শাসনব্যবস্থার নাম নূর হোসেন!

নূর হোসেন শাসনব্যবস্থার নাম। এই শাসন জন লক বা রুশোরা শিখিয়ে দেননি। এটা একান্তভাবে স্থানীয়। নূর হোসেন স্থানীয় এজেন্ট। তবে এর শিকড়টা ওপরে। পুলিশের একজন বড় কর্তার বরাতে সম্প্রতি স্থানীয় পত্রিকায় যে খবর বেরোল, তার সারকথা হলো ওই কর্মকর্তাটি বলেছেন, নূর হোসেনদের আর জন্ম হতে দেওয়া হবে না। এই অপশাসন কোনো স্থানীয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জিরো পয়েন্টের নূর হোসেন রুশোদের শাসন ফিরিয়ে আনতে রক্ত দিয়েছিল। সেটা ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার চোরাগলি দিয়ে এই নূর হোসেনদের জন্ম। কলকাতায় নূর হোসেনের গ্রেপ্তার একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে থাকতে পারে। কারণ, এটা আইনের শাসনের কোনো স্বাভাবিক অনুশীলন কি না, সেটা বিরাট প্রশ্ন। তবে কলকাতা পুলিশ নূর হোসেনকে আট দিনের রিমান্ড পাওয়ার খবরে নূরের স্বজনদের জন্য একটা স্বস্তি আছে। সেটা হলো নূর অপঘাতে মরবে না। জুতার ফিতা দিয়ে ফাঁস বানিয়ে নূর আত্মহত্যার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হবে। তবে নূর হোসেন আট দিন ধরে যেটা বলবেন, সেটা যদি কোনো কারণে পশ্চিমবঙ্গের আদালতের রেকর্ডভুক্ত হয়, তাহলে আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করতে পারি। কিন্তু কলকাতার পুলিশ যদি অবৈধ অনুপ্রবেশ কিংবা অবৈধ অস্ত্র বহনের দায়ে গ্রেপ্তার হন, তাহলে তার প্রত্যাবাসন দীর্ঘায়িত হলে অবাক হব না। আবার দ্রুতও হতে পারে। পুলিশ রিপোর্ট পেয়েই তাঁকে ফেরত পাঠাতে আদালত আদেশ দিতে পারেন। অনুপ চেটিয়ার গ্রেপ্তারের কথা মনে পড়ছে। শ্যামলীর একটি বাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। বাংলাদেশ তাঁকে নানা বিবেচনায় চট করে ফেরত দেবে না। তাই দাঁড় করানো হলো আইনি যুক্তি। অথচ বাংলাদেশ চাইলে তাঁর প্রত্যাবাসনে প্রায় দুই দশক কেটে যেত না। প্রত্যাবাসন চুক্তি না থাকা কোনো বড় যুক্তি নয়।
কারণ, আইন যেটা গোড়া থেকেই বহাল আছে তাতে বলা ছিল, নির্বাহী আদেশ দিয়ে কারও প্রত্যাবাসন যেকোনো সময় হতে পারে। অবশ্য বিশ্বজুড়ে প্রত্যাবাসন সব সময়ই একটি গোলমেলে বিষয়। আইনে যা–ই বলা থাকুক না কেন, এর একটি রাজনৈতিক মাত্রা থাকে। আর সেটা এক ঘটনা থেকে আরেক ঘটনায় বদলায়। নূর হোসেনের ক্ষেত্রে কী ঘটে, সেটা দেখার জন্য আমরা অপেক্ষায় থাকব। বাংলাদেশ তাঁকে ঘিরে কীভাবে আন্দোলিত, সেটা কলকাতার কাউকে বেশি বুঝিয়ে বলতে হবে না। নূর হোসেনের বিচার একটি চ্যালেঞ্জ বয়ে এনেছে সরকারের জন্য। তাঁকে কত দ্রুত বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে, তাঁর সঙ্গে হয়তো একদিন বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিতে পারে। একদিন কড়া গুনে যখন বর্তমান সরকারের বিপর্যয়ের কারণ গ্রন্থিত হবে, তখন সেখানে নূর হোসেন আর সেভেন মার্ডার লাল হরফেই লেখা হবে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে তাঁর দপ্তরে আমাকে বললেন, মেজর আরিফ ১৬৪ ধারায় যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা কখনো উল্টে যাবে না। আমি তাঁকে জজ মিয়ার গল্পের কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন, পৃথিবী উল্টাবে কিন্তু এই ১৬৪ ধারা উল্টাবে না। এটা সত্যি হলে আমি এবং আপনারা হয়তো তার আেক্ষপের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন। কারণ, তিনি বলছিলেন যে সাত সদস্যের শক্তিশালী কমিটি, যার নিচের পদে যিনি আছেন তিনিও উপসচিব পদমর্যাদার, তাঁরা কত দীর্ঘ সময় নেওয়ার পরও ঘটনার কারণ বলতে পারল না। আর তাঁদের ব্রিফিংকে বড় করে দেখা হলো, অথচ পুলিশ ১৬৪ ধারার জবানবন্দি আদায়কে বড় করে দেখতে মিডিয়া এবং টক শো তারকারা বিফল হলো। আমি তাঁর সঙ্গে একমত। তবে এই ১৬৪ ধারার জবানবন্দিটা উইপোকায় কাটবে না,
তা হলফ করে বলা যাবে না। এর আগে নরসিংদীর পৌর চেয়ারম্যান হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি দুর্দান্ত ১৬৪ ধারার জবানবন্দির কথা আমরা জেনেছিলাম। সেই জবানবন্দি কতটা দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করা হয়েছে, সেটা আজ আর কারও আগ্রহের বিষয় নয়। নারায়ণগঞ্জকে আপনারা বাসি হলে মিডিয়ার সামনে নতুন খোরাক, বড় খোরাক আসবে। সবই তো স্বাভাবিক হয়ে আসে। ত্বকীর আলোকচিত্র কী আশ্চর্য শান্ত স্থির হয়ে আছে। তার বাবা-মা এবং ছোট ভাইয়ের আলাদা একটি জগৎ গড়ে উঠেছে। সেখানে তারা হাসিখুিশ থাকেন! অতিথি এলে তাঁরা এমন করে আপ্যায়ন করেন যাতে মনে হয় ত্বকী বেড়াতে গেছে। এ রকমই হাসিমাখা একটি বাংলাদেশ গড়ে উঠছে। এই বাংলাদেশে আইনের শাসন নেই। নূর হোসেনীয় শাসন আছে। নারায়ণগঞ্জের জিডিপি জিএনপি যদি ‘ওসমোনামিক্স’ নির্ভর হয়, তাহলে নূর হোসেন একটি বড়সড় বহুমাত্রিক কারখানা। এই কারখানায় মাদক, বালু (প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ লুটেরা), পরিবহন, চাঁদাবাজি আরও কত কী উৎপন্ন হয়। একজন ব্যবসায়ী আমাকে বলেন, তিনি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা (করবিহীন কালোটাকা) কামাই করতেন। সেই টাকার ভাগ বহু রাস্তায় চলে যায়। বিচিত্র পেশার মানুষ তারা। তাতে কে নেই, সেটা গবেষণার বিষয়। এটাই নূর হোসেনীয় শাসনব্যবস্থা। এই শহরে যেখানে নৈতিকতা, মূল্যবোধ আইনের শাসন ঠক্কর খায়, সেখানে নূর হোসেনের কালোটাকার বস্তা হলো স্টিম রোলার। সব সমান করে দেয়। সব রাস্তা এসে নূর হোসেনে থমকে দাঁড়ায়। সব স্রোত নূর হোসেনের মোহনায় পথ হারায়। একজন নূর হোসেনের অন্তর্ধানে তাঁর (অপ) শাসন হোঁচট খেয়েছে। তবে চলছে। নূর হোসেনের গ্রেপ্তারে এটা ভেঙে পড়বে না।
সবার আড়ালে কিংবা সবার চোখের সামনেই অসম্ভব স্পর্ধা নিয়ে আরও নূর হোসেন আসছে। বেড়ে উঠছে। ওদেরই ভৌতিক মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। প্রমাণ দিচ্ছি। নূর হোসেনের সাত সঙ্গীর নামে সরকারিভাবে ছাড়পত্র দেওয়া নয়টি অস্ত্র পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছে। আসুন একটি দৃশ্য কল্পনা করি। মোটেই বলিউড মার্কা নয়। বাস্তব৷ নূর হোসেনের কাছে দুটি বৈধ অস্ত্র। আর সেখানে একসঙ্গে তাঁর সাত সঙ্গী নয়টি বৈধ অস্ত্র নিয়ে হাজির হলো। তাহলে কী দাঁড়াল। নূর হোসেন সেনাপতি। তাঁর একটি সশস্ত্র প্রাইভেট বাহিনী আছে। কেন ওই অস্ত্রগুলো জারি করা হয়েছিল, এগুলো একদিনে জারি করা হয়নি, তাহলে কেন রাতারাতি এগুলো বাজেয়াপ্ত করা হলো? এই রাষ্ট্র, এই শাসনব্যবস্থা তা খতিয়ে দেখতে প্রস্তুত নয়। কারণ আইনের শাসনের শর্তে ওগুলো বিতরণ করা হয়নি। সারা দেশে অবৈধ অস্ত্রের অভিযান লাটে উঠেছে। কারণ কী, এই যে নূর হোসেনদের হাতে বৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। তারা অলিগার্কি বা কতিপয়তন্ত্রের অনুরাগী, ভক্ত নয়। তারাই অলিগার্কির প্রতিভূদের বাঁচিয়ে রাখছে। এই দানবদের রুখতে হলে একটাই রাস্তা। গণজাগরণ। সামাজিক প্রতিরোধ। আইনের শাসন৷ নারায়ণগঞ্জ পথ দেখাতে পারে। ত্বকী হত্যাকােণ্ডর পর অাশ্চর্য পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতিবাদী কণ্ঠ ক্রমেই উচ্চকিত। সন্তান-স্বজনহারা পরিবার–পরিজন ভাষা পাচ্ছে। সে কারণেই নূর হোসেনের গ্রেপ্তারের খবরে মানুষ ত্বরিত প্রশ্ন তুলছে, তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হবে তো? কারণ বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো নূর হোসেন। জেরার জবাবে তিনি এমন সব তথ্য দিচ্ছেন, যাতে অলিগার্কির সোপানগুলো কেঁপে উঠছে। তাই এখন একজন সন্দেহভাজন ভয়ংকর খুনি নূর হোসেনের মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচার লাভের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে সোচ্চার ও সজাগ থাকার সময় এসেছে। তার গ্রেপ্তারের খবর পৌঁছানোর পর সাধারণ মানুষকে তাঁর নিরাপত্তার ব্যাপারেই সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল থাকতে দেখা গেছে।
নারায়ণগঞ্জ থেকে ফিরে
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.