সেভেন মার্ডারের প্রধান আসামি নূর হোসেনের রক্ষিতা নীলাকে আটকের ৩ ঘণ্টার মধ্যেই ছেড়ে দিল পুলিশ

নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সেভেন মার্ডারের প্রধান আসামি পলাতক কাউন্সিলর নূর হোসেনের রক্ষিতা হিসেবে পরিচিত অন্যতম ঘনিষ্ঠ এবং সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস নীলাকে আটকের তিন ঘণ্টার মধ্যেই পর ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। রোববার বিকেল সাড়ে ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জের ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সামনে থেকে তাকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ও সদর মডেল থানা পুলিশের একটি টিম আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত সাড়ে ৮টায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।

এর আগে বিকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সংলগ্ন জেলা প্রশাসনের সার্কিট হাউসে সুশীল সমাজের গণশুনানিতে অংশ নেন নীলা। সেখান থেকে বেরিয়ে একটি মাইক্রোবাসে সিদ্ধিরগঞ্জ যাওয়ার পথে তাকে আটক করা হয়। নীলা এর আগে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, নূর হোসেন তাকে রক্ষিতা বানাতে চেয়েছিল। তাকে বিভিন্ন সময়ে ৩৫ লাখ টাকা মূল্যের গাড়ি উপহার দেয়া হয়। এছাড়া নূর হোসেনের কারণে নীলা তার স্বামীকেও ডিভোর্স দেন।
গত ৩০ এপ্রিল বিকালে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৬ জন এবং ১ মে সকালে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল। পেটে ছিল আঘাতের চিহ্ন। প্রতিটি লাশ ইটভর্তি দু’টি করে বস্তা বেঁধে ডুবিয়ে দেয়া হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র্যাব-১১ এর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেন নিহত প্যানেল মেয়র নজরুলের পরিবারের সদস্যরা। প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান গত ৪ মে অভিযোগ করেন, ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে র্যাবকে দিয়ে ওই সাতজনকে হত্যা করিয়েছেন কাউন্সিলর নূর হোসেন।
নীলাকে ‘রক্ষিতা’ বানাতে চেয়েছিল নূর হোসেন!
‘আমি কাউন্সিলর হওয়ার পরই নূর হোসেনের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে আমার ওপর। সে আমাকে রক্ষিত বানাতে চেয়েছিল। আমি নূরের চোখে সুন্দরী, এটাই আমার অপরাধ। এজন্য আমার জীবন এখন অভিশপ্ত। নূর হোসেনের ‘রক্ষিতা’ হইনি বলেই সব হারিয়ে আজ আমি নিঃস্ব। সাজানো-গোছানো সংসার ভেঙেছি, প্রাণপ্রিয় স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, এলাকার প্রায় সবাই আমাকে নূরের স্ত্রী হিসেবে জানলেও আমার সঙ্গে তার কোনো অধিকারের সম্পর্ক নেই। স্বামীর জীবন রক্ষায় নিজের জীবনের বিনিময়ে ‘সূক্ষ্ম’ চাতুরি করতে হয়েছে দীর্ঘদিন।’ সপ্তাহখানেক আগে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে কথাগুলো বলছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জের ৪, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস নীলা।
কথায় কথায় বলেন, নূর হোসেনের সঙ্গে হোটেল শেরাটনে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে রাতযাপন, একসঙ্গে ভারত সফরসহ নানা কথা।
নীলা বলেন, ‘বাবা হাজী আবদুল মোতালেবের রাজনীতির সুবাদে (৩০ বছর ধরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি) নূর হোসেনের সঙ্গে পরিচয়। ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর যোগাযোগ বাড়ে। এ সময়ই তার লোলুপদৃষ্টি পড়ে আমার ওপর।’ নূর হোসেন ‘প্যানেল মেয়র’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে আমাকে প্রচারণায় নামিয়ে লবিং করায়। কিন্তু এক ভোটের ব্যবধানে পরাজয় ঘটে নূরের। নূরের খপ্পরে পড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল মেয়র প্রার্থী আমার উকিল বাবা নজরুল কাকার (নিহত কাউন্সিলর নজরুল) বিপক্ষে ছিলাম। প্যানেল মেয়র নির্বাচন শেষ হওয়ার পর থেকেই ‘নূর চাচা’ প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ‘গা’য়ে পড়তে শুরু করে। আমার বাবা হাজী আবদুল মোতালেব, স্বামী আবু সায়েমসহ আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গেও সখ্য গড়ে তোলে। না চাইলেও নানা ধরনের সহযোগিতার চেষ্টা করেন। সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যাওয়ার আগে বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়িসহ দাঁড়িয়ে ফোন করে একসঙ্গে নিয়ে যেতেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত প্রার্থীদের সাক্ষাতের দিন পৃথক গাড়ি পাঠিয়ে আমাকে বঙ্গভবনে এনেছিল নূর। এর নেপথ্যের কারণ ছিল আমি যেন কারো পক্ষেরই না হয়ে (শামীম ওসমান কিংবা আইভী রহমানের) শুধু তার (নূরের) পক্ষেই থাকি। নূরের আকাঙ্ক্ষা ছিল নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জের এমপি-মেয়র হওয়া। নূর হোসেন প্রায়ই অহঙ্কার নিয়ে বলতেন, শামীম ওসমান-আইভীর চেয়ে আমি অনেক বেশি টাকার মালিক। জনপ্রিয়তা নয়, এখন টাকা থাকলেই সব হয়। নমিনেশন-ভোট কেনা যায়। আমার টাকার গন্ধে এমপি, ডিসি, এসপি, র্যাব, সার্কেল এসপি, ওসি, এসআইসহ রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ক্যাডাররা ঘুর ঘুর করে। অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ না করে উল্টো চামচামি করে।
নীলা জানান, ‘আমাকে পেতে নূর সূক্ষ্ম পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকে। আমার মন জয় করতে কাজে-অকাজে বাড়িতে গাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। সময়-অসময়ে শিমরাইল ট্রাকস্ট্যান্ডের নূরের কাউন্সিলর অফিসে ডেকে পাঠাতেন। কাজের অজুহাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখে আজগুবি গল্প করতেন। একদিন বলেই বসলেন, নীলা আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি এটা বোঝ না? তুমি চাইলে তোমাকে আলাদা বাড়ি-গাড়ি দিয়ে ‘রাজার হালে’ রাখতে পারি। তুমি কখন আসতে চাও বল। নূর হোসেনের এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ করে বলি আপনি আমার চাচা। বয়সের পার্থক্য দ্বিগুণ। এছাড়া স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার আমার। কী প্রয়োজনে আপনার সঙ্গে সম্পর্ক করব? প্রতিবাদের পর আমি নূরের ফোন ধরা বন্ধ করে বাড়িতে চলে আসি। বাইরে বেরুনো বন্ধ করে দিই। এ সময় নূর তার সহযোগী আরিফুল হক হাসান ও শাহজাহানকে বাড়িতে পাঠায়। একবারের জন্য হলেও নূর হোসেনের ফোন ধরতে বলেন। এ সময় নূর হোসেন ফোন করে বলেন, নীলা তুমি আমার সম্পর্কে জান, যা বলি তার চেয়েও বেশি করি। আমার কথা না শুনলে এবং কাছে না এলে বড় বিপদ হবে তোমার। তুমি স্বামীকে আর তোমার সন্তান হারাবে বাবাকে। এখন ভেবে সিদ্ধান্ত নাও তোমার স্বামী-সন্তানের ভবিষ্যঃ কোন দিকে দেবে।’
নীলা জানান, ‘এসব ঘটনার মধ্যেই নূর তার সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে এলাকায় নানা অপপ্রচার ছড়াতে থাকে। এক সময় এলাকার মানুষের মুখে মুখে রটে যায় নূর হোসেন নীলাকে গোপনে বিয়ে করেছে। বিষয়টি আমাকে বড় দুশ্চিন্তায় ফেলে। স্বামীসহ পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করি। নূরের ঘোষণা দেয়া ‘স্ত্রী পরিচয়’-এর কারণে আমাকে আপনজনরাও অবিশ্বাস করতে থাকে। আমাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে। আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে নূর হোসেন। একদিন ফোনে বলেন, ৩ দিনের মধ্যে স্বামীকে ডিভোর্স দিতে হবে। নইলে তোমার প্রিয় সন্তানের মুখ থেকে আজীবনের জন্য বাবা ডাক বন্ধ হয়ে যাবে।’
নিরূপায় হয়ে আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করি নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জের হাজার হাজার মানুষ নূর হোসেনের নির্যাতনের শিকার। মানসিক-শারীরিকভাবে অনেকেই পঙ্গু। বিচার চাইতে গিয়ে হামলা-মামলায় এলাকাছাড়া। আমি বিচার চাইতে গেলে পরিণাম হয়তো আরও ভয়াবহ হবে। কারণ থানা পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় প্রশাসনের শীর্ষ ক্ষমতাধররাও নূর হোসেনের কেনা ‘গোলাম’। এজন্য কোনো ধরনের বাড়াবাড়ি না করে বরং মেয়ে যেন বাবাহারা না হয়, সেদিক বিবেচনায় নিয়ে সাজানো-গোছানো সুখের সংসার তছনছ করি। স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনি।
হোটেল শেরাটনে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে রাতযাপন এবং একই সঙ্গে ভারত সফর প্রসঙ্গে কাউন্সিলর নীলার দাবি, তখন আমার মেয়ের বয়স (অফিয়া জাহান সুমাইতা) ৫ বছর। তাকে দার্জিলিংয়ের একটি স্কুলে ভর্তির প্রয়োজনে ভারত যাওয়া হয়। ভর্তির সময় নূর হোসেন আমার সন্তানের অভিভাবক হিসেবে স্বাক্ষরও করেন। তবে তার আরেক বন্ধুর ফ্যামিলির সঙ্গে যাওয়ার কারণে পাশাপাশি রুমে থাকলেও কোনো অঘটন ঘটেনি। আর হোটেল শেরাটনে রাতে থাকলেও আলাদা ছিলাম দু’জন। আমি খাটে ঘুমিয়েছি আর নূর হোসেন সোফায়। কারণ, জাঁকজমকপূর্ণ এক অনুষ্ঠানে মদ খেয়ে ওই রাতে মাতাল ছিল নূর হোসেন।
কাউন্সিলর নীলা জানান, এরপরও আমি নূর হোসেনকে বিয়ে করিনি। তবে ইচ্ছার বাইরে নূরের সঙ্গে কথা বলেছি, দেখা করেছি। বিভিন্ন সময় নানা ধরনের জিনিসপত্র কিনে বাসায় পাঠিয়েছে নূর হোসেন। একদিন হঠাত্ করেই ৩২ লাখ টাকা দিয়ে একটি এলিয়ন গাড়ি কিনে ড্রাইভারসহ বাসায় পাঠিয়েছে। যদিও তা ফেরত পাঠিয়েছি। এছাড়া আমার নামের জমিতে বাড়ি তৈরির সময় কিছু ইট-সিমেন্ট-রড কিনে দিয়েছে নূর হোসেন। আর যতটুকু দিয়েছে তার চেয়ে বেশি ঢাকঢোল পিটিয়েছে। যাতে সবাই সত্যি মনে করে যে, আমি তার স্ত্রী। ফলে এখন এলাকার ছেলে-বুড়োসহ কাউকেই আর বিশ্বাস করানো যাবে না আমি তার স্ত্রী নই। অথচ সিটি করপোরেশনের ১ কোটি টাকা দরের এক ঠিকাদারি কাজ এবং ২ কোটি টাকা মূল্যের সয়াবিন মিল ও তেলের গোডাউন বিক্রির কমিশন বাবদ আমার পাওনাই ছিল ৩৫ লাখ টাকা।
নির্মম ও বর্বর ৭ হত্যাকাণ্ডে ব্যথিত-মর্মাহত উল্লেখ করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন কাউন্সিলর নীলা। তিনি বলেন, আমি তখন চিকিত্সার জন্য বাবা-মাসহ ভারতে। বিষয়টি ফোনে জেনেছি। কারা অপহরণ-খুন করেছে তা জানতে পারিনি। তবে ভারতে থাকাকালে নূর হোসেন বারবার ফোন করে আমার অবস্থান জানতে চেয়েছে। এ সময় আরও বলেছে, তুমি থাকো আমি আসছি। এবার ভারতে গিয়ে তোমাকে আর বাংলাদেশে আসতে দেবো না। ভয়ে আমি দ্রুত টিকিট কেটে ২৮ এপ্রিল দেশের উদ্দেশে রওনা দিই।
নীলা বলেন, দেশে থাকি আর বিদেশে থাকি প্রতিদিন সে একাধিকবার ফোন দিতো আমাকে। ২৮ তারিখের পর থেকে সে আর ফোন দেয়নি। এখন বেঁচে আছে, না মারা গেছে, বিদেশে পালিয়ে গেছে, না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আছে সে প্রশ্ন নারায়ণগঞ্জবাসীর মতো আমারও।
প্রসঙ্গত, জান্নাতুল ফেরদৌস নীলা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা যুব মহিলা লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নীলার শিক্ষাজীবন ছিল নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ, সিদ্ধিরগঞ্জ রেবতি মোহন পাইলট উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

No comments

Powered by Blogger.