গান্ধী পরিবারের প্রভাব কমছে?

মোদি-ঢেউয়ের ঝাপটা ততক্ষণে একেবারে স্পষ্ট৷ নয়াদিল্লির জনপথের উঁচু দেয়ালঘেরা ১০ নম্বর বাড়ির বাইরে সাংবাদিকদের জটলা৷ কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর ওই সরকারি বাসভবন থেকে সোনিয়া নিজে বা তাঁর ছেলে দলের সহসভাপতি রাহুল গান্ধী বের হয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন, সবাই সেই প্রতীক্ষায়৷ সময় গড়াতেই থাকল, কিন্তু কারও দেখা নেই৷ সূত্রের মাধ্যমে জানা গেল, মা-ছেলে তখন উত্তর প্রদেশের আমেথি আসনের ফল দেখার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছেন৷ অথচ এটা সেই আসন, যেখানে ২০০৯ সালে রাহুল তিন লাখ ৭০ হাজার ভোটের বড় ব্যবধানে জিতেছিলেন৷ শেষ পর্যন্ত ফল এল৷ গান্ধী পরিবারের ঘাঁটি বলে পরিচিত আমেথিতে রাহুল ঠিকই জিতেছেন, তবে ভোটের ব্যবধানটাতেই কংগ্রেসের দুরবস্থার চিত্র স্পষ্ট৷ রাহুল জিতেছেন মাত্র এক লাখ সাত হাজার ভোটের ব্যবধানে৷ ভারতের রাজনীতিতে ঐতিহ্য ও প্রভাবশালী গান্ধী পরিবারের প্রভাব তলানিতে ঠেকার যে চিত্র ২০১৪ সাল দেখল, তার সাক্ষী হয়ে থাকল আমেথিও৷
এবারের লোকসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়া একজন মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রকাশ্যে এটা কখনোই বলতে পারি না৷ তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই লজ্জাজনক পরাজয়ের জন্য যদি মনমোহন সিংয়ের দ্বিতীয় মেয়াদের ইউপিএ সরকার দায়ী হয়ে থাকে, তাহলে কোনো প্রকার স্পষ্ট বার্তা-বিবর্জিত একটি নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর জন্য রাহুলও সমান দায়ী৷’ ছেলে রাহুলকে সুরক্ষা দিতে সোনিয়া চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে ‘আমাদের সবাইকে দায় নিতে হবে’, এমন গোছের কথা বলেছিলেন৷ তবে দলের এই শোচনীয় পরাজয়ে গান্ধী পরিবারের, বিশেষ করে রাহুলের ব্যর্থতা সামনে আসছেই৷ কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে রাহুলকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা না করলেও দুটি বিষয় সবার কাছে পরিষ্কার৷ রাহুলই সামনে থেকে প্রচারণা চালিয়েছেন, আর দলের প্রার্থী বাছাই করেছেন তিনিই৷ এমনকি প্রথা ভেঙে দলের ‘ওয়্যার-রুমের’ বদলে নির্বাচনী প্রচারণা কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু করা হয় রাহুলের তুঘলক লেনের বাসভবনকে৷ কংগ্রেস অতীতে নির্বাচনে হারলেও এবারের মতো করুণ অবস্থায় আগে কখনোই পড়তে হয়নি৷ ভারতের সবচেয়ে পুরোনো এ দলটি আসন এতটাই কম পেয়েছে যে পার্লামেন্টে তাদের প্রধান বিরোধী দল হওয়ার বিষয়টিও অনিশ্চিত৷ কংগ্রেসের একজন পরাজিত প্রার্থীর ভাষায়, ‘মোদি যখন বলেছেন, তিনি কংগ্রেসমুক্ত ভারত চান, প্রকৃতপক্ষে তিনি গান্ধীমুক্ত ভারতের কথা বলেছেন৷ প্রথমবারের মতো নেহরু-গান্ধী পরিবার রাজনৈতিকভাবে বিস্মৃত হওয়ার পথে পা রেখেছে৷’
অতীতে কংগ্রেস বিভিন্ন সময়ে ভেঙে গেছে৷ শারদ পাওয়ার ও পি চিদাম্বরমের মতো নেতারা কংগ্রেস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন৷ এবারও এমন গুঞ্জন শুরু হয়েছে তা এখনো নির্দিষ্ট মহলেই সীমাবদ্ধ রয়েছে৷ তবে কংগ্রেসের একজন নেতা বললেন, ‘পরাজয়ের এই গ্লানি কিছুটা থিতু হতে দিন৷ তোলপাড় শুরু হতে কিছুটা সময় নেবে৷’ গান্ধী পরিবারের—এবং দল হিসেবে কংগ্রেসেরও—সমস্যাটা হচ্ছে, শিগগিরই তাদের আরেকটি যুদ্ধে নামতে হতে পারে৷ জমি কেনা-বেচায় অবৈধভাবে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে গান্ধী পরিবারের জামাই রবার্ট ভদ্রের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হবে বলে মোদি যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, সেটা তিনি বাস্তবায়ন করলে লড়াইটা অবধারিত৷ একজন কংগ্রেস নেতার মতে, মোদি তাঁর ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ স্লোগান আরও সামনে এগিয়ে নিতে চাইলে সোনিয়া, রাহুল ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র—এই তিন গান্ধীকেই লড়াইয়ে নামতে হবে৷ সোনিয়া ও রাহুলের জনপ্রিয়তায় ভাটার টান আসার প্রেক্ষাপটে নির্বাচনী প্রচারণায় অধিকতর সম্মোহনী ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে উঠে আসেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী৷ তিনি এ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও এবারের নির্বাচনের ফলাফলের প্রতিক্রিয়ায় হয়তো সক্রিয় না হয়ে পারবেন না৷ মনে করা হচ্ছে, এখন তিন গান্ধীই দল ও পরিবারকে সামলানোর যুদ্ধে নামতে বাধ্য হবেন৷ অবশেষে ‘১০ জনপথ’-এর বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটল৷ সোনিয়া গান্ধী শেষ পর্যন্ত বললেন, ‘কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে আমি সব দায় নিলাম৷’ রাহুল গণমাধ্যমের সামনে আসবেন না বলে জানিয়ে দিলেন৷ তবে কংগ্রেসের একজন নেতার ভাষায়, ‘রাহুলকে কেবল দায় নিলেই চলবে না৷ তাঁকে আরও কিছু নিতে হবে৷ কারণ, আমরা তলিয়ে গেছি৷’ হিন্দুস্তান টাইমস৷

No comments

Powered by Blogger.