা বিপর্যস্ত। অনেকে কারাগারে, অনেকে পলাতক। যাঁরা জামিনে আছেন, তাঁদেরও প্রতিনিয়ত আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।
নোয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর জেলায় প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো নেতা-কর্মীকে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।
দলের আরেকজন নেতা পরিস্থিতির ব্যাপকতা বোঝাতে বলেন, ‘আমাদের মহাসচিবকেই মাসে অন্তত ১০ দিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়।’ তিনি বলেন, দলে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা নেই, তাঁরাও শঙ্কামুক্ত নন। কারণ, অজ্ঞাতনামা আসামির জায়গায় অনেককে এখনো মামলায় জড়ানো হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন করে কর্মীদের আন্দোলনে নামানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য মির্জা ফখরুল দাবি করেন, আন্দোলনের জন্য এটা খুব বড় সমস্যা নয়। যেটুকু সমস্যা হওয়ার, তা সব সময়ই হচ্ছে। মামলা-মোকদ্দমা নিয়েই বিএনপি এগিয়ে চলছে।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে করা এসব মামলার অধিকাংশই হয়েছে গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারির মধ্যে। বিশেষ করে, ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খালেদা জিয়ার নির্বাচন প্রতিহতের কর্মসূচি ঘোষণার পর মামলার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এসব মামলার অনেকগুলোতে বিএনপির পাশাপাশি জোটের শরিক দল, বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতা-কর্মীও আসামি আছেন। আবার একই ব্যক্তি একাধিক মামলার আসামিও আছেন।
বাদ যাননি কেন্দ্রীয় নেতারাও: সহিংসতা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের এসব মামলায় দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রায় সব নেতাই আসামি আছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে রয়েছে ৫২টি মামলা। এর মধ্যে ২৪টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ, খন্দকার মোশাররফ হোসেন (অর্থ পাচারের মামলায় এখন কারাবন্দী), এম কে আনোয়ার, জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, রফিকুল ইসলাম মিয়া ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে অন্তত পাঁচটি করে মামলা রয়েছে। ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের একেকজনের বিরুদ্ধে রয়েছে অন্তত ৫০টি করে মামলা।
বেশি মামলা যেসব জেলায়: যেসব জেলায় তুলনামূলক বেশি মামলা হয়েছে সেগুলোর একটি গাইবান্ধা। নির্বাচনের আগে বিএনপি ও শরিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গাইবান্ধার বিভিন্ন থানায় ৪৭৬টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে ৭০ হাজার নেতা-কর্মীর নাম এজাহারে উল্লেখ আছে। বাকি ৮০ হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি। এসব আসামির মধ্যে ১৭৫ জন কারাগারে।
আদালত ও পুলিশ সূত্র জানায়, একই ব্যক্তি অনেকগুলো মামলার আসামিও আছেন। ফলে মোট সংখ্যা বেড়ে গেছে। খুলনা জেলা ও মহানগরে মোট মামলা ২৯০টি। আসামির সংখ্যা সাড়ে চার হাজার। এর মধ্যে ২৯টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগরে ২৩০টি এবং চট্টগ্রাম জেলায় ২৯২টি মামলা হয়েছে। ঢাকায় মামলা আছে ২০০। এর মধ্যে অন্তত ৭০টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় নাম-পরিচয়সহ আসামি করা হয়েছে এক হাজার ৪০০ জনকে। অজ্ঞাতনামা আসামি আছেন আরও কয়েক হাজার।
কুমিল্লায় ১৪৪টি মামলায় প্রায় দেড় হাজার নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। দিনাজপুরে ১১৩টি মামলায় ৬৬০ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। এর বাইরে ৩৬ হাজার ২৪০ জন অজ্ঞাতনামাকে আসামি করা হয়েছে।
নাটোরে বিএনপির দুই হাজার ৩৪০ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৫৬টি। লালমনিরহাটে মোট ৬৭টি মামলায় এক হাজার ৭২২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও আট হাজার ২৩১ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৫৮টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।
বগুড়ায় ৫৪টি মামলায় ১০০ জনের মতো নামে এবং আরও প্রায় সাড়ে তিন হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে। ইতিমধ্যে ২০টি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দেওয়া হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.