ভোটার তথ্যভান্ডারের চাবি ইসির হাতে নেই- জাতীয় নিরাপত্তা ও নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হুমকির মুখে by হারুন আল রশীদ

দেশের নয় কোটির বেশি ভোটারের তথ্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। যেকোনো সময় ভোটার তথ্যভান্ডার থেকে ভোটারের নাম-ঠিকানাসহ যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত গায়েব হয়ে যেতে পারে। কারণ, তথ্যভান্ডারের চাবি নির্বাচন কমিশনের হাতে নেই। ভোটার তথ্যভান্ডার (ডেটাসেন্টার) নিয়ন্ত্রণ করছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি ও কমিশনের নিবন্ধন অনু বিভাগের আইডিয়া প্রকল্পে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা। নিবন্ধন বিভাগ এর নিরাপত্তা চাবিও (পাসওয়ার্ড) তাঁদের কাছে দিয়ে রেখেছে। ২০১২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে তথ্যভান্ডার ইসির কাছে হস্তান্তর করার কথা থাকলেও টাইগার আইটি এখনো তা করেনি। ফলে জাতীয় নিরাপত্তা ও নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এখন হুমকির মুখে। এ বিষয়ে নিবন্ধন বিভাগের ওপর ইসির কোনো নিয়ন্ত্রণও নেই। অথচ জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন, ২০১০-এর ৬ ধারা অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনকাজ পরিচালনা, পরিচয়পত্র প্রস্তুত, বিতরণ ও রক্ষণাবেক্ষণসহ আনুষঙ্গিক সব দায়িত্ব পালন করবে।

ইসি সচিবালয়ের কর্ম-কর্তাদের মতে, আইডিয়া (আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেমস ফর অ্যানহ্যান্সিং এক্সেস টু সার্ভিসেস) প্রকল্পের কর্মকর্তা ইসির স্থায়ী কর্মকর্তা নন। টাইগার আইটি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান। তাই এদের কাছে ভোটার তথ্যভান্ডারের নিয়ন্ত্রণ থাকাটা নিরাপদ নয়। কারণ, এদের যে কেউ চাইলেই কম্পিউটারের একটি বাটনে চাপ দিয়ে তথ্যভান্ডার থেকে নয় কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার ভোটারের যাবতীয় তথ্য মুছে ফেলতে পারে। সে ক্ষেত্রে ইসিকে নতুন করে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি করতে হবে।
বর্তমান ভোটার তথ্যভান্ডারের সঙ্গে অন্যান্য জাতীয় স্বার্থও সংশ্লিষ্ট আছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই তথ্যভান্ডারের সহযোগিতায় করদাতাদের পরিচয় শনাক্ত করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক এই তথ্যভান্ডার ব্যবহার করে।ভবিষ্যতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয় এবং মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোরও এই তথ্যভান্ডার ব্যবহারের কথা রয়েছে।
জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা শাহেদুল আনাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ভোটার তথ্যভান্ডারের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা ও নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার বিষয় যুক্ত। এটি সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব ইসির। তথ্যভান্ডারের নিয়ন্ত্রণ অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকলে জাতীয় নিরাপত্তা ও নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এমনকি পুরো তথ্যভান্ডারটি দেশের প্রতিপক্ষ কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও পাচার হয়ে যেতে পারে, যা পরে দেশের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, মূলত আইডিয়া প্রকল্পের শত শত কোটি টাকার কেনাকাটাকে কেন্দ্র করে নিবন্ধন বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের কয়েকজন স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন। তাঁদের সহযোগিতায় টাইগার আইটি নিবন্ধন বিভাগে গত পাঁচ বছরে অনেকটা একতরফাভাবে কয়েক শ কোটি টাকার কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। বিনিময়ে নিবন্ধন বিভাগ ও প্রকল্পের কর্মকর্তারা টাইগার আইটি থেকে অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন।
জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন আবদুল মোবারক প্রথম আলোকে বলেন, আইন অনুযায়ী নিবন্ধন-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড নিবন্ধন বিভাগ করবে। প্রকল্পের কর্মকর্তারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করবেন। উন্নত মানের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে সহযোগিতা করা ছাড়া ভিন্ন কোনো দায়িত্ব তাঁদের নেই। নিবন্ধনকাজ বা এই বিভাগের তথ্যভান্ডারে খবরদারি করার এখতিয়ার তাঁদের নেই। কারণ, এতে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। অভিযোগ সত্য হলে বিষয়টি ইসির নজরে আনা হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ইসির অনুমোদন না নেওয়া এবং নিবন্ধন বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা সম্পর্কে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইসির কাছে তথ্য চেয়ে পায়নি। বিষয়টি দুদক আইনের লঙ্ঘন। দুদক আইনের ২৩ ধারা অনুসারে, দুদক তদন্তের স্বার্থে সরকারি প্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চাইতে পারবে। তথ্য না পেলে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
ছবিসহ ভোটার তালিকা: ২০০৭ সালে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে এবং সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ছবিসহ ভোটার তালিকার কাজ শুরু হয়। প্রিপারেশন অব অ্যান ইলেকটোরাল রোল উইথ ফটোগ্রাফস (পার্প) প্রকল্পের আওতায় জাতিসংঘ উন্নয়ন তহবিলের (ইউএনডিপি) অনুদানে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৮ সালের জুনের মধ্যে আট কোটি ১০ লাখ ভোটারকে তালিকাভুক্ত করা হয়। ওই সময়ে ভোটার নিবন্ধনের জন্য সফটওয়্যার সরবরাহ করেছিল টাইগার আইটি। অক্টোবরে সেনাবাহিনী ছবিসহ ভোটার তালিকা ও ভোটার তথ্যভান্ডার ইসিতে হস্তান্তর করে।
টাইগার আইটির উত্থান: ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ভোটার তথ্যকে অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণের জন্য জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন-২০১০ পাস করা হয়। এরপর জাতীয় পরিচয়ের তথ্য সংরক্ষণের জন্য ইসি ২০১০ সালের ১৫ জুন টাইগার আইটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। অভিযোগ আছে, সেই সময়ে অনেকটা কমিশনের বদান্যতায় টাইগার আইটি কাজ করার সুযোগ পায়।
টাইগার আইটির সঙ্গে সম্পদিত চুক্তি অনুযায়ী, ২০১২ সালের ৩০ জুনের মধ্যে তারা ভোটার তথ্যভান্ডারের জন্য সফটওয়্যার, বিভিআরএস (বাংলাদেশ ভোটার রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমস) সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার এবং অটোমেটেড ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিং সিস্টেম (আফিস) সরবরাহ করবে। সরবরাহ করা ডেটাসেন্টার ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় থাকবে। একই সময়ের মধ্যে টাইগার আইটি নিবন্ধন বিভাগের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কাছে তথ্যভান্ডার ও বিভিআরএস সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনা হস্তান্তর করবে। চুক্তিতে আরও বলা হয়, টাইগার আইটি ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধন বিভাগকে কারিগরি বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা দেবে। একতরফা এ ব্যবসায় তারা কমিশনের কাছ থেকে প্রায় ১০০ কোটি তুলে নেয়।
চুক্তি মানেনি টাইগার আইটি: ২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত পার্প প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন চৌধুরী। এরপর নিবন্ধন বিভাগের আইনি কাঠামো দাঁড়ানোর পর ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত এর মহাপরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আখতারোজ্জামান সিদ্দিকী। এ সময়ে ভোটারদের উন্নত মানের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় এক হাজার ৩৭৯ কোটি টাকার আইডিয়া প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
২০১৩ সালের ১ মার্চ নিবন্ধন বিভাগের মহাপরিচালক ও প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালিম আহমেদ খান। তিনি দায়িত্ব নিয়েই আবিষ্কার করেন, মূলত প্রকল্পে কেনাকাটার নামে লুটপাট হয়েছে, যার অংশীদার টাইগার আইটি ও প্রকল্পের কর্মকর্তারা। টাকা নিয়ে গেলেও চুক্তি অনুযায়ী টাইগার আইটি বেশির ভাগ কাজই ইসিকে বুঝিয়ে দেয়নি।
ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, সালিম আহমেদ এ বিষয়ে আলোচনার জন্য টাইগার আইটিকে একাধিকবার তাগিদ দিয়ে চিঠি দেন। কিন্তু টাইগার আইটি তাতে সাড়া দেয়নি। বাধ্য হয়ে ২০১৩ সালের ২২ জুলাই সালিম আহমেদ স্বয়ং টাইগার আইটির অফিসে গিয়ে সভা করেন।
সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, টাইগার আইটির সরবরাহ করা আফিস সঠিকভাবে কাজ করে না। সরবরাহ করা সার্ভার ও হার্ডওয়্যার দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টা নিষ্ক্রিয় থাকে। চুক্তি অনুযায়ী টাইগার আইটি নিবন্ধন বিভাগের কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দেয়নি এবং ইসির কাছে ভোটার তথ্যভান্ডার ও বিভিআরএস সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনা হস্তান্তর করেনি। নিবন্ধন বিভাগে ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে টাইগার আইটি সেবা দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, টাইগার আইটি নিবন্ধন বিভাগের সফটওয়্যার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে আগস্টে এবং হার্ডওয়্যার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রশিক্ষণ দেবে। ৩১ আগস্টের মধ্যে ভোটার তথ্যভান্ডার ও বিভিআরএস সফটওয়্যার ব্যবস্থাপনা ইসির কাছে হস্তান্তর করবে। ৫ আগস্টের মধ্যে টাইগার আইটি আফিসের মাধ্যমে আঙুলের ছাপ শনাক্তকরণের কার্যকারিতা নিশ্চিত করবে। সভায় উপস্থিত কর্মকর্তারা জানান, টাইগার আইটির চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান সভায় সালিম আহমেদের কাছে জানতে চান, ভবিষ্যতের কেনাকাটার তাঁরা ইসির আনুকূল্য পাবেন কি না। জবাবে সালিম আহমেদ জানান, দরপত্র সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
টাইগার আইটির বক্তব্য: অভিযোগের জবাবে টাইগার আইটি লিখিতভাবে প্রথম আলোকে জানিয়েছে, তাদের সরবরাহ করা সফটওয়্যার সঠিকভাবে কাজ করছে। চুক্তি অনুযায়ী তারা নিবন্ধন বিভাগের কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং অব্যাহতভাবে নিবন্ধন বিভাগকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। নিবন্ধন বিভাগ চাইলে টাইগার আইটি ভোটার তথ্যভান্ডার ও বিভিআরএস সফটওয়্যার হস্তান্তর করতে প্রস্তুত আছে। বর্তমানে টাইগার আইটিতে প্রায় ৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন। এঁদের কেউ আইডিয়া প্রকল্পের কর্মকর্তাদের আত্মীয়স্বজন কি না, সে বিষয়ে টাইগার আইটির কাছে কোনো তথ্য নেই।

No comments

Powered by Blogger.