মোদির দিল্লি জয় এবং খালেদার সবুজ পাসপোর্ট by সোহরাব হাসান

গত শুক্রবারের পত্রিকায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একটি ব্যতিক্রমী খবর ছাপা হয়েছে৷ তিনি আগারগঁাওয়ে পাসপোর্ট অফিসে গিয়েছিলেন লাল পাসপোর্ট বদলে সবুজ পাসপোর্ট নেওয়ার জন্য৷ ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে খালেদা জিয়া লাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে আসছিলেন; সাংসদ হিসেবে৷ প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলের নেতা যা-ই থাকুন না কেন, তিনি বরাবর লাল পাসপোর্টের অধিকারী ছিলেন৷ কিন্তু গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় এখন সেই সুযোগ থাকছে না৷ তাই দুই দশকেরও বেশি সময় পর লাল পাসপোর্টের অধিকার হারালেন, কিংবা তঁাকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলো৷

অন্যদিকে, ভারতে ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি দেশটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন৷ সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, এবারের লোকসভা নির্বাচন বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে হয়নি, হয়েছে নরেন্দ্র মোদি ও অবশিষ্ট ভারতের মধ্যে৷ নরেন্দ্র মোদি জিতেছেন৷ কংগ্রেস ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে৷
লেখার শিরোনাম দেখে অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন নরেন্দ্র মোদির দিল্লি জয়ের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সবুজ পাসপোর্ট নেওয়ার সম্পর্ক কী? সম্পর্কটি হলো গণতন্ত্র থাকা বা না-থাকার৷ ভারতে গণতন্ত্র আছে বলেই বিরোধী দলে থেকেও নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় যেতে পেরেছেন এবং সেই নির্বাচনটি হয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের অধীনে৷ এর আগে বিজেপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল৷ এতে পরিষ্কার যে ভারতে কে ক্ষমতায় থাকল সেটি মুখ্য বিষয় নয়; মুখ্য বিষয় হলো জনগণ কাকে ক্ষমতায় দেখতে চায়৷
বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বিরোধী দল ক্ষমতায় গিয়েছে, এ রকম উদাহরণ নেই৷ সামরিক শাসকের মতো গণতান্ত্রিক সরকারগুলোও জোরজবরদস্তি করে নির্বাচনে জয়ী হতে চায়৷ একসময় আমরা আন্দোলন করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু করেছিলাম৷ কিন্তু সেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটিও ধরে রাখতে পারিনি; বিএনপি আইন করে এটি নিজের মতো ব্যবহার করতে চেয়েছিল৷ আর আওয়ামী লীগ নিজের সুবিধার জন্য উচ্চ আদালতের দোহাই দিয়ে আইনটিই ছেঁটে ফেলেছে৷
ফলে, ২০০৭ ও ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে মহাযুদ্ধের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ৷ ২০০৭ সালে দুই পক্ষ সমঝোতায় না আসায় দুই বছরের ‘জরুরি’ সরকার আসে৷ সেই সরকারকে আমরা যতই গালমন্দ করি না কেন, তারা অন্তত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েছিল৷ কিন্তু শেখ হাসিনার গণতান্ত্রিক সরকার সেটি দিতে পারেনি৷ ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের সদাশয় নির্বাচন কমিশন ‘সফল অস্ত্রোপচার’ করলেও রোগীকে বঁাচাতে পারেনি৷
ভারতে মোদির বিপুল বিজয় দেখে অনেকে মনে করেন, বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছে৷ ক্ষমতাসীন দল ও সরকার যত কৌশলই নিক না কেন, তারা নির্বাচনে গেলে জনরায়কে উল্টে দেওয়া কঠিন হতো৷ বিএনপির হিসাব ভুল হোক অথবা কূটকৌশলে আওয়ামী লীগ জয়ী হোক, হেরেছে গণতন্ত্র৷ গণতন্ত্রের মূল কথা হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যার যার অবস্থান থেকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে৷ কিন্তু নির্বাচন কমিশন থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ, কিংবা দুদক থেকে শুরু করে তথ্য কমিশন সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছে না বা করতে দেওয়া হচ্ছে না৷
দশম সংসদ গঠিত হওয়ার পর সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি মানুষের যে আস্থা ও আগ্রহ ছিল, তাও অবসিত হতে চলেছে৷ যে সংসদে সরকারের জবাবদিহি দূরের কথা, সামান্য সমালোচনাও করা যায় না, সেই সংসদের প্রতি মানুষের আস্থা থাকার কোনো কারণ নেই৷ সংসদ সরকারের রাবার স্ট্যাম্প নয়, পথনির্দেশক৷
গত দুই দশকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিযোগিতা করে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করেছে৷ তারা জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয়করণের চূড়ান্ত করেছে, এখনো করছে৷ সব জায়গায় ‘নিজস্ব লোক’ বসিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছে, এখনো চাইছে৷ এই নিজস্ব লোক বসানোর ফল যে কত ভয়াবহ হতে পারে, নারায়ণগঞ্জ তার জ্বলন্ত উদাহরণ৷
গত দুই দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলই নিজস্ব লোক বসায়৷ এই নিজস্ব লোকেরা সবচেয়ে অদক্ষ, সবচেয়ে অথর্ব এবং সবচেয়ে অসৎ৷ রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রায় সর্বত্র এখন সততা ও দক্ষতার দুর্ভিক্ষ চলছে৷
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির যাওয়া না-যাওয়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, একটি গণতান্ত্রিক দেশে, গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে এ রকম একটি নির্বাচন কীভাবে হতে পারে৷ ভারতে বা অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কি এ রকম একটি নির্বাচনের কথা চিন্তা করা যায়, যেখানে প্রধান বিরোধী দল অংশ নেবে না, অধিকাংশ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যাবেন, এমনকি যঁারা প্রকাশ্যে নির্বাচনে যাননি বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তঁারাও ‘নির্বাচিত’ হয়ে গেছেন৷ এর অর্থ আমাদের নেত্রা-নেত্রীরা এখনো গণতন্ত্রের উপযুক্ত হননি বা হওয়ার চেষ্টা করছেন না৷
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা জোর গলায় বলেছিলেন, এটি সংবিধান রক্ষার নির্বাচন৷ আসল নির্বাচনটি সবাইকে নিয়ে তঁারা পরে করবেন৷ এখন তঁারা বলছেন, পাঁচ বছরের এক দিন আগেও শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়বেন না৷ তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, পাঁচ বছর পরের নির্বাচনেও বিএনপি এল না এবং অাওয়ামী লীগ রওশন এরশাদের মতো আরেকজন পুতুল বিরোধী দলের নেতা বাচাই করতে সক্ষম হলো৷ আবারও খালেদা জিয়া সংসদের বাইরে থাকলেন এবং খালেদা জিয়া লাল পাসপোর্ট থেকে বঞ্চিত হলেন৷ তাতে আওয়ামী লীগের জেদ বজায় থাকলেও গণতন্ত্র বঁাচবে না, সামরিক স্বৈশাসকের সঙ্গে তার অবশিষ্ট ফারাকটিও মুছে যাবে৷
৫ জানুয়ারির আগে দেশি-বিদেশি উদ্যোগ সত্ত্বেও সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে যে সমঝোতা হলো না, তার প্রধান কারণ পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস৷ শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া কেউ-ই নিজেকে বিরোধী দলে দেখতে চান না৷ বিএনপির আশঙ্কা ছিল, হাসিনা সরকারের অধীনে নির্বাচন করলে তাদের জয়ের সম্ভাবনা নেই৷ আর জয়ী না হলে আরও পঁাচ বছর তাদের আওয়ামী লীগের অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হবে৷ সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে গিয়ে তাকে বৈধতা দেওয়া ঠিক হবে না৷ তাই নির্বাচনে গিয়ে পরাজয় বরণ করার চেয়ে বর্জন করাই শ্রেয় মনে করেছে দলটি৷ আর আওয়ামী লীগ যখন দেখল, তাদের জনপ্রিয়তার পারদ ক্রমেই নিচে নামছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেও সেটি ওঠানো যাচ্ছে না, তখন তারা বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচন করার ঝুঁকি নিল না৷
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার এই সমীকরণ এতটা প্রবল হতো না যদি তারা ক্ষমতায় থাকতে আইন অনুযায়ী সবকিছু চালাত৷ ১৯৯১-৯৬ সালে বিএনপি সরকার বিরোধী দলের ওপর যে নিপীড়ন চালাল, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তার বদলা নিতে শুরু করল৷ নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর, ফেনী হয়ে উঠল সন্ত্রাসের জনপদ৷ ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এসে বিরোধী দলের ওপর পীড়নের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল৷ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো ঘৃণ্য ঘটনা ঘটাল৷ ২০০৯ সালের আওয়ামী লীগ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল৷ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তারা বিরোধী দলের অস্তিত্বই অস্বীকার করে বসল৷ ২০০৭ সালে বিএনপির এবং ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হারানোর ভয়ের পেছনে এটিই ছিল মুখ্য কারণ৷ তারা নিজেরা যেহেতু অন্যের প্রতি স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করেছে, সেহেতু ভয় তাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে৷
রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস যে বিজেপির চেয়ে উত্তম, নেতা হিসেবে নরেন্দ্র মোদির চেয়ে রাহুল গান্ধী যে দক্ষ, সেই বিষয়টি কংগ্রেস নেতারা সে দেশের জনগণকে বোঝাতে পারেননি বলেই তারা নরেন্দ্র মোদিকে বেছে নিয়েছেন৷ অথবা কংগ্রেস বা ইউপিএ জোট জনগণের কাছে সুশাসন, সমৃদ্ধি ও দুর্নীতি উচ্ছেদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটি রাখতে পারেনি বলেই জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে৷
গণতন্ত্র মানলে জনগণের রায় মানতে হবে৷ ভারতে কংগ্রেস নেতারা মেনে নিয়েছেন৷ কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনেরা জনগণের সামনে সেই পরীক্ষা দিতেই রাজি হলেন না এবং প্রতিপক্ষকে মাঠের বাইরে রেখে ফাইনাল খেলায় নিজেকে জয়ী ঘোষণা করলেন৷
জনমত যদি আওয়ামী লীগের পক্ষেই থাকবে, তাহলে খালেদা জিয়াকে লাল পাসপোর্ট বদলে সবুজ পাসপোর্ট নিতে হলো কেন? নির্বাচনের আগে দেশি–বিদেশি সব জনমত জরিপ বলেছিল, বিএনপি জয়ী হবে৷ সে ক্ষেত্রে তঁারই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা৷ আর যদি জনমত জরিপ ভুলও হতো অন্তত তিনি বিরোধী দলের নেতা তো হতে পারতেন৷ নাকি আওয়ামী নেতারা তা-ও অস্বীকার করতে চান?

সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.