রাজপুত্র নয়, ভূমিপুত্র! by মিজানুর রহমান খান

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারতে এত বড় তাৎপর্যমণ্ডিত নির্বাচন আর হয়নি৷ এ নির্বাচন উত্তরাধিকারের রাজনীিতর প্রতি এত বড় হুমকি বয়ে এনেছে৷ অবশ্য এটাও মনে করার কারণ নেই যে এর ফলাফল মি. মোদি বা তাঁর দলের প্রতি একটি ব্ল্যাংক চেক৷ বামেরা বাম বলে হারেনি৷ গান্ধীবাদীরা গান্ধী বলে হারেনি৷ বাংলাদেশ তাই প্রথম পাঠ নিতে পারে যে কোনো ধরনের জারিজুরি চলবে না৷ সুশাসন দাও, না পারলে ভাগাড়ে যাও৷ কংগ্রেসের এক দশকের শাসন প্রধানত অযোগ্য, সন্দেহজনক ও পীড়নমূলক বলেই ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন৷ প্রবৃদ্ধি, চাকরি, মুদ্রাস্ফীতি রোধ ও কম দুর্নীতি যদি মোদি শাসন নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে তাকে দুর্ভোগ সইতে হবে৷ বিড়ম্বনা দেখতে আগামী পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে না৷ মোদিমাদকতা বিস্বাদ ঠেকতে সময় লাগবে না৷ মোদি ও তাঁর মিত্ররা এখন টালমাটাল জোয়ার দেখছেন৷ তবে ভাটির টান না দেখতে তাঁদের সতর্ক থাকতে হবে৷

নরেন্দ্র মোদির অগ্নিপরীক্ষা হবে আগামী লোকসভা নির্বাচনে৷ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীিতর এটা পরিহাস যে এরা জোয়ারে আসে৷ ভাটায় ভেসে যায়৷ ভাগ্যিস, মোদি দুই-তৃতীয়াংশ করায়ত্ত করেননি৷ কারণ, সাতচল্লিশ-পরবর্তী উপমহাদেশে যে দলই দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেয়েছে, তারাই অঘটন ঘটিয়েছে৷ রাজনৈতিক দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েছে৷ তবে মাজাভাঙা বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেসকে দেখলে চলবে না৷ ভারতীয় শাসনব্যবস্থা বাংলাদেশের মতো নয় যে একজন ব্যক্তি মোদি যা ইচ্ছা তা–ই করতে পারবেন৷ সেখানে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ পদ্ধতিগতভােবই সীমিত থাকবে৷ দলের ওপর কর্তৃত্ব এবং সরকারের ওপর কর্তৃত্ব—এ দুটিই মোদি বাংলাদেশ স্টাইলে একসঙ্গে প্রয়োগ করতে পারবেন না৷ বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে বলে সংসদে মোদির ক্ষমতাও অনিয়ন্ত্রিত থাকবে না৷ ভারতের ২৪৫ সদস্যের উচ্চকক্ষে বিজেপির মাত্র ৬১টি আসন রয়েছে৷ রাজ্যের বিধানসভায় কোন দলের কত হিম্মত, তার ওপর ভিত্তি করেই উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন করা হয়৷ আর সেখানে কংগ্রেস অন্তত দুই বছর নাগাদ শক্তিমানই থাকছে৷ কর, বিদেশি বিনিয়োগ ও সাংবিধানিক পরিবর্তন-সংক্রান্ত আইন পাস করতে হলে রাজ্যসভার অনুমোদন লাগবে৷
মোদি নিশ্চিতভাবেই ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বরপুত্র৷ ঝানু অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে মোদি তুলনীয় হবেন না৷ মোদি মোদিই থাকবেন৷ তাঁর পুনর্জন্ম ঘটবে না৷ তাঁকে সম্ভাব্য সুশাসক হিসেবে যাচাই করতে গিয়ে আমরা মনে রাখব, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আইনের শাসনের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না৷ ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালে গুজরাটে কয়েক ডজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটে৷ এর মধ্যে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত অন্তত ২০ জনের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন৷ ২০০৪ সালে পুলিশ চারজনকে গুলি করে হত্যা করে এই অভিযোগে যে তাঁরা মোদিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিলেন৷ এর মধ্যে ১৯ বছরের তরুণী ইশরাত জাহানও ছিলেন৷ সাক্ষ্য-প্রমাণের আগেই মোদি প্রকাশ্যে ওই তরুণীকে খুনি বলেছিলেন৷ সিবিআই পরে তদন্ত করে দেখে, পুরো ঘটনাই সাজানো৷ মোদি এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন৷ (সিএনএন, ১৬ মে, ২০১৪)৷
মোদির বিরুদ্ধে কখনো ফৌজদারি মামলা হয়নি৷ তবে তাঁর ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ যে মাত্র এক কোটি রুপি, সেটা মানুষ বিশ্বাস করেছে৷ পরিবারবিবাগি মোদির ছেলেমেয়ে না থাকাটা হয়তো ভালোই হয়েছে৷ অন্তত উপমহাদেশীয় পরিবারতন্ত্রের পরিচিত ভাইরাস থেকে তিনি মুক্ত থাকবেন৷
ইন্দিরা শাসনে ভিন্নমত ও বিরোধী দলকে কংগ্রেস সমীহ করেনি৷ ফলে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়৷ আবার কংগ্রেসও অগান্ধী বড় নেতা তৈরি করেনি৷ ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় গান্ধী পরিবার পরিবারতন্ত্র ও গোষ্ঠীতন্ত্রকে মহীয়ান করেছে৷ তারা এবং তাদের মিত্ররা জবরদস্তি ধারণা তৈরি করেছে সেক্যুলার ও অগ্রসর ধারার প্রতিভূ থাকবে কেবল তারাই৷ তারাই হবে সর্বেসর্বা, ঐতিহ্যবাহী মূল স্রোতোধারা৷ তারা পণ করেছিল, ‘গান্ধী’ শব্দটি পানসে হতে দেওয়া যাবে না৷
আমরা মনে রাখব, ইন্দিরা গান্ধীর কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের পটভূমিতে ভারতে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ ও ডানপন্থীদের উত্থান ঘটেছিল৷ বাংলাদেশেও মোটামুটি তাই৷ বঙ্গবন্ধু মুজিবের বাকশালের বিরুদ্ধে চরমপন্থী জাসদ ও মুখ্যত ডানপন্থী শক্তির মোর্চা হিসেবে বিএনপি জন্ম নিয়েছিল৷ একিট ভোটের ফলাফল দেখে একটি জাতির ধর্মীয় ও আদর্শগত মেরুকরণের গভীরতা যাচাই বা তাকে নিষ্পত্তিকারক বলা যায় না৷ মোদি এতটা শক্তিমান নন যে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে হিন্দুত্ববাদ চাপাবেন৷ নেহরুরা গোড়াতেই ধর্মনিরপেক্ষতার গাঢ় ছাপ দিয়ে গেছেন, যা মোদি চাইলেও মুছে দিতে পারবেন না৷ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বামেদের প্রত্যাখ্যান করে কম আদর্শবাদী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লুফে নিয়েছে৷ সেভাবে ভারত এবার হার্ভার্ড–ফেরত রাহুলকেও বিমুখ করেছে৷ তারা দুর্নীতি ও আত্ম-অহমিকায় দীর্ণ গান্ধী পরিবার ও তার বলয়ের রাজনীতিকে নাকচ করে মোদিকে বেছে নিয়েছে৷
চাপানো সত্ত্বেও জিয়া-এরশাদের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ মানুষ নিয়েছিল? নেয়নি৷ ১৫তম সংশোধনীর উন্মাদনা? এটাও মানুষ নেয়নি৷ মোদির হিন্দুত্ববাদও মানুষ নেবে না৷ গুজরাটের দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে মোদির বিজয় কী নির্দেশ করে? সেটা এই যে জুজুর ভয় জনগণ কাটিয়ে ওঠে৷ জনতা ক্ষণে ক্ষণে খোলস পাল্টায়৷ আদর্শের পানীয়ে বুঁদ থাকা তার ধাতে সয় না৷ আপনি তাকে ভাত দেবেন না, কিন্তু তার জীবনে কিল মারার গোঁসাই হবেন, তা হবে না৷
এটা সংসদীয় গণতন্ত্র৷ মোদি নিজে কিন্তু দুটি আসনেই জিতেছেন৷ বাংলাদেশে দুই নেত্রীর উত্থানের সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি যেভাবে আলগা, সেভাবে মোদি ভারতের ‘নীচু জাতির’ ক্ষমতায়নের অবিসংবাদিত প্রতীক নন৷ বরং ‘পূতিগন্ধময় পুঁজিবাদেরই’ প্রতীক৷ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদির ম্যাজিক ছিল অর্থনৈতিক সাফল্য, যা এখন তাঁকে দিল্লির চাবি এনে দিয়েছে৷ গুজরাটে টাটাদের তিনিই টেনেছেন৷ তাঁর মেয়াদের ১২টি অর্থবছরের মধ্যে ১১ অর্থবছরে গুজরাটের প্রবৃদ্ধি জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে৷ গুজরাটের মাথাপিছু আয় তিনি চার গুণ করেছেন৷ সেটা ৬১ হাজার ২২০ রুপিতে নিয়েছেন৷ জাতীয় গড় আয়ের চেয়ে এটা বেশি৷ বাংলাদেশে আমাদের প্রবৃদ্ধির কৃত্রিম গল্প শুনতে হয়৷ আইসিএবি-প্রথম আলো আয়োজিত সভায় এক বক্তা বলেন, সরকার বাধা দিলেও ৫ শতাংশ জিডিপি আটকাতে পারবে না৷ তার মানে, আমাদের ৬-৭ শতাংশের জিডিপিতে সরকারি কৃতিত্ব সামান্য৷
রাহুল পরাজয় স্বীকার করেছেন, পদত্যাগ করেননি৷ তবে ফলাফল রাজনীতির রাজপুত্রদের জন্য এই বার্তা স্পষ্ট করেছে যে তাঁদের প্রতি সাধারণ মানুষের ভাবাবেগ স্তিমিত হয়ে এসেছে৷ কিন্তু অকৃতজ্ঞ বলে জনগণের ওপর প্রতিশোধ নেওয়া যাবে না৷ নেতৃত্বের যোগ্যতা ও সততার ঘাটতিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে বা জাতির কোনো ক্রান্তিকালের ত্রাতা হিসেবে কারও ভূমিকা পালনজনিত আবেগকে যথেচ্ছ ব্যবহার মানুষ মানবে না৷
তবে অতীতকাতরতা কতটা কাজ দিয়েছে, সেটা লক্ষ করতে হবে বাংলাদেশকে৷ কারণ, তার রাজনীতি এখনো অতীতমুখী৷ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বর্তমান নেতৃত্ব বিজেপির সঙ্গে নিজেদের মেলাতে পারে৷ তিন নেতা-নেত্রীরই উত্থান আশির দশকে, প্রায় একই সময়ে৷
ভারত একজন ভূমিপুত্রকে দুই হাত উজাড় করে দিয়েছে এমন একটি সময়ে, যখন ভারতীয় ভাবাবেগের তোড়ে ইতালি বংশোদ্ভূত সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি৷ কংগ্রেসের এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে যে যাকে প্রধানমন্ত্রী করা যায় না, তাঁকে দলের কান্ডারি করা যায়৷ গান্ধী পরিবারের উচিত স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী কংগ্রেসকে অগান্ধী নেতৃত্বের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করা৷ ভারতের এবারের নির্বাচনী ফল গোটা উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে গোষ্ঠীতন্ত্রের অবসান ঘটানোর বার্তা পেঁৗছাবে কি?

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.