যেভাবে কাটছে বিহারি ক্যাম্পের জীবন

ঢাকার মিরপুরের কালসী এলাকায় বিহারী ক্যাম্পে হামলা এবং দশ জনের মৃত্যুর পর এই জনগোষ্ঠীর লোকেরা মনে করছেন, তাদেরকে যে এখনও বৈধ নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় না এই নৃশংসতা তারই প্রমাণ।

এক হিসাবে, বাংলাদেশে এইসব আটকে পড়া পাকিস্তানি বা উর্দুভাষী জনগণের সংখ্যা ৫ লাখের ওপরে, যাদের মধ্যে সাড়ে তিন লাখের বসবাস বিভিন্ন এলাকায় শরণার্থী ক্যাম্পে।বিহারি নামে পরিচিত এইসব লোকজন মনে করেন, ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ থাকলেও তারা অনেক নাগরিক অধিকার ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এরকমই মোহাম্মদপুরের একটি ক্যাম্পে এক একটি খুপরি ঘরে দশ পনেরোজন বসবাস করেন। এমনই একজন বাসিন্দা বলছিলেন, “ স্বামী, ছেলে, ছেলে-বউ, মেয়ে, নাতি নিয়ে একই ঘরে থাকি। লজ্জা নিয়েও এভাবেই থাকতে বাধ্য হচ্ছি। কি করব?”সবগুলো ঘরেই একই চিত্র। একটি কক্ষের ভেতর রান্না, খাওয়া, ঘুম । সেখানেই ঠাসাঠাসি করে রাখা প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র। পানি ও বিদ্যুতের অপর্যাপ্ত সরবরাহ থেকে শুরু করে গোসল বা বাথরুম সংক্রান্ত সমস্যার কারণে তারা নিজেদের জীবন যাপনকে বলছেন মানবেতর। একই গোসলখানায় একাধিক নারী কিংবা একাধিক পুরুষকে স্নান করতে দেখা যায়।

“চার থেকে পাঁচটি গলির লোকের জন্য সাতটি শৌচাগার। মহিলাদের জন্য তিনটি আর পুরুষদের সাতটি। সকালে কিংবা রাতে যখন লোকজনের মাঝে তাড়াহুড়ো থাকে তখন শৌচাগারের সামনে লম্বা সিরিয়াল পড়ে যায়।” বলেন তিনি।

বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, এই ক্যাম্পে এক থেকে দেড় লাখ লোকের বাস।এত লোক গাদাগাদি করে থাকতে গিয়ে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটিও স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানান, বিহারী পরিচয়ের কারণে সমাজের মূলস্রোতে তাল মেলানো তাদের জন্য এখনও বিরাট এক লড়াই।

তারপরও যেসব পরিবার একটু টাকাপয়সার মুখ দেখে কিংবা উচ্চ শিক্ষিত হতে পারে তারা ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে অন্য কোথাও বসবাস করতে শুরু করেন। তবে বেশিরভাগের পক্ষেই তা সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশে বিহারী নামে পরিচিত এইসব উর্দুভাষী লোকজনের বেশিরভাগই কসাইখানায়, সেলুনে, খাবারের দোকানে, কিংবা দিনজুরের কাজ করেন। কেউ রিকশা বা অটোরিকশা চালান। একটি বড় অংশের রোজগার আসে কাপড় সেলাই বা হাতের কাজ করে ।

সাধারণভাবে আটকে পড়া পাকিস্তানি বলে পরিচিত হলেও এখানকার তরুণ প্রজন্মের বেশিরভাগের জন্মই একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে। তারা নিজেদেরকে এই দেশের নাগরিক বলেই মনে করেন এবং এখানেই তারা থাকতে চান।
একজন তরুণ বলেন, “বেশিরভাগ আমরা বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিতে চাই। কারণ আমাদের জন্ম একাত্তর সালের পরে। আমরা দেশের নাগরিক হিসেবেই থাকতে চাই।”

আরেকজন বলেন, “আমি জন্মে দেখি ক্যাম্পে থাকি। এখন আমার একটি মেয়ে হয়েছে। আমি চাই সে এরচেয়ে ভাল পরিবেশে থাকুক। কিন্তু আমাদের পুনর্বাসন সহায়তা না দিলে তো সেটি সম্ভব নয়।”

আরেক তরুণ বলেন, “সরকার যেহেতু আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়েছে এবং আমরা ভোটার তাই আমাদের এখন আর বিহারি বলা চলবে না। আমরা মনে করি বিহারী – বাঙ্গালি ভাই ভাই।”

এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে শিক্ষার হার অনেকটাই বেড়েছে।

স্কুল ইউনিফর্ম পড়া বেশকিছু শিশুর সাথে দেখা হয় যায়। তারা আমাকে জানান, স্কুলে তাদের সহপাঠীদের মধ্যে স্থানীয় বাঙালি পরিবারের যেসব ছেলেমেয়েরা থাকে তাদের সাথে তারা মিলেমিশেই লেখাপড়া করে।

কখনো বৈরি আচরণ দেখেনি বলে জানায় বেশ কয়েকটি শিশু। এই শিশুদের বাবা মায়েদের প্রত্যাশা কোন একদিন অন্ধকার এইসব ঘুপচি ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসতে পারবেন সন্তানদের। আর বিহারি নয় বাংলাদেশের একজন নাগরিক বলেই তাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হবে।

No comments

Powered by Blogger.