পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাচ্যমুখী প্রবণতা by মেজর (অব.) সুধীর সাহা

আওয়ামী লীগের গত সরকারটি কৌশলগতভাবে ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদ লাভ করার ফলে বিশ্বের মার্কিন বন্ধুদের কাছ থেকেও তারা সহায়তা পেয়ে আসছিল। যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মধ্যপ্রাচ্যের অনেকেরই সুদৃষ্টি লাভের সুযোগ পেয়েছিল গত সরকার। কিন্তু খুব দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্রের আসল রূপ দেখার সৌভাগ্য হয় বাংলাদেশের। তবে ভারতের কংগ্রেস সরকারের প্রকাশ্য সহযোগিতা পাওয়ার ফলে বাংলাদেশের হাসিনা সরকার বেশ একটু শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিল। একের পর এক মার্কিন স্বার্থবিরোধী নীতি গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বিরক্ত ছিল। বাংলাদেশকে শিক্ষা দেয়ার কৌশল হিসেবে বিশ্বব্যাংকের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের প্রতি চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল।

পদ্মা সেতু নিয়ে তৎকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত ভুল ও আত্মঘাতী ছিল, এটা ঠিক। তবে বিশ্বব্যাংকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও নীতিসিদ্ধ ছিল না। বরং তাদের সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক কৌশলের অংশবিশেষ। বিশ্বব্যাংকসহ বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক সংগঠনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনস্বীকার্য। যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য বিশ্বব্যাংকসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থাই কোনো কোনো দেশের পক্ষে, আবার কোনো কোনো দেশের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক যে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি এবং তা যে রাজনৈতিক কারণেই হয়েছে, এমনটা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির কালো নকশা পেয়েই বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে কি-না, তা জানার আগেই বিশ্বব্যাংক প্রস্তাবিত ঋণ বাতিল করে দিয়ে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশকে দুর্নীতিবাজ দেশ হিসেবে প্রমাণ করে দেয়। বিশ্বব্যাংকের এমন বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রভাবশালী কোনো সদস্য রাষ্ট্রই কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি, সেটিও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। যুক্তরাষ্ট্র মূলত বাংলাদেশকে চাপের মধ্যে রাখতে বিশ্বব্যাংকের ঋণের বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কৌশলই ফলপ্রসূ হয়নি। তাই শেষ অধ্যায়টি ছিল বাংলাদেশকে কলংকের দাগ দিয়ে বিশ্বব্যাংকের পলায়ন।
বিগত সময়ে যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চাপের মধ্যে ফেলেছিল। ড. ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির বাড়াবাড়ি ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যা ভাবে, ঠিক তেমনটাই ভেবেছিল। ড. ইউনূস কিংবা গ্রামীণ ব্যাংক যে বাংলাদেশের নিজস্ব বিষয়, তা যেন যুক্তরাষ্ট্র বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল। তাই সরাসরিভাবে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সরাসরি অনুরোধ করে বসেছিলেন, যা নিশ্চিতভাবেই ছিল কূটনৈতিক রীতিবিরুদ্ধ। বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের গুম হওয়ার বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে একাধিকবার চাপ প্রয়োগ করে।
এরপর আসে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিয়ে সরকারকে ব্যাপকভাবে চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে অপরাধীদের বিচার এবং শাস্তি নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে চাপের মুখে রেখেছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অতিক্রম করে যাচ্ছিল এবং নিজ সিদ্ধান্তে অটল ছিল। পরপর কয়েকটি ইস্যুতে চাপ দিয়েও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নতজানু করতে না পেরে শেষ পর্যায়ে জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। হাসিনা সরকার কোনো এক অদৃশ্য শক্তির জোরে বারবার যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় সিদ্ধান্তের কাছে মাথানত না করে বরং সাহসিকতার সঙ্গে পথচলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাংলাদেশ পাশে পেয়েছিল ভারত, রাশিয়া, চীন ও জাপানকে। নির্বাচনের পর বাংলাদেশ যখন ভারতের পূর্ণ সমর্থন পেয়ে গিয়েছিল এবং শক্ত হাতে সরকার গঠন করেছিল, ততদিনে যুক্তরাষ্ট্র বুঝে ফেলেছিল বাংলাদেশ তাদের ওপর ততটা নির্ভরশীল নয়। ফলে একই সুর লক্ষ্য করা গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর আচরণে।
ততদিনে নতুন সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার সরকার তার পররাষ্ট্রনীতিতে একটুখানি পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের নামাবলি গায়ে না জড়িয়ে বরং এবারের সরকার আঞ্চলিক দেশগুলোর দিকে সুদৃষ্টি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তার দ্বিতীয়বারের শাসনে প্রথম জাপান সফরের সিদ্ধান্ত নেন। সফরটি শুধু বাস্তবায়িত হল তাই নয়, বরং বলা যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাপান জয় করেই ফিরেছেন। জাপান বাংলাদেশকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সার্বিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আগামী চার-পাঁচ বছরে ছয় বিলিয়ন ডলার প্রদানের প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। জাপানের এমন পজিটিভ আচরণ বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সফরটি ছিল চীনে। জাপানের মতো চীনেও সফল ও ফলপ্রসূ সফর শেষে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়া গেছে চীন থেকে। যৌথ উদ্যোগে পটুয়াখালী জেলায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কর্ণফুলীর তলদেশে বহু লেনভিত্তিক সুড়ঙ্গপথ নির্মাণে চীন সহজ শর্তে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছে। চীনের সহায়তায় গভীর সমুদ্রবন্দর হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে এবং দুদেশই এ বিষয়ে আরও আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
চলতি মাসেই ভারতের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের কথা। ভারতে বিজেপি সরকার আসার প্রাক্কালে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে সংশয় ছিল। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রাক-নির্বাচনী কয়েকটি বক্তব্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে টানাপোড়েনের আশংকা সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সরকার গঠনের পর বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিতই নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে খুব শিগগিরই ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরটিকেও সম্পর্ক উন্নয়নের পথে ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখার সুযোগ রয়েছে। ইতিমধ্যে বিজেপি সরকার তিস্তা নদী ও সীমান্ত সমস্যার সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। ভারতের বিজেপি সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্কটি সুন্দর ও স্বাভাবিক হওয়ার ইঙ্গিত সবদিক থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় সম্পর্কের নতুন একটি পর্যায়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে এমনটাই মনে হচ্ছে। জাপান ও চীনের মধ্যে এবং চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক কিছু সমস্যা থাকলেও বাংলাদেশ তাদের দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ না করে প্রতিটি দেশের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের পাশে জাপান, চীন, ভারত ও রাশিয়া কূটনৈতিক কৌশলের দিক থেকে বেশ প্রকাশ্য অবস্থানে আছে এমনটা প্রতীয়মান হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের সাহসী উদ্যোগের প্রশংসা করতেই হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের দিকে বেশি ঝুঁকে না থেকে বাংলাদেশের সংবিধানের অমোঘ ঘোষণা কারও সঙ্গে শত্র“তা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব- এ নীতি অনুসরণে বাংলাদেশ এবার একটু সতর্কভাবেই অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হয়।
চীন, জাপান আর ভারতের বন্ধুত্বকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার বৈদেশিক নীতি বাংলাদেশের উন্নয়নকে আরও বেগবান করবে। এদের আর্থিক ও সামাজিক সহযোগিতাও বাংলাদেশের সমাজকে অগ্রগতির পথে সাহায্য করবে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিশেষ কূটনৈতিক অবস্থান স্বীকার না করে বরং ভারত, চীন ও জাপানের বিশেষ অবস্থানকে গ্রহণ করলে বাংলাদেশ বেশি উপকৃত হবে। এর অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি কাম্য। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় আবদার অথবা নীতিহীন পরামর্শ গ্রহণ না করার মতো সাহসিকতা দেখানোর পর্যায়ে যদি বাংলাদেশকে দেখা যায়, তাহলে দেশের মানুষ কিছুটা স্বস্তি পাবে। শ্রমিক নেতার মৃত্যুর বিচার হবে কি-না, গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে কি-না অথবা পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে কি-না- এসব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য কোনো দেশের কূটনৈতিক রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে নাক গলানোর বিষয়টি আমরা পছন্দ করব না। আর তেমন একটি অবস্থানে যদি সরকার আমাদের দেশের মর্যাদাকে নিয়ে যেতে পারে, তবে তো তাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলামিস্ট
sudhirsaha2014@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.