করাচি হামলার পেছনে কী? by ইমতিয়াজ গুল

রোববার মধ্যরাতে পাকিস্তানের বৃহত্তম করাচি বিমানবন্দরে দুঃসাহসী জঙ্গি হামলায় সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ হতাহতের সংখ্যার দিক থেকে এটা পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাব্যূহের ওপর তালেবানদের সবচেয়ে বড় হামলা। আল-কায়েদার সহযোগী সংগঠনগুলোই যে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি, এই ঘটনা সেটা আবারও প্রমাণ করে দিল। এ হামলায় ১০ জন আক্রমণকারীসহ মোট ৩৬ জন নিহত হয়েছে। যথারীতি তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এই হামলার দায়দায়িত্ব স্বীকার করেছে। সংগঠনটি বলেছে, তাদের নেতা হাকিমুল্লাহ মেহসুদের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছে। এদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওয়াজিরিস্তানের নির্দোষ ও অসহায় আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছে।

সংগঠনটি বলেছে, এই হামলা সেই সম্ভাব্য সামরিক আক্রমণের বিরুদ্ধে একটি সতর্কবার্তা। সংগঠনটির নিজস্ব ফেসবুক পাতায় এই হামলার প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছে টিটিপি: প্রথমত, এই বিমানবন্দর থেকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে মুজাহিদদের যুদ্ধে রসদ সরবরাহ করা হয় আর দ্বিতীয়ত, করাচি বন্দর থেকে আফগানিস্তান অভিমুখী মার্কিন-ন্যাটো কার্গো পরিচালনা করা হয়৷
সম্প্রতি তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের শান্তি আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় সংগঠনটি নতুন করে নিরাপত্তা ও কৌশলগত ক্ষেত্রে হামলা চালানো শুরু করেছে। পাকিস্তানের সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের শর্তগুলো গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় এই আলোচনা ভেস্তে যায়। সংগঠনটি দাবি করে, সর্বস্তরে শরিয়াহ আইন প্রবর্তন ও আদিবাসী অঞ্চল থেকে নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে। আর তাদের নিজেদের জন্য একটি শান্তি অঞ্চল ঘোষণা করতে হবে। আলোচনায় অগ্রগতি না হওয়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ওয়াজিরিস্তানের আইএমইউ ও চীনা উইঘুরদের গোপন ডেরায় বোমাবর্ষণ শুরু করে। অথচ তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান সেখানে এদের সামাজিক নিরাপত্তা দিয়েছিল।
ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) উইঘুর মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। তারা স্বাধীন ঝিনজিয়াংয়ের দাবিতে আন্দোলন করছে। সংগঠনটি পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে চীনা স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
পাকিস্তানের অনেকেই মনে করেন, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের নেতৃত্বে পরিচালিত জঙ্গি হামলা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার চলমান প্রক্সি যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার তেহরিক-ই-তালেবানকে ভারতের প্রক্সি হিসেবে দেখা হয়। অন্যদিকে, ভারত ও আফগানিস্তানের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলো তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে পাকিস্তানের প্রক্সি মনে করে।
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান সে দেশে জঙ্গি হামলার পেছনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করছে। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দলের ওপর প্রকাশ্য দিবালোকে ২০০৯ সালে দুঃসাহসী জঙ্গি হামলা হয়৷ এরপর দুনিয়ার সব জাতীয় ক্রিকেট দলই পাকিস্তান সফরে আপত্তি জানায়। ফলে, পাকিস্তানের মাটিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা বন্ধ হয়ে যায়। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল তালাত মাসুদের মতে, এর মানে হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোকে এই বার্তা দেওয়া যে তোমরা এখানে এসো না।
কথা হচ্ছে, এরূপ ঘটনা পাকিস্তানেই এটাই প্রথম নয়। এর আগে এই সংগঠনটি ২০১১ সালে করাচির নৌবাহিনীর বিমানঘাঁটি পিএনএস মেহরানে হামলার দায়দায়িত্ব স্বীকার করে। তারপর ২০১২ সালে রাজধানী ইসলামাবাদের ৭০ কিলোমিটার উত্তরে কামরা বিমানঘাঁটিতে হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে। সংগঠনটি বলেছে, এসব হামলা ছিল অ্যাবোটাবাদে মার্কিন হামলায় ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুর প্রতিশোধ।
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান এই হামলা একা একা করেনি। ঘরের শত্রুর সহায়তা ছাড়া এ ধরনের পরিকল্পিত হামলা চালানো সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কমোডর জামাল হুসেন। এটা পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি। একই সঙ্গে এ হামলায় এটা প্রমাণিত হলো যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থায় বড় ফাঁক রয়ে গেছে। এত সংখ্যক আক্রমণকারী কীভাবে জড়ো হয়ে হামলা করল, এটা সত্যি বিস্ময়ের ব্যাপার। ফলে, সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের সমন্বয় আরও দৃঢ় হওয়া উচিত বলে মনে করছেন পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা।
এমনকি এ হামলার সঙ্গে উজবেক জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে মনে করছেন আধা সামরিক বাহিনী রেঞ্জারের প্রধান মেজর জেনারেল রিজওয়ান আখতার। মৃত জঙ্গিদের চেহারা দেখে তিনি সে রকমই মনে করছেন। তবে ডিএনএ পরীক্ষার আগে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাবে না।
ইসলামিক মুভমেন্ট অব উজবেকিস্তানের (আইএমইউ) সঙ্গে টিটিপির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। এরা উজবেকিস্তানে সাজা এড়িয়ে পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকা ওয়াজিরিস্তানে ঘাঁটি গেড়েছে, ২০১১ সালে তালেবানরা পরাজিত হওয়ার পর তারা সেখানে আসে। বিশেষ করে, দলটির নেতা তাহরির ইউলদাসেভ ২০০৯ সালে ড্রোন হামলায় নিহত হলে এরা তালেবানদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তার পর থেকে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী তাদের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, আর তারা এদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে। পাকিস্তানে বসবাস করার ক্ষেত্রে এই নিরাপত্তা বাহিনীই তাদের প্রধান প্রতিবন্ধকতা, এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
ইমতিয়াজ গুল: পাকিস্তানের ইসলামাবাদভিত্তিক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.