কালোটাকা সম্পর্কে শ্বেতপত্র চাই

বাজেট ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কালোটাকা নিয়ে তর্কবিতর্কও জোরালো হয়ে উঠেছে৷ কয়েক বছর ধরেই এ প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে৷ বাজেটের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার দাবিটি যেমন জোরেশোরে উঠেছে, তেমনি এ সুযোগ যেন দেওয়া না-দেওয়ার আহ্বানও বেশ প্রবল৷ অবশ্য অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একাধিক প্রাক্-বাজেট আলোচনায় স্পষ্ট করেই বলেছেন, কলোটাকা সাদা করার কোনো সুযোগ আর বাজেটে দেওয়া হবে না৷ অর্থমন্ত্রী এ-ও জানিয়েছেন, কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার জন্য যে আইনি সুযোগ এখন আছে, তা বহাল থাকবে৷ অর্থাৎ নতুন করে বা বাড়তি কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না৷ তাঁর এ কথার পর কালোটাকা নিয়ে আলাপচারিতা স্তিমিত হয়ে যাওয়া উচিত থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি৷ আসলে আগামী ৫ জুন ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত হতে পারছেন না যে অর্থমন্ত্রী তাঁর এ কথায় কতটা অনড় থাকবেন৷ কেননা, বিগত বছরগুলোয় তিনি বিভিন্ন বিষয়ে একবার এক কথা, আরেকবার আরেক কথা বলে বিভ্রান্তি তৈির করেছেন৷ জোর দিয়ে বলার পরও স্থির বা অবিচল থাকতে পারেননি, এমন ঘটনাও বিরল নয়৷ তা ছাড়া কালোটাকা নিয়ে অর্থমন্ত্রী তথা সরকারের ধারণাগত অস্পষ্টতা রয়েছে৷ একইভাবে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, যাঁরা কালোটাকা সাদা করার দাবি জানাচ্ছেন—এ নিয়ে তাঁদের ধারণাও স্পষ্ট নয়৷ এমনকি যে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা কালোটাকা সাদা করাকে অনৈতিক ও অসংগত বলে এর বিরোধিতা করছেন, তাঁদের কাছেও এ নিয়ে বিভ্রান্তি আছে বলে প্রতীয়মান হয়৷ সহজভাবে বললে, যে আয়-উপার্জনের অর্থ থেকে প্রযোজ্য আয়কর প্রদান করা হয় না বা যে অর্থ আয়কর ফাঁকি দিয়ে গচ্ছিত রাখা হয়, সেটাই হলো কালোটাকা৷ এ আয় বৈধ উৎস থেকেও হতে পারে, অবৈধ উৎস থেকেও হতে পারে৷
চোরাকারবারি বা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ অবশ্য কর ফাঁকি দেওয়ার জন্যই অর্জিত হয়৷ কাজেই এগুলো যে গোপন করা হবে, সেটাই স্বাভাবিক৷ অন্যদিকে বৈধ আয়ের (যেমন চিকিৎসকের প্রাইভেট প্র্যাকটিস থেকে আয়) কোনো অংশ বা পুরোটার ওপর যদি আয়কর দেওয়া না হয়, তাহলে সেটাও কালোটাকা হয়ে যায়৷ তবে একে ‘অপ্রদর্শিত বৈধ আয়’ হিসেবে গণ্য করা হয় এ বিবেচনায় যে এর উৎস আইনগতভাবে স্বীকৃত বা বৈধ কর্মকাণ্ড৷ সে ক্ষেত্রে অবশ্য একটা নৈতিক প্রশ্ন ওঠে যে বৈধ আয় কেন গোপন করা হবে বা কেন এ আয়ের ওপর কর দেওয়া হবে না৷ সাধারণত কর প্রদানে জটিলতা বা আয়কর বিষয়ে অসচেতনতায় অনিচ্ছাকৃতভাবে অথবা কখনো ইচ্ছাকৃতভাবেই এ আয় গোপন করা হয়৷ তাহলে এ কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত আয় কোথায় গচ্ছিত রাখা হয়? নিশ্চয়ই কেউ ঘরে তোশকের নিচে কালোটাকা লুকিয়ে রাখবেন না যেমনটা রেখেছিলেন বন বিভাগের একজন কর্মকর্তা, যা কিনা ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ধরা পড়ে ও দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি হয়৷ গুটি কয়েক মানুষ যদি সিন্দুকের ভেতর লাখ লাখ বা কোটি কোটি টাকা রেখেও দেন, তার পরও বাস্তবতা হলো স্বাভাবিকভাবেই কোনো মানুষ বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ নিজের ঘরে রাখবেন না৷ কাজেই কালোটাকার মালিকেরা বা অপ্রদর্শিত আয়ধারীরা তাঁদের অর্থ আর্থিক সম্পদ বা অন্য কোনো সম্পদের আকারে রেখে থাকেন, যেমনটা অন্যরা রাখেন৷ কাজেই এসব কালোটাকা হয় দেশের ভেতরে শেয়ারে বা বন্ডে বিনিয়োগ করা হবে, অথবা এ অর্থ দিয়ে জমি-বাড়ি এবং সোনা-গয়না কিনে রাখা হবে, এমনকি ডলার কিনেও রাখা হতে পারে৷ আর যাঁরা দেশে রাখতে আগ্রহী নন, তাঁরা নানা কৌশলে তা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবেন৷ বাস্তবে তা হচ্ছেও বটে৷ মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কর্মসূচির আওতায় সে দেশে নিয়ে বাড়ি কেনা কিংবা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি ও ব্যবসায় বিনিয়োগ করে অভিবাসী নাগরিক হওয়ার ঘটনাগুলো ঘটছে এ অর্থ পাচারের মাধ্যমেই৷ মোদ্দাকথা হলো, কালোটাকা আসলে দেশে বা বিদেশে ইতিমধ্যে িবনিয়োগ করাই আছে৷
এমনকি ব্যাংকে ভিন্ন নামে আমানত হিসেবে গচ্ছিত আছে৷ কালোটাকা গচ্ছিত থাকার এ বিষয় দেশের দুই অর্থনীতিবিদ এম এ তসলিম ও আহসান এইচ মনসুর ২০০৮ সালেই তাঁদের এক বিশ্লেষণধর্মী লেখায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন৷ কালোটাকার ধরন ও গচ্ছিত থাকার পদ্ধতির এ পরিপ্রেক্ষিতেই আসলে কালোটাকা সাদা করার যৌক্তিকতা বিবেচনা করা উচিত৷ যেহেতু ইতিমধ্যেই দেশে গচ্ছিত কালোটাকা কোনো না কোনো রূপে বিনিয়োগ করা আছে, তাই নতুনভাবে আবার কোনো কোনো খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলে বাস্তবে বিনিয়োগ এক খাত থেকে আরেক খাতে স্থানান্তর হবে মাত্র৷ অন্যদিকে যাঁরা বিদেশে অর্থ সরিয়ে নিয়ে গেছেন নিরাপত্তার জন্য, তাঁরা সেই নিরাপদ জায়গা ছেড়ে দেশে কেন তা বিনিয়োগের জন্য ফিরিয়ে আনবেন, সেটাও বোঝা মুশকিল৷ তা ছাড়া দুই বছর আগেই আয়কর অধ্যাদেশে ১৯ই ধারা সংযোজন করে স্থায়ীভাবে অপ্রদর্শিত আয় বা কর অনারোপিত আয় স্বেচ্ছায় ঘোষণা দিয়ে প্রদর্শনের বা বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে৷ এর ফলে কোনো কারণে কোনো করদাতা যদি অতীতে তাঁর বৈধ আয় কম প্রদর্শন করে থাকেন বা কোনো কারণে প্রাপ্ত অর্থসম্পদ বিবরণী প্রদর্শন না করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সেই আয় বিদ্যমান আইন অনুযায়ী স্বেচ্ছায় প্রদর্শন করতে পারবেন৷ এ জন্য শুধু প্রদেয় করের ১০ শতাংশ অতিরিক্ত জরিমানা দিতে হয়৷ এতে কর বিভাগ কোনো প্রশ্ন করবে না৷ আবার চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে বর্গমিটারপ্রতি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে, নতুনভাবে বা বাড়তি কোনো উপায়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার অবকাশ নেই, দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতাও নেই৷ অর্থমন্ত্রী সম্ভবত সেই বিবেচনা থেকেই আর কোনো সুযোগ না দেওয়ার কথা বলেছেন৷ তবে বিদ্যমান আইনি সুযোগ বহাল রাখার কথাও বলেছেন৷ তবে এটাও সত্যি যে দেশে প্রতিবছরই কালোটাকা বাড়ছে৷ তাই পাচারও হচ্ছে৷
ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল িফন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যানুসারে, ২০০২ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা গোপনে বাইরে চলে গেছে৷ পরবর্তী বছরগুলোয় এ ধারা যে অব্যাহত আছে ও থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই৷ আর এখানেই চলে আসে সরকারের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জের বিষয়৷ সেটি হলো টাকা পাচার নিয়ন্ত্রণ করা৷ শুধু মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ আইন িদয়ে এ অর্থ পাচার বা স্থানান্তর ঠেকানো যাবে না৷ এর জন্য বরং দেশের ভেতরেই এমন কিছু সুযোগ তৈরি করতে ও ব্যবস্থা নিতে হবে, যেন এসব অর্থ পুরোটা না হলেও বেশির ভাগটাই দেশে থাকে৷ আর দেশে টাকা গচ্ছিত রাখার প্রকৃষ্ট উপায় হলো ব্যাংকব্যবস্থা৷ ব্যাংকে যে অর্থ গচ্ছিত থাকে ও ব্যাংকের মাধ্যমে যে অর্থ লেনদেন হয়, তা আসলে আর কালোটাকা থাকে না, থাকতে পারে না৷ কাজেই সরকারকে এদিকে নজর দিতে হবে৷ পাশাপাশি কালোটাকা সৃষ্টি হওয়ার উৎস ও সুযোগগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে৷ অর্থ পাচার হওয়ার চেয়ে অর্থ দেশে থাকা অধিকতর ভালো৷ nসর্বোপরি কালোটাকার বিষয়ে সরকারের তথা রাষ্ট্রের একটি সুস্পষ্ট অবস্থান থাকা প্রয়োজন৷ আর সেই অবস্থান জনগণের সামনেও প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন৷ এ জন্য অর্থমন্ত্রীর উচিত হবে কালোটাকার বিষয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা, যেমনটি ভারত সরকার করেছিল ২০১২ সালে৷ এ শ্বেতপত্রে কালোটাকার সংজ্ঞা ও পরিধি নির্ধারণ, কালোটাকা সৃষ্টির উৎস ও উপায়সমূহ, কালোটাকার পরিমাণ, দেশ থেকে টাকা পাচারের প্রবণতা, কালোটাকা সাদা করার বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং কালোটাকা নিয়ন্ত্রণের বিদ্যমান বিধিবিধান সন্নিবেশিত হবে৷ একইভাবে উল্লেখ করতে হবে আগামী দিনগুলোয় সরকারের এ বিষয়ে সম্ভাব্য করণীয় কী৷ কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত আয় নিয়ে বিভ্রান্তি মোচনের জন্য এ শ্বেতপত্র এখন সময়ের দাবি৷
আসজাদুল কিবরিয়া: সাংবাদিক৷
asjadulk@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.