ভারত রাতারাতি বদলে যাবে না

ভারতের নির্বাচনে বিজেপির আশাতীত ভালো ফল এবং নরেন্দ্র মোদির অভাবনীয় সাফল্যের পর সারা পৃথিবীতে এবং বাংলাদেশেও বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যে যাঁরা খুশি হননি, তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় কম-বেশি একটা প্রবণতা সহজেই লক্ষণীয়, তা হলো বিজেপির সাফল্যকে তাঁরা দেখছেন ভারতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র অবসানের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে। তাঁদের আনুষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া থেকে এ ধারণা জন্মায়, যেন এই প্রথমবারের মতো ভারতের হিন্দু ধর্মভিত্তিক দক্ষিণপন্থী দল বিজেপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চলেছে এবং তাঁরা ক্ষমতা গ্রহণ করামাত্রই ‘একটি আদর্শস্থানীয় সেক্যুলার রাষ্ট্র’ রাতারাতি বদলে যাবে। এই ধারণার বিভ্রান্তিগুলো ভালো করে বোঝা দরকার। প্রথমত, বিজেপি এই প্রথমবার ক্ষমতায় আসছে তা নয়; আগে এই দলটি তিনবার ক্ষমতায় এসেছে। বিজেপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আমরা অবশ্যই সমাজে ও রাজনীতিতে পরিবর্তন দেখেছি, তারা তাদের আদর্শের আলোকে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সাজাতে চেয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টার একটা বড় রূপও আমরা দেখেছি। এই পরিবর্তনগুলোকে অনেকে স্যাফ্রোনাইজেশন বা ‘জাফরানীকরণ’ বলে বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু বিজেপি গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছে এমন ঘটনা ঘটেনি। এখন আগের বিজেপি নেতাদের তুলনায় আরও কট্টরপন্থী নরেন্দ্র মোদি, যাঁর হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে বললে অত্যুক্তি হবে না, তিনি নিঃসন্দেহে বেশি মাত্রায় জাফরানীকরণের চেষ্টা করবেন, সেটা ধরেই নিতে পারি৷ কিন্তু ভারতের করপোরেট ক্ষমতার অধিকারীরা, যাঁদের অক্লান্ত চেষ্টায় এবং অর্থে বিজেপির এই বিজয়, তাঁরা বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদিকে খুব বেশি দূর যেতে দেবেন বলে মনে করার মতো কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের বক্তব্যে ভারতকে যেভাবে একটি আদর্শস্থানীয় সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে দেখার ও দেখানোর আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে, তা কতটা বাস্তবোচিত, তা বিবেচনা করা দরকার। ভারতের রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় সেক্যুলারিজমের কথা বলা হলেও সমাজে তার প্রয়োগের দুর্বলতার দিক নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলে আসছে। (উৎসাহীরা এ বিষয়ে ২০০৭ সালে ডিউক ইউনিভার্সিটি প্রেস প্রকাশিত অনুরাধা দিংওয়ানে নিধাম সম্পাদিত দ্য ক্রাইসিস অব সেক্যুলারিজম ইন ইন্ডিয়া বইটি পড়তে পারেন।) তদুপরি সমাজের ভেতরে, বিশেষত ভারতের পপুলার কালচার বা দৈনন্দিন জীবনে এমন ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে, যেখানে বিজেপির মতো দলের উদ্ভব, বিকাশ ও সাফল্যই স্বাভাবিক ঘটনা। (এ জন্য দ্রষ্টব্য থমাস ব্লুম হ্যানসেন-এর গ্রন্থ স্যাফরন ওয়েভ: ডেমোক্রেসি এবং হিন্দু ন্যাশনালিজম ইন ইন্ডিয়া, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৯)।
এসব আলোচনা থেকে এটাই বেরিয়ে এসেছে যে পশ্চিমা সেক্যুলারিজমের ধারণার বিপরীতে ভারত যে তার নিজস্ব ধরনের ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছে, তা আদর্শিক ও প্রায়োগিক—দুই দিক থেকেই সংকটের মধ্যে পড়েছে। ফলে ভারতকে এখন এক আদর্শস্থানীয় রাষ্ট্র মনে করার কারণ নেই। সমাজের এই পরিবর্তনের পেছনে কেবল যে বিজেপিই কাজ করেছে তা নয়, সেক্যুলারিজমের প্রতিনিধি বলে দাবিদার কংগ্রেসের কার্যকলাপও তার জন্য দায়ী। এখন কংগ্রেস নির্বাচনে অত্যন্ত খারাপভাবে পরাজিত হওয়ার কারণে আমাদের তা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে রাজনৈতিক সেক্যুলারিজমের যে মূলবাণী অর্থাৎ রাষ্ট্র এবং ধর্মের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করা, তা অগ্রহণযোগ্য হয়ে গেছে। কিন্তু সমাজের সেক্যুলারাইজেশন ছাড়া রাষ্ট্রের ওপরে ভরসা করে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়, সেটা বোঝা খুবই জরুরি। এসবের পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে, গত কয়েক দশকে আমরা দেখতে পেয়েছি যে দেশে দেশে ধর্মাশ্রয়ী এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ঘটেছে। কেউ কেউ যদিও একে কেবল মুসলিমপ্রধান দেশের লক্ষণ বলে মনে করেন, তাঁরা বিস্মৃত হন যে একই প্রবণতা অন্য ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও ঘটেছে। ভারতে বিজেপির উত্থানকে এই আলোকেও

No comments

Powered by Blogger.