বাজেট- বাজেট বাস্তবায়নে যা করণীয় by আবুল বাসার

সরকার প্রতিবছর জুন মাসে তার পরবর্তী বাজেট ঘোষণা করে। এটা একটা নিয়ম। আর এই বাজেট ঘোষণার পর অনেকটা নিয়ম করেই বেশ কিছু জিনিস ঘটে। বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদেরা এ বাজেটের বিশ্লেষণ করেন। এ নিয়ে মিডিয়ায় মাঝেমধ্যে অহেতুক বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন সরকার ও বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস একটু দেখে নিলে যে কেউই বলে দিতে পারেন যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন না হলে সরকারের ঘোষিত বাজেট পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়িত হবে না। এটুকু বলার জন্য বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ হতে হয় না৷ সত্যি বলতে কি, তার জন্য অর্থনীতির পেছনের বেঞ্চের ছাত্রও হতে হয় না। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতামতের একটা বড় অংশ এ বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকে। বিশেষজ্ঞরা ঘোষিত বাজেটকে যখন উচ্চাভিলাষী, বাস্তবায়নের অনুপযোগী বলে শনাক্ত করেন, সেটি পারতপক্ষে সরকারকে একধরনের দায়মুক্তি দেওয়ারই শামিল। কারণ, এর ফলে সরকার তার নিজের ঘোষিত বাজেটকে বাস্তবায়নের জন্য খুব একটা চাপ অনুভব করে না। যেকোনো বাজেটকে দুই দৃষ্টিকোণ থেকে বড় বা ছোট বলা যায়। আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের নিরিখে যে আকারের বাজেট দরকার, ঘোষিত বাজেটকে তার চেয়ে বড় কিংবা ছোট হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আবার আমাদের কী ধরনের বাজেট প্রণয়নের আর্থিক সক্ষমতা এবং বাস্তবায়নের প্রশাসনিক ও কারিগরি সক্ষমতা আছে, তার আলোকেও ঘোষিত বাজেটকে বড় কিংবা ছোট হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে চায়। আমাদের গৃহীত পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এ বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যও ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু তাদের কোনো কিছুই সেভাবে অর্জিত হয়নি। তার বড় কারণ দেশের অবকাঠামো কিংবা বিদ্যুৎসহ অন্যান্য অপরিহার্য খাতে প্রয়োজনীয় উন্নয়ন না হওয়া। আর এসব খাতের উন্নয়ন ঘটিয়ে বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার মূল দায়িত্ব সরকারের। আমরা যদি ২০১১ অর্থবছর থেকে শুরু করে সম্প্রতি ঘোষিত বাজেটে সরকারের উন্নয়ন ব্যয় তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে যে এই পাঁচ বছরে উন্নয়ন ব্যয় বেড়েছে বার্ষিক গড়ে ২১ শতাংশ হারে। মূল্যস্ফীতিকে বাদ দিলে এর পরিমাণ দাঁড়ায় মোটামুটি ১৪ শতাংশের মতো, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য মোটেও পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নির্দিষ্টকৃত লক্ষ্যসমূহ পূরণের এযাবৎকালের ব্যর্থতা অনুন্নয়ন ব্যয়ের অপ্রতুলতাকেই তুলে ধরে।
এ রকম একটি অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে ঘোষিত বাজেটকে উচ্চাভিলাষী হিসেবে সমালোচনা না করে বরং সেটাকে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ ও পরামর্শ প্রদান করাই বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের জন্য সঠিক কাজ হওয়া উচিত। এই বাজেটকে পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়গুলো সহজ ভাষায় মানুষের কাছে তুলে ধরলেই সরকার একধরনের চাপ অনুভব করবে। ঘোষিত বাজেটকে ‘গতানুগতিক’ বলে শনাক্তকরণের গতানুগতিক ধারা পরিহার করে তাকে বাস্তবায়নের জন্য বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদানের ধারাটি এ বছর থেকেই শুরু হোক।
প্রয়োজনের সঙ্গে মিল রেখে একটি বড় বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে অপর্যাপ্ত কর আদায়। বাংলাদেশ গত কয়েক বছর কর আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারও হয়তো বুঝতে পেরেছে যে ব্যর্থতার এই বেড়াজাল ছিন্ন করতে হলে করব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। তার কিছুটা প্রতিফলন এই বাজেটেও দেখা যাচ্ছে। করের আওতা বাড়ানো হয়েছে, উচ্চ আয়ের মানুষের কাছ থেকে অধিক কর আদায়ের জন্য নতুন স্ল্যাব তৈরি করা হয়েছে, নতুন ধরনের কর বসানো হয়েছে। কিন্তু গৃহীত এসব ব্যবস্থার সুফল নির্ভর করছে কর আদায়ের জন্য প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর। অথর্মন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।
সরকার কর বাড়ানোর নানাবিধ পদক্ষেপ নিলেও মূল সমস্যাটি অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। করকাঠামোর যেসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশে কালোটাকা তৈরি হয়, সেসব দুর্বলতা নিরসন করার পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। বাজেট বক্তৃতায়ও এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি। আর এ কারণেই ভয় থেকে যায় কর আদায়ের লক্ষ্য আদায় না হওয়ার। ফলে বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়ন হুমকির মুখে পড়তে পারে। আর বাজেটকে উচ্চাভিলাষী, লক্ষ্যবিলাসী, স্বপ্নবিলাসী বলে বিশেষজ্ঞরা বুঝে হোক আর না বুঝে হোক, আসল সমস্যাকে আড়াল করে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাচ্ছেন।
বাংলাদেশের মতো দেশে বাজেট ঘাটতি থাকবেই। এবারের বাজেটেও আছে। কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলে ঘাটতির পরিমাণ প্রাথমিক প্রাক্কলনের চেয়ে বেশি হবে। আর সেই ঘাটতির একটা বড় অংশ সরকার ব্যাংকঋণের মাধ্যমে পূরণ করবে। অনেকেই মত দিচ্ছেন যে এর ফলে বাংলাদেশের বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ পাবেন না, এ কারণে তাঁদের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিষয়টি তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব। কিন্তু এ দেশের অর্থনৈতিক ইতিহাসে তেমনটি হয়নি। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিতে ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্বৃত্তের পরিমাণও বাড়ে। সেই উদ্বৃত্তের একটি অংশ ব্যাংকিং খাতে যায়, যা থেকে সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তারা বর্ধিত পরিমাণে ঋণ নিতে পারেন।
যদি কোনো কারণে ব্যাংকিং খাত বর্ধিত উদ্বৃত্ত তথা সঞ্চয় থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলেই কেবল সরকারি ঋণ বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমিয়ে দিতে পারে। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে যে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল, তার ফলে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের একটি বড় অংশ ব্যাংকে না গিয়ে শেয়ারবাজারে চলে যায়। একই সঙ্গে ফাটকা মুনাফার লোভে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও ঋণ প্রদানের চেয়ে শেয়ারবাজারে অথর্লগ্নিতে বেশি আগ্রহী হয়। এসব কারণেই ওই বছর বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কিছুটা হুমকির মুখে পড়েছিল।
ব্যাংকিং খাতের আরেক বড় সমস্যা অনিয়ম ও দুর্নীতি। যখন কোনো একটি কোম্পানিকে বাছবিচার না করে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয় এবং সেই টাকা লোপাট হয়ে যায়, তখন শুধু বেসরকারি নয়, সরকারি খাতে ঋণ প্রদানও ব্যাংকিং খাতের জন্য দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। এবারের বাজেটে প্রাক্কলিত সরকারি ঋণ নয়, ২০১০ সালের মতো শেয়ারবাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, হল-মার্ক কেলেঙ্কািরর মতো আরও দু-একটি কেলেঙ্কাির, আর ডেসটিনি গ্রুপের মতো কারও কাছে সঞ্চয়কারীদের আমানত খোয়ানোই ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যহানি ঘটাবে এবং শুধু বাজেট বাস্তবায়ন নয়, বেসরকারি খাতকে সমস্যাসংকুল করে তুলবে। সুতরাং ঘাটতি বাজেট এবং সরকারি ঋণের সমালোচনা না করে সরকারকে বরং চাপে রাখা উচিত, যেন সে ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যহানি ঘটে এমন কিছু না হওয়ার বিষয়ে সজাগ থাকে। তা হলেই ঘাটতি অর্থায়নের মাধ্যমে ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন অসম্ভব হবে না।
অর্থায়নের পাশাপাশি বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়নের পথে আরেকটি বাধা হলো আমাদের প্রশাসনিক অদক্ষতা ও ক্ষমতার অভাব। অনেক বছর অর্থের সংস্থান থাকার পরও উন্নয়ন বাজেটকে কাটছাঁট করতে হয়েছে শুধু এ কারণে। কোনো বছরই বাজেট বক্তৃতায় এ সমস্যাটির ওপর কোনো আলোকপাত করা হয় না। ফলে বছরের পর বছর এ সমস্যাটির সমাধান না করেই উন্নয়ন ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। আর ফলাফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য এ বৃত্ত ভাঙতে হবে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এমন এক সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছে, যখন দরকার প্রচুর সরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগের জন্য প্রণোদনা তৈির করা। তাত্ত্বিকভাবে অর্থনীতিবিদেরা বিষয়টিকে বলেন অর্থনীতিকে ‘বড় ধাক্কা’ দেওয়া। এ কাজটি অনেক আগেই করা দরকার ছিল, কিন্তু করা হয়নি। করার জন্য যে পরিমাণ সরকারি বিনিয়োগ করা দরকার, ঘোষিত বাজেট সে তুলনায় ছোট। কিন্তু সেই বাজেটকে বাস্তবায়নের জন্য যা করা দরকার, তার ব্যাপ্তি অনেক বড়।

পরিশেষে অনেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আকাঙ্ক্ষার বিলাস দেখতে পান। উচ্চাকাঙ্ক্ষার দরকার আছে। Disney Pictures-এর প্রতিষ্ঠাতা Walt Disney বলেছিলেন, ‘If you can dream it, you can do it.’ বড় কিছু করতে হলে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে হয়।

আবুল বাসার: গবেষক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)৷
abasher@bids.org.bd

No comments

Powered by Blogger.