যে ইতিহাস জানাতে হতো… by জোবাইদা নাসরীন

যুদ্ধে যৌন সহিংসতা বন্ধ করার অভিপ্রায় নিয়ে গেল সপ্তাহে গ্লোবাল সামিট-১৪ অনুষ্ঠিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে৷ যুদ্ধের সময়ে নারীর ওপর নানা ধরনের যৌন নির্যাতন বন্ধ করার প্রস্তাব ও পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পূর্ব লন্ডনের ডকল্যান্ডের এক্সেল এক্সিবিশন সেন্টারে হয় এই সম্মেলন৷ চার দিন ধরে রকমারি কর্মসূচি দিয়ে মুড়ে থাকা এই সামিটে অংশ নেয় বিশ্বের ১১৩টি দেশ, ৪৮টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ১০০-এর বেশি এনজিও এবং আন্তর্জাতিক অংশীদার, ৬৩০ জনেরও বেশি সরকারি কর্মকর্তা, ৯৩০ জনের বেশি বিশেষজ্ঞ৷

যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ কিংবা অন্য যেকোনো ধরনের হানাহানিতে নারীর ওপর নির্যাতন একটি বড় অংশজুড়ে থাকে, যার অন্যতম হলো ধর্ষণ৷ বলা হয়, ধর্ষণ হলো যুদ্ধের হাতিয়ার৷ যুদ্ধ, সহিংসতা ও এর সঙ্গে লিঙ্গীয় দেনদরবার নিয়ে একাডেমিক জগতে নানা ধরনের বাতচিত জারি থাকলেও যৌন নির্যাতন বন্ধ করা এতগুলো দেশের একত্রে বোঝাপড়ায় এই বিষয়ে নিয়ে এত বড় আয়োজন এই প্রথম৷
এর উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ এবং ইউএনএইচআরের বিশেষ দূত হলিউড অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি৷ এই সামিট অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ; যার একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো যুদ্ধের সময়ে যৌন সহিংসতার প্রামাণ্যকরণ আরও জোরদার করা৷ কেননা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতিত নারীর জবানবন্দি শোনা যায় না, কিংবা শোনা গেলেও সেটিকে সহিংসতার সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় না; যদিও বর্তমানে এই আখ্যানগুলো খুবই জোরালোভাবে দেখা হচ্ছে, বিশেষ করে সহিংসতার ধরন ও গভীরতা মাপতে৷ আরেকটি উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধে নির্যাতিত এবং যৌন নির্যাতনের শিকার যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের প্রতি সর্বোচ্চ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান৷ বলা হয়েছে, তাঁদের প্রতি এই সমর্থন ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক কৌশলগত সমন্বয়েরও অগ্রগতি হবে৷ এই সামিটের প্রধান লক্ষ্য হলো যুদ্ধের সময়ে নারীর ওপর নানা ধরনের যৌন নির্যাতন বন্ধের জন্য পৃথিবীজুড়ে জনমত তৈরি করা, বিশেষ করে যখন ধর্ষণসহ নারীর ওপর নানা ধরনের যৌন নিপীড়নকে যুদ্ধের সময়ে হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয় এবং এটিকে যুদ্ধের মেজাজের সঙ্গে গিট্টু বেঁধে সহনীয় করে তোলার চেষ্টা করা হয় ও সীমিত পরিসরে আলোচিত থাকে৷

দুই
বাংলাদেশের জন্য এই সামিটটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য, বিশ্ব যে কারণে আজ এক হয়েছে, যে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা এতগুলো দেশকে একটি পাটাতনে এনেছে, বাংলাদেশের মানুষ সেই নির্যাতনের পথেই রক্তাক্ত হয়েছে, আমরা সেই নির্যাতনেরই অংশ৷ এই সামিটের মাত্র ৪৩ বছর আগে গণহত্যা ও ভয়াবহ নির্যাতনের জমিতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি বিশ্বকে জানাতে পারত তার সেই নারীদের নির্যাতনের ইতিহাস৷ অন্য অনেক দেশের যুদ্ধের ইতিহাসে নারীর ওপর সহিংসতার বিষয়টি মূল কেন্দ্রে থাকলেও বাদ পড়েছে বাংলাদেশে প্রসঙ্গ৷ তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, কেন এই সম্মেলনে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক দুই লাখ নারীর ওপর নির্যাতনের বিষয়টি যুক্ত হয়নি? যদিও এতে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদলও৷ কিন্তু তারা এ বিষয়ে জোরালো অবস্থান নেয়নি৷ সুযোগ ছিল, পুরো বিশ্বের কাছে এই নির্যাতনের তথ্য জানান দিয়ে পাকিস্তানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য দাবি তোলা৷ কিন্তু অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, এই পুরো সামিটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি৷ তবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নারীদের ওপর সংঘটিত যৌন নির্যাতন নিয়ে একটি সেশনে কথা বলেছেন ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের রিডার নয়নিকা মুখার্জি৷

তিন
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণ এবং নানা ধরনের যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের অনেকেই আত্মহত্যা করেছেন, কেউ কেউ চলে গেছেন পাকিস্তানে, কেউ লুকিয়েছেন নিজের পরিচয়৷ কেউ বা চলে গেছেন অন্য দেশে৷ আর তাঁদের মধ্য থেকেই জীবনসায়াহ্নে এসে বললেন সেই নির্যাতনের কথা, ইতিহাসের কথা৷ বীরাঙ্গনারা অনেকেই মারা গেছেন৷ তাই তাঁদের সেই নির্যাতনের ইতিহাস আলাদা কোনো ইতিহাস নয়, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তির ইতিহাস৷ আমাদের এই নির্যাতনের বিষয় আমরা বিশ্বকে জানাতে চাই৷ এই নির্যাতনের বিচার চাই৷ অার সেটি জানাতে লন্ডনেরই কিছু মানুষ সেই নির্যাতনের ছবিসংবলিত প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়েছেন, বিশ্বকে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, স্মরণ করানোর চেষ্টা করেছেন সেই নির্যাতনের ইতিহাসকে, যেটি এই সামিটে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়নি৷ কেননা, বিশ্বকে জানতে হবে, মনে রাখতে হবে সেই নারীদের, যাঁরা নির্যাতনের ইতিহাস সঙ্গে করেই বেঁচে ছিলেন, বেঁচে আছেন৷ আর একজন বীরাঙ্গনা যখন মারা যান, তাঁর সঙ্গে চলে যায় তাঁর ইতিহাস, বাংলাদেশে নামক রাষ্ট্রটির ইতিহাসও৷
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.