এভাবে চলতে থাকলে দেশ হবে অগ্নিগর্ভ: ড. আকবর আলি খান

দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট গণবিস্ফোরণের সৃষ্টি করতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, বর্তমানে যে অবস্থা, এ অবস্থাতে স্বস্তির কোন কারণ নেই। গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুতি কখনও বাংলাদেশের জনগণ গ্রহণ করেনি। অদূর ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত করার চেষ্টা করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশে অগ্নিগর্ভ সৃষ্টি হতে পারে। সেটা আজকে হবে না কালকে হবে জানি না। কিন্তু এটা এক সময় হবেই। গতকাল সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পরিস্থিতি: কিছু ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা অনেক জটিল। এ সঙ্কটের কোন সমাধান নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গিয়েছে এবং এ নির্বাচনকে সকলের নিকট কিভাবে গ্রহণযোগ্য করা যায় সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের সংবিধানে দুর্বলতা রয়েছে, গলদ রয়েছে আমাদের শাসনব্যবস্থায়। রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান করা যেতে পারে সংবিধানে ‘রেফারেন্ডাম’ ও ‘রিকল’ পদ্ধতির ব্যবস্থা করে। এ পদ্ধতির প্রবর্তন বিরোধী দলকে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পরিহারে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।  আরেকটি নির্বাচনের মাধ্যমে যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবেই- তা নিশ্চিত নয়। যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলই প্রভাব খাটায়। তাই রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। গণভোটের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন আনা সম্ভব। এছাড়া কেউ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলেও তাকে ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা জনগণকে দিতে হবে। তিনি বলেন, আজকে বাংলাদেশের রাজনীতি হালুয়া-রুটির লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এখানে কোন আদর্শবাদী লোকজন যান না। ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রাজনৈতিক দলে যেমন পরিবর্তন হয়, আমাদের দেশে সেরকম পরিবর্তনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। আমাদের দেশের আদর্শবাদী লোকেরা রাজনীতি থেকে অনেক দূরে থাকেন। গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান। প্রবন্ধে তিনি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীনভাবে সত্য কথা বলা একটি ভীষণ ঝুঁকির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি বা অপরাধ উন্মোচন অথবা ভিন্নমতাবলম্বীর কথা বলার কারণে মিডিয়া বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের হুমকি বা হয়রানির বিভিন্ন ঘটনাও আমরা লক্ষ্য করছি। আমাদের যদি স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার না থাকে তাহলে দেশের গণতন্ত্রের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বৈকি। তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দেশের শাসনব্যবস্থায় নাকি সরকার অব্যাহত রাখার প্রয়োজন রয়েছে। এই ‘সরকার অব্যাহত রাখার’ কথাটি কিন্তু উদ্বেগজনক। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য নীতি কাঠামোর ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার প্রয়োজন রয়েছে, বিশেষ করে যেসব নীতি সুফল বয়ে আনে, তবে আমাদের মনে রাখতে হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই ভোটের মাধ্যমে ঠিক করবে তারা কোন সরকারকে অব্যাহত রাখবে না পরিবর্তিত করবে। প্রবন্ধে আরও বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের গুণগত উন্নতি সাধনে একটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। যদিও সকল দলের গঠনতন্ত্রে নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা-নেত্রী নির্বাচনের কথা আছে এবং তৃণমূল পর্যায়ে পরামর্শ সংক্রান্ত বিভিন্ন পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে নির্বাচন হয় অনিয়মিত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হাতেই রয়ে গেছে। তিনি এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, দেশে পুরোপুরি একনায়কতন্ত্র চলছে, গণতন্ত্র নেই বললেই চলে। রাজনীতি আজ কলুষিত। এ থেকে উত্তরণ অতীব জরুরি। তিনি জনগণকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন ও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি স্বার্থ দেখে, দলীয় স্বার্থ দেখে কিন্তু দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ দেখে না। প্রধানমন্ত্রীর ঊদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, দেশে এক মুহূর্তের জন্য অনির্বাচিত সরকার রাখতে চান না প্রধানমন্ত্রী। অথচ অনির্বাচিত প্রশাসক দিয়ে ঢাকা মহানগরীর দু’টি খ- চলছে দীর্ঘদিন। ক্ষমতাসীনরা সবসময় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে। সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতন্ত্র আজ বিপন্ন। আপাতদৃষ্টিতে দেশে স্থিতিশীলতা বিরাজ করলেও দীর্ঘমেয়াদে অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে। গণতন্ত্র মানে সম্মতির শাসন। এ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। আর এ নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক। কিন্তু গত ৫ই জানুযারি যে নির্বাচন হয়েছে সে নির্বাচনে এসব উপাদান অনুপস্থিত। সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে এ নির্বাচন হয়নি। ৪১টি দলের মধ্যে ১২টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে মাত্র ১৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। তাই এ নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে নাগরিকদের মনে প্রশ্ন রয়েছে। এ সরকারের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে আইন আছে। কিন্তু আইন থেকে বাঁচার জন্য বিচারকদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। যারা দুর্বল চিত্ত তারা প্রভাবিত হয়। গণতন্ত্রে আমাদের ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা গণতন্ত্রের অপব্যবহার করি। আমাদের মধ্যে পরম সহিষ্ণুতা নেই। প্রত্যেকটি মানুষকে দায়িত্বশীল হতে হবে এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে। সাবেক মন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে কোন দুর্বলতা নেই। দোষ গঠনতন্ত্রে নয়, দোষ রাজনীতিবিদদের। আমাদের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি অত্যন্ত দুর্বল ও নাজুক। আমাদের দেশে যে গণতন্ত্র রয়েছে তার ওপরে আমরা চড়াও হয়েছি। আমরা আজ দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কবলে পড়েছি। সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, হুমায়ূন কবীর হিরু, রেহানা সিদ্দিকী, ইঞ্জিনিয়ার মুসবাহ আলীম, এম এ সিদ্দিকী, আবদুল হাই প্রমুখ গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখেন।

No comments

Powered by Blogger.