নূর হোসেনকে ফিরিয়ে আনতে অনুরোধপত্র, কলকাতায় জেরা by রোজিনা ইসলাম ও অমর সাহা

নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে গতকাল সন্ধ্যায় তারা নূর হোসেনের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ একটি ‘অনুরোধপত্র’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পািঠয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটি নোট আকারে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাঠাবে৷ তারা সে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তা হস্তান্তর করবে৷

গত শনিবার রাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ নূর হোসেন ও তাঁর দুই সঙ্গীকে কলকাতা বিমানবন্দরের অদূরে কৈখালীর ইন্দ্রপ্রস্থ আবাসন থেকে গ্রেপ্তার করেছে। রোববার উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসাতের বিচার বিভাগীয় বিচারক তাঁদের আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর পরই দুই সঙ্গীসহ নূর হোসেনকে বাগুইআটি থানায় নেওয়া হয়। কলকাতার বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের অ্যান্টি-টেররিস্ট স্কোয়াডের (এটিএস) সদস্যরা তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন৷
গতকাল সোমবার বিকেলে বাগুইআটি থানার আইসি দেবব্রত ঝাঁ প্রথম আলোকে বলেন, এটিএসের সদস্যরা নূর হোসেন ও তাঁর সঙ্গীদের জেরা শুরু করেছেন। কোথায় তাঁদের জেরা করা হচ্ছে, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা এটিএসের দায়িত্ব। আমরা ধৃতদের এই থানায় রেখেছি। এখন যখনই এঁদের জেরা করার প্রয়োজন হবে, তখন থানায় জানিয়ে এটিএসের সদস্যরা তাঁদের পছন্দের স্থানে নিয়ে গিয়ে জেরা করবেন।’
পুলিশের আরেকটি সূত্র জানায়, যেহেতু নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেড অ্যালার্ট নোটিশ জারি ছিল, সে জন্য জেরার পর তাঁর জবানবিন্দর ভাষ্য পাঠানো হবে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের কাছে। ভারতে ইন্টারপোলের কাজ হয় সিবিআইয়ের মাধ্যমে।
এদিকে ভারতে নূর হোসেনের গ্রেপ্তারের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার কিছু জানে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। গতকাল সকালে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতে নূর হোসেনের গ্রেপ্তার সম্পর্কে সরকার কিছু জানে না, সরকার যতটুকু জেনেছে তা গণমাধ্যম থেকে জেনেছে।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নূর হোসেনের গ্রেপ্তারের বিষয়টি আমরা গণমাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি। এখনো ভারত আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানায়নি। তার পরেও আমরা কাগজপত্র পাঠাচ্ছি।’
গতকাল বিকেলে কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনার আবিদা ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নূর হোসেনের গ্রেপ্তার নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো তথ্য জানায়নি পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বাংলাদেশ থেকেও বিকেল পর্যন্ত কোনো নির্দেশ আসেনি।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, কোনো চুক্তি অনুযায়ী আসামি বা বন্দীকে অন্য দেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে হলে মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণী, অভিযোগপত্র, ওয়ারেন্ট, কোন আইনে গ্রেপ্তার, তার ব্যাখ্যাসংবলিত কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট সরকারকে পাঠাতে হয়৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য আমরা দেরি না করে যেসব কাগজপত্র আছে, তা দিয়েই অনুরোধপত্র পাঠাচ্ছি। চিঠিতে নূর হোসেনের গ্রেপ্তারের তথ্যসূত্র হিসেবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।’
কবে নাগাদ নূর হোসেনকে ফেরত আনা সম্ভব হতে পারে, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘খুব শিগগির হবে না, একটু সময় লাগবে। তবে এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অত্যন্ত আন্তরিক।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, আসামি ফেরত আনার বিষয়টি জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ ছাড়া, পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও ফিরিয়ে আনার মনোভাবের ওপর নির্ভর করবে।
গত বছরের ৭ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রস্তাবিত বহিঃসমর্পণ চুক্তি অনুসমর্থনের প্রস্তাব অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা। ফৌজদারি মামলায় বিচারাধীন বা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি বিনিময়ের সুযোগ রেখে এ চুক্তি করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশ ও ভারত নিজেদের মধ্যে বন্দী বিনিময় করতে পারবে। এর আগে ২০১১ সালে অনুমোদন করা হয় দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হস্তান্তর চুক্তি (টিএসপি)। তবে এখন পর্যন্ত এসব চুক্তির আওতায় কোনো আসামি বা বন্দীকে ফেরত আনা হয়নি।
টিএসপি চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি ভারতে কেবল দণ্ডপ্রাপ্ত হলে তাঁকে দেশে সাজা খাটানোর জন্য ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। বহিঃসমর্পণ চুক্তি অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় বিচারাধীন বা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বিনিময় করার বিধান রয়েছে।
এ অবস্থায় নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কী মামলা করবে বা পদক্ষেপ নেবে, তার ওপরই সব নির্ভর করবে। ভারত সরকার দেখবে কারা তাঁকে পাসপোর্ট নিতে সহায়তা করেছেন৷ এ ছাড়া, তাঁর বিরুদ্ধে অন্য অভিযোগের বিষয়ও খতিয়ে দেখে বিচার করার পরই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এসব বিবেচনায় নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ফেরত আনার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ হতে পারে।
তবে বহিঃসমর্পণ চুক্তি অনুযায়ী ফেরত পাঠানোর সুযোগ আছে৷ এ ছাড়া, পুশ ব্যাক, কমনওয়েলথের হারারে িস্কমের অধীনেও এ ধরনের ব্যিক্তকে ফেরত পাঠানোর সুযোগ আছে৷
তবে নূর হোসেনকে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধ ভারত সরকার ইচ্ছা করলে প্রত্যাখ্যানও করতে পারে৷ এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের ইস্যুগুলো উত্থাপন করতে পারে। মূলত ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মনোভাবের ওপরই নির্ভর করে এ ধরনের বিনিময়৷
ভারত থেকে একটি কূটনৈতিক সূত্র বলেছে, দুই দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে বিষয়টি দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সুরাহা করা যায়৷
জেরা চলছে: সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, প্রথম পর্যায়ে নূর হোসেনরা কীভাবে ও কোন সীমান্ত পার হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছেন, ইন্দ্রপ্রস্থ আবাসনে আসার আগে তাঁরা কোথায় ছিলেন, কারা এখানে থাকতে সাহায্য করেছেন, কলকাতায় কাদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ রয়েছে ইত্যাদি বিষয় জেরা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিষয়টিও তাঁরা জেনে নিচ্ছেন জেরার মাধ্যমে। তাঁদের কাছে মোবাইল ফোনের যেসব সিম পাওয়া গেছে, সেসব সিম কীভাবে কেনা হয়েছে বা ওই সিমের মাধ্যমে কোথায় কোথায় কথা বলা হয়েছে, তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে৷
@রোজিনা ইসলাম, ঢাকা ও অমর সাহা, কলকাতা

No comments

Powered by Blogger.