মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সিসি by কামাল গাবালা

মিসরের সাবেক সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি গত সপ্তাহের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তাহরির ও ইত্তেহাদায় জনতার সঙ্গে উৎসব অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা বোধ করছি না। ২৫ জানুয়ারির অভ্যুত্থানের পর এবারই প্রথম এরূপ অনুভূতি হচ্ছে। প্রথমত, এটা পরিষ্কার করতে চাই যে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর আমি আমার দেশবাসীর সঙ্গে তাহরির স্কয়ারে জড়ো হয়ে তাঁর পতন উদ্যাপন করেছি। মোবারকের পর যে সামরিক কাউন্সিল দেশ শাসন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছি। আমি মুরসিকে ভোট দিইনি। কিন্তু তিনি ২০১২ সালের নির্বাচনে মোবারকের শেষ প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিককে পরাজিত করলে আমি তাহরির স্কয়ারে তাঁর বিজয় উদ্যাপন করেছি। আশা ছিল, মুরসি একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন। শফিক মূলত আগের জামানারই প্রতিনিধি ছিলেন। মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর আমি আবার তাহরির স্কয়ারে তাঁর পতনের দাবিতে আন্দোলন করেছি। গত বছর জুনে যে আন্দোলনের ফলে তাঁর পতন হয়, সেখানেও আমি ছিলাম।
এবার উদযাপনে অংশ নিতে আমি এতটা আগ্রহী নই কেন? পরাজিত প্রার্থী হামদিন সাবাহির সমর্থক ছিলাম বলে? অথবা সিসির বিজয় যাঁরা উদযাপন করছেন, তাঁরা কালো তালিকাভুক্ত ছিলেন এবং এই বিপ্লবী চত্বরে তাঁদের প্রবেশ নিষেধ ছিল এবং তাঁরাও মোবারকের অপরাধের ভাগীদার ছিলেন, এ কারণে।

মিসরে মোবারকের জামানার নীতি ফিরে আসবে না, এটা বোঝাতে সিসি একটি কুয়েতি পত্রিকাকে বলেছেন, ঘড়ির কাঁটা কখনোই পেছনের দিকে যাবে না আর জনগণের সব অংশ, বিশেষ করে তরুণদের তিনি তাঁর পাশে দেখতে চান। কিন্তু নেহাত এ রকম একটি বক্তব্য আমার মতো মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারে না। আর আমিও তাঁর বিজয় উদযাপন করতে পারি না।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ফারুক গোয়েদা এই বিজয় উদ্যাপনের বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে তাঁর সাপ্তাহিক কলামে বলেছেন, ‘দুর্নীতিবাজ ও নিপীড়ক হোসনি মোবারকের জামানার সহযোগীরা ফেরত আসুক, এটা কাম্য নয়। রাজপথের আন্দোলন ও সংবাদমাধ্যম, কোথাও এমন ভাব দেখালে চলবে না যে কিছুই হয়নি। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অনেকেই এখন সম্মান, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নিয়ে কথা বলছেন।’
গোয়েদা আরও বলেছেন, পুরোনো উপাদানসমূহের এই বিরক্তিকর প্রত্যাবর্তনের জন্য দুটি বিপ্লব বা দুজন প্রেসিডেন্টের পতনের প্রয়োজন ছিল কী—এই প্রশ্ন এখন মানুষের মনে সৃষ্টি হয়েছে।
এই বহুল পঠিত কলামে এই বিশিষ্ট চিন্তক বলেছেন, মোবারকের প্রতীকধারী মানুষদের উচিত ছিল লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলা। কিন্তু দেখা গেল, তাঁরা নির্বাচনের আগের কয়েকটা দিনে সংবাদমাধ্যম ও জনতার মধ্যে স্বরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। মিসরের জনগণ দুবার রাস্তায় নেমে দুজন স্বৈরশাসককে হটিয়েছেন। মোবারকের এই সহযোগীদের প্রত্যাবর্তন মিসরের এই লড়াকু মানুষদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বিদেশি সংবাদমাধ্যমও গত সপ্তাহের নির্বাচনের ব্যাপারে খুব সতর্ক অবস্থান নিয়েছিল। জাপানি ও মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো মিসরে স্বৈরতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনবিষয়ক উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে। দ্য গার্ডিয়ান ভালো কথা বলেছে, তাদের ভাষ্য মতে, ২০১১ সাল থেকে কয়েক দফা বিদ্রোহের পর মিসরে আবার একজন জেনারেল ক্ষমতায় এসেছেন, এতে মিসর আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ রবার্ট ফিস্ক বলেছেন, মিসরীয়রা মোবারকের দস্যুদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে নিজেদের আত্মমর্যাদার জন্য লড়াই করেছেন, কিন্তু এখন তাঁরা মোবারকের মতোই একজন স্বৈরশাসককে ফিরিয়ে আনার দাবি করছেন।
ফিস্ক বলেছেন, সিসির একজন সমর্থকের হাতে একটি ব্যানারে লেখা ছিল এ রকম: মিসর রাষ্ট্রের পুনরুদ্ধারের পথ। তিনি বলেছেন, এই ব্যানার ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবোত্তর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ভাষণ ও তাঁর পরবর্তীকালের রক্তস্নানের কথা মনে করিয়ে দেয়।
সিসির বিজয়ের পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যে নেতিবাচক মন্তব্য করছে, দি ইকোনমিস্ট-এর একটি নিবন্ধ থেকে এর সারাংশ নেওয়া যায়। পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে, মিসর স্বৈরতান্ত্রিক একনায়ককে বেসামরিক মোড়কে ঢেকে দিচ্ছে। অন্য বিদেশি পত্রিকাগুলোতেও একই রকম কথা বলা হচ্ছে। অনেক পত্রিকা এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নমনীয় অবস্থানের সমালোচনা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি মোবারকের আমল ফিরে আসুক, এমনটা প্রত্যাশা করছে বলে বলা হয়েছে।
এসব সত্ত্বেও এটা ঠিক যে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে সাবেক সেনাপ্রধানের বিজয় উদ্যাপন করছে। নির্বাচনে সিসির ভূমিধস
বিজয় হয়েছে, যেখানে তিনি ৯০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছেন।
সিসির নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ২০১৩ সালে গণবিক্ষোভের মুখে মুরসির সরকারকে উৎখাত করে। সে সময়ই সিসি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
মুরসির উৎখাতের পর সিসি মিসরীয়দের স্কয়ারে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তাঁর ও সেনাবাহিনীর ওপর দেশটির শাসনভার অর্পণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। লক্ষ্য হচ্ছে, ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা’। তারপর ইসলামি প্রেসিডেন্টের সমর্থনে আয়োজিত দুটি অবস্থান ধর্মঘট ছত্রভঙ্গ করে দেয় কর্তৃপক্ষ।
যদিও সিসি বলেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করবেন না, তিনি শেষ পর্যন্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বলেন, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা উচিত। তাঁর ঘোষণার পর নতুন সংবিধানের প্রতি ব্যাপক সমর্থন গড়ে
ওঠে। মুরসির সংবিধানকে বাতিল করে যেটা প্রণয়ন করা হয়েছিল।
জনমতের দাবির সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে তিনি যখন সামরিক উর্দি ছেড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন, তখন অনেক সম্ভাব্য প্রার্থীও তাঁকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন। হামদিন সাবাহি না থাকলে সাবেক এই সেনাপ্রধান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতেন।
সাবাহি শুরুতে নির্বাচন করতে ইতস্তত করেছিলেন, তাঁর অনেক সাবেক সমর্থক সিসির প্রতি সমর্থন জানালে তিনি নির্বাচন করতে অনীহা প্রকাশ করেন। কিন্তু বিপ্লবী তরুণেরা তাঁকে সমর্থন দেন এবং তাঁদের পছন্দের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁকে নির্বাচন করতে উৎসাহ দেন।
সাবাহিকে ব্যবসায়ীরা সমর্থন করেননি। সরকারি ও বেসরকারি সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমর্থনও তিনি পাননি। আর অন্য বিরোধীরাও সিসিকে সমর্থন দেন। এসব কারণে সাবাহির পরাজয় প্রত্যাশিত ছিল, সেটা অবশ্যম্ভাবী না হলেও।
সাবাহি বলেছেন, জনমতের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা রয়েছে, এ প্রত্যয় তিনি বারবার ব্যক্ত করেছেন। এমনকি তিনি সিসিকে বিজয় অভিনন্দনও জানিয়েছেন। তবে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশ আইন লঙ্ঘন করেছে বলে তাঁর প্রচারণায় অভিযোগ করা হয়।
শেষ বিচারে, সিসি প্রেসিডেন্টের আসন অলংকৃত করতে এগিয়ে গেলেও তাঁর জন্য ফুলের শয্যা সাজিয়ে কেউ বসে নেই। তাঁর সামনে বন্ধুর পথ। বিশেষত, তাঁর দুজন পূর্বসূরি জেলে থাকায় একই ভাগ্যবরণ এড়াতে তাঁকে সচেষ্ট হতে হবে।
সিসি কি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে তাঁর লক্ষ্যে কামিয়াব হতে পারবেন, গামাল আবদুল নাসেরের মতো ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারবেন? নাকি তাঁর পূর্বসূরিদের মতো শোচনীয় ভাগ্য বরণ করবেন? ঈশ্বর ক্ষমা করুন।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট; ইংরেজি থেকে অনূদিত

কামাল গাবালা: মিসরের আল আহরাম পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক৷

No comments

Powered by Blogger.