কোন দিকে যাচ্ছে সংবাদমাধ্যম? by কুলদীপ নায়ার

আমি সংবাদমাধ্যমে করপোরেশনের বিনিয়োগের বিরোধী নই৷ একদিকে খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে বিজ্ঞাপনও কমছে, এ দুয়ের চাপে সংবাদমাধ্যমের অবস্থা মৃতপ্রায়৷ তার পরও আদর্শিকভাবে সংবাদমাধ্যমের স্বনির্ভর থাকা উচিত৷ মুদ্রিত ও সম্প্রচার সংবাদমাধ্যমের অনেকের পক্ষেই এটা সম্ভব নয় বিধায় করপোরেশনের বিনিয়োগের একটা সীমা থাকা উচিত৷ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে বিদেশি ইকুইটির পরিমাণ ২৬ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন৷ কিছু কারণে টেলিভিশনের ক্ষেত্রে এ সীমা প্রযোজ্য হয়নি৷ হয়তো আকাশতরঙ্গের ক্ষেত্রে এটা আরোপ করা কঠিন৷ তবে বিদেশিদের মালিকানার ক্ষেত্র সংকুচিত করার কারণ বোধগম্য৷

বিদেশি ইকুইটি ট্রয়ের ঘোড়ার মতো, এটার যদি সীমারেখা থাকে, তাহলে ভারতীয় করপোরেশনগুলোর জন্যও একটি লক্ষ্মণরেখা থাকা উচিত, যার বাইরে তারা যেতে পারবে না৷ রাজনীতিবিদেরা তাঁদের বিলাসবহুল জীবনযাপন ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে এই করপোরেশনের ওপর নির্ভরশীল, তাই এদের ক্ষমতা অপরিসীম৷ বলা বাহুল্য, এটা একধরনের বিনিময়৷ কিছু পাওয়ার বদলে কিছু দেওয়া৷ রাজনীতিবিদদেরও টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা রয়েছে৷
নানা কারণেই কেন্দ্রীয় সরকারগুলো সব সময়ই প্রেস বা সংবাদমাধ্যম কমিশন গঠনের বিরোধিতা করেছে৷ স্বাধীনতার পর এরূপ দুটি কমিশন গঠন করা হয়েছে৷ প্রথমটি গঠিত হয়েছিল স্বাধীনতার পর, দ্বিতীয়টি হয়েছিল ১৯৭৭ সালের জরুরি অবস্থার পর৷ দ্বিতীয় কমিশনের সুপারিশগুলো ইন্দিরা গান্ধী বিবেচনা পর্যন্ত করেননি, কারণ জরুরি অবস্থার এই কমিশনের কোনো প্রস্তাবের প্রতি তিনি কর্ণপাত করতেও রাজি ছিলেন না৷ (যে পুলিশ সংস্কার প্রতিবেদনটি প্রশংসিত হয়েছিল, সেটিরও অপমৃত্যু ঘটে)৷
মুকেশ আম্বানির রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লি. যে বড় একটি টিভি সংবাদ নেটওয়ার্ক কিনে নিয়েছিল, এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠান টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার করেনি৷ আমি এতে মোটেও বিস্মিত হইনি৷ অধিকাংশ টিভি চ্যানেলের মালিকানা সম্পদ ব্যবসায়ীদের হাতে, যারা শুধু মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে মাসে এক কোটি টাকা খরচ করতে পারে৷ তারা সবাই চায়, আজ বা কাল তারা রিলায়েন্সের মতো হবে৷ সংবাদমাধ্যমে চুক্তিটির খবর এসেছে, কিন্তু সবাই চুপ করে থেকেছে—ব্যাপারটি আমাকে ধাক্কা দিয়েছে৷ সাংবাদিকতা এখন আর পেশা নয়, শিল্প হয়ে গেছে৷ তার পরও ভারতের সম্পাদক সমাজের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে, আমি এমনটাই আশা করেছিলাম৷ আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর আশা করেছিলাম সম্পাদকেরা তাঁদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করবেন, রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে তাঁরা যেটা সব সময়ই দাবি করেন৷ এই দ্বৈত নীতি গ্রহণের কারণে সংবাদমাধ্যম যে উঁচু আসনে আসীন, সেটা ধূলিসাৎ হয়ে যায়৷
নরেন্দ্র মোদির সরকার ভারতের আগের সরকারগুলোর মতো নয়৷ তাদের উচিত হবে একটি কমিশন গঠন করে সংবাদমাধ্যমের অবস্থা যাচাই করা৷ ইন্দিরা গান্ধীর পর এটাই হবে এরূপ প্রথম উদ্যোগ৷ ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর কোনো মূল্যায়ন হয়নি৷ কারণ, দূরদর্শনসহ অন্য সব চ্যানেলই সে সময় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সঙ্গে পরিচিত ছিল না৷
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, ভারতে একই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও রেডিওর মালিকানা কেন্দ্রীভূত৷ এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এরূপ সর্বগ্রাসী মালিকানার ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ আছে৷ কিন্তু ভারতে এ-বিষয়ক ন্যূনতম বাধাও নেই, এটি অনেকটা কারখানা স্থাপনের মতো বিষয়ে পরিণত হয়েছে৷
আমি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে৷ ভারতের নতুন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী প্রকাশ জাভাদেকারের কথায় আমি বিরক্ত৷ সন্দেহ নেই, তিনি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছেন, কিন্তু দায়িত্বশীলতার শর্ত চাপিয়ে দিয়েছেন৷
আমি এই শর্তের আওতায় পড়ি না৷ কেন? ভারতীয় সংবাদমাধ্যম মূল্যবোধ ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই৷ রাজনীতিবিদেরা মূল্যবোধ তিলে তিলে ধ্বংস করেছেন৷ স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের সংবাদমাধ্যম আজ পর্যন্ত কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের নজির স্থাপন করেনি৷ কিন্তু সরকার সম্বন্ধে এ কথা বলা যাবে না৷ ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময় সরকার সেন্সরশিপ আরোপ করেছিল৷
এখন পর্যন্ত ভারতের অনেক প্রদেশেই সংবাদপত্র মুখ্যমন্ত্রীদের চাপ ও শাস্তির ঝুঁকির মুখে কাজ করে৷ ছোট সংবাদপত্রগুলোর কাছে এখন পর্যন্ত সরকারি বিজ্ঞাপনই হচ্ছে আয়ের উৎস৷ যেসব সংবাদপত্র শুধু সরকারের প্রশংসা করে, এসব বিজ্ঞাপন মূলত তারাই পায়৷ যেসব সংবাদপত্র সমালোচনা করে, তারা পায় না৷ কিন্তু সরকার এসব বিজ্ঞাপনের পেছনে যে অর্থ ব্যয় করে, তা জনগণের করের টাকা৷
সরকারি বিজ্ঞাপনের মুলা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেও কাজ করে৷ সরকার কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই এটা যখন তখন ঝোলায়৷ ফলে, সরকারের হাতে কোটি কোটি টাকা থাকে, যার মাধ্যমে তারা প্রভাব বিস্তার করে৷ ভারতের ক্ষেত্রে করপোরেশন ও ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা নতুন কোনো ব্যাপার না৷ এই সূত্রেই গত কয়েক সপ্তাহে আমি বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফরের সুযোগ পেয়েছি৷ এই দেশ দুটোর রাজনৈতিক অবস্থা তথৈবচ৷ শাসনব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর প্রভাবও লক্ষণীয়৷ এ নিয়ে পুরো একটি নিবন্ধ লেখা যেতে পারে৷ এ লেখায় আমি শুধু সংবাদমাধ্যমের ওপরই আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চাই, রাজনীতির ওপরও এর প্রভাব আছে৷ বাংলাদেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বেশি, সব কটিই বাংলায় অনুষ্ঠান প্রচার করে৷ কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদে, টেলিভিশনের চেয়ে সংবাদপত্রগুলোই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন সরকারকে সমর্থন করছে৷ পাকিস্তান এখনো অনেকাংশে সামন্ততান্ত্রিক হলেও উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দৃঢ়প্রত্যয়ী সংবাদমাধ্যম রয়েছে এ দেশে৷ জিয়ো টিভির হামিদ মিরকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে৷ সেখানে আরও অনেক সাংবাদিক আছেন, যাঁরা প্রতিদিনই জীবনের হুমকি অগ্রাহ্য করে কাজ করে যাচ্ছেন৷ তাঁদের অনেকেই বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী ও ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন৷ সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা এসব বিপদের মধ্যেও সামগ্রিক সত্যনিষ্ঠতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে৷
সংবাদমাধ্যম এটা নিশ্চিত করে বলতে পারে, উপমহাদেশে সংবাদপত্র ও টিভি চ্যালেগুলোর মালিকানা এখন আর বিদেশিদের হাতে নেই৷ বেনেট কোলম্যান টাইমস অব ইন্ডিয়া বিক্রি করার চেষ্টা করছেন৷ মাদ্রাজের দ্য মেইল ও লক্ষ্ণৌয়ের দ্য পাইওনিয়ার-এর মালিকানার হাত বদলেছে৷ এগুলো আগে বিদেশি মালিকানায় ছিল৷ দ্য স্টেটসম্যান নেহরুর আশীর্বাদপুষ্ট একটি ব্যবসায়ী সংঘ কিনে নিয়েছিল৷
এ কথা সত্য যে সংবাদমাধ্যম বহুদূর এগিয়েছে৷ এখনো প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া চাইছে, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের নজরদারির মধ্যে আসুক৷ আর শাসকেরা মিডিয়ার দাবিদাওয়ার প্রতি কোনো কর্ণপাতই করছেন না৷ প্রেস কাউন্সিল বলছে: ‘বেশ কিছুদিন থেকেই সাংবাদিকতায় প্রবেশ করার জন্য যোগ্যতার ব্যাপারটি আলোচিত হচ্ছে৷ সংবাদমাধ্যম একটি পূর্ণ বিকশিত ক্ষেত্র, মানুষের জীবনের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে৷ ফলে, আইন দ্বারা সেই যোগ্যতা নির্ধারণের সময় এসেছে৷’
আক্ষেপ করে বলছি, সংবাদমাধ্যম এখন বিপণন ও কোনো একটা বিষয় মানুষের মাথায় ঠেসে ভরানোর কাজেই বেশি ব্যস্ত৷ বটেই, এগুলোর প্রয়োজন আছে৷ কিন্তু বিষয়বস্তুর দিকেই বেশি নজর দেওয়া উচিত৷ দুঃখটা সেখানেই, বিষয়টি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে৷
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক৷

No comments

Powered by Blogger.