সমস্যা প্রিলিমিনারি নয় by আলী ইমাম মজুমদার

সম্প্রতি পত্রপত্রিকার খবরে জানা গেল, বিসিএসের প্রাথমিক বাছাই (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষার মোট নম্বর ১০০ থেকে বাড়িয়ে ২০০ করার বিষয়ে কর্মকমিশনের প্রস্তাবটি সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর্যায়ে রয়েছে। একই সঙ্গে প্রশ্নপত্রের ধরনেও পরিবর্তন আনার বিষয় বিবেচনাধীন রয়েছে। নৈর্ব্যক্তিকের পাশাপাশি লেখার ক্ষমতা যাচাইয়ের চিন্তাভাবনা চলছে। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যে ৩৪তম বিসিএসে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ৪৬ হাজারের বেশি প্রার্থী লিখিত পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। এত বিপুলসংখ্যক প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার জন্য অবকাঠামো, মূল্যায়ন ব্যবস্থাসহ নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। এ কারণে কর্মকমিশন প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষাকে তাদের মতে আরও যুগোপযোগী করে আরও কম প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষায় আনতে চাইছে। প্রায় অর্ধলক্ষ প্রার্থীর লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার যেসব অসুবিধা কমিশন উল্লেখ করেছে, তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার তেমন কোনো সুযোগ নেই। তবে ভিন্নমত থাকে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ করার পদ্ধতি নিয়ে।

বিসিএস নিয়োগবিধিতে প্রিলিমিনারিতে কোনো পাস নম্বর নির্ধারণ করা নেই। কত প্রার্থীকে লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাকা হবে, তা মূলত শূন্য পদসংখ্যা আর অন্য প্রাসঙ্গিক বিষয়াদির ভিত্তিতে কমিশন নির্ধারণ করে। সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ পরীক্ষার্থী প্রিলিমিনারিতে ছিলেন ২৮ থেকে ৩১তম বিসিএসে। লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন মেধানুসারে ১০ থেকে ১৪ হাজার। কোনো আলোচনা-সমালোচনা আর আন্দোলন হয়নি এ বাছাই-প্রক্রিয়া নিয়ে। ৩৪তম বিসিএসে প্রিলিমিনারি পর্যায়ে কোটাপদ্ধতি প্রয়োগ করে সূচনায় ফলাফল ঘোষণা করায় একটি ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। অনেক কম নম্বর পেয়েও প্রাধিকারভুক্ত প্রার্থীরা লিখিত পরীক্ষার সুযোগ পান। আর বিপরীতটা ঘটে মেধা কোটার ক্ষেত্রে। সেখানে অনেক বেশি নম্বর পেয়েও বঞ্চনার মুখোমুখি হয়েছিলেন লিখিত পরীক্ষার সুযোগ থেকে। এ বিষয়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি সামাল দিতে লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনয়নের বেঞ্চমার্ক অনেক কমিয়ে প্রাধিকারভুক্ত প্রার্থীদের সমপর্যায়ে আনা হয়। তাই প্রায় অর্ধলক্ষ প্রার্থীর সমাবেশ ঘটেছে লিখিত পরীক্ষায়। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে তেমন কোনো ফল লাভ হবে বলে মনে হয় না। একটি অংশ লিখিত পরীক্ষা হিসেবে রাখা হলে সে দেড় লাখ পরীক্ষার্থীর খাতা দেখার কঠিন কাজটিও বেশ সময় নেবে। জট ছাড়াতে গিয়ে সৃষ্টি হতে পারে নতুন জটের। আর সমস্যাটি তো সেখানে নয়। তাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভেবে দেখা দরকার।
বেসামরিক প্রশাসনের ক্যাডার চাকরিগুলো সবই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বা সংক্ষেপে বিসিএসের অঙ্গ। এ চাকরিগুলোর ভিত্তিস্তরে নিয়োগের সুপারিশ করে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। তাদের সুপারিশের ভিত্তি হওয়ার কথা নিয়োগের উপযুক্ততা সম্পর্কে নির্ধারিত মানদণ্ডে প্রার্থীদের বাছাই। এসব কর্মকাণ্ডের জন্যও বিধি রয়েছে। রয়েছে যুগবাহিত রেওয়াজ। এর মূল উদ্দেশ্য একটি নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে যোগ্যতর প্রার্থীদের জনসেবক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। তা সঠিকভাবে করতে পারলে প্রজাতন্ত্র পায় উপযুক্ত সেবক। আর স্বাভাবিকভাবেই অধিকতর মেধাবীদের প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের সুযোগ ঘটে। আমাদের রাষ্ট্রকাঠামোর রূপকারেরা সচেতনভাবে এ ব্যবস্থারই সংযোজন করেছেন সংবিধানে। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের সুযোগে সমতার নিশ্চয়তাও সে দলিলটির মৌলিক অধিকার অংশে সন্নিবেশিত হয়েছে। অবশ্য এটাও রয়েছে যে নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বের সুবিধার্থে বিশেষ বিধান করা যাবে। তাই প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভে মেধাই মূল ভিত্তি হওয়ার কথা, বিশেষ ব্যতিক্রম ব্যতীত সব ক্ষেত্রে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে, সেটা সবারই জানা।
প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক—এ তিন পর্বে বিসিএস পরীক্ষা। ভারতেও তাই। সেখানে মোট শূন্য পদের ১১ থেকে ১২ গুণ প্রার্থীকে প্রিলিমিনারি পর্যায়ে লিখিত পরীক্ষার জন্য বাছাই করা হয়। আর লিখিত পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে শূন্য পদের শুধু দ্বিগুণ প্রার্থীকে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। আমরা এমনটা করতে পারলে কিন্তু অধিকতর মেধাবী প্রার্থীদের নিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি পেত। তবে কোটাপদ্ধতি প্রয়োগ করার বিষয়টি যুগবাহিত রেওয়াজ অনুসারে আসবে মৌখিক পরীক্ষার পর। ভারতের দৃষ্টান্ত এখানে আনা হলে কোটাও থাকবে শুধু সমাজের অনগ্রসর অংশের জন্য। আমরা কিন্তু ৫০ শতাংশ চাকরি মেধা কোটার বাইরে প্রাধিকারভুক্ত প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত রেখেছি। আর তঁারা অনেকেই সমাজের অনগ্রসর অংশের প্রতিনিধিত্ব করছেন না। সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য যে সেসব প্রাধিকার কোটায় অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রার্থী পাওয়া যায় না। তাই অনেক ক্ষেত্রে পদ খালি রেখে দেওয়ার মন্দ দৃষ্টান্তও আমরা স্থাপন করেছি। যোগ্য মেধাবীদের সেসব পদে নিয়োগ দেওয়া যায়নি। তাই এ ধরনের কোটার নৈতিক দিকটি প্রশ্নবিদ্ধ। অধিকতর প্রশ্নবিদ্ধ সে কোটার অনুপাত।
এরপর আসছে মৌখিক পরীক্ষার নম্বরসংক্রান্ত বিষয়টি। এটি একপর্যায়ে ২০০ নম্বরের ছিল। পাশাপাশি ছিল এই নম্বর দেওয়া নিয়ে দিনকে রাত করার সুযোগ। ব্যাপক সমালোচনার মুখে এটা ১০০ করা হয়। ৩০তম বিসিএস পর্যন্ত তা-ই ছিল। ৩১তম থেকে আবার তথৈবচ। মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর থাকার গালভরা যুক্তি দেওয়া হয়। নজির দেখানো হয় আগের সিএসএস আর ভারতের আইএএস পরীক্ষার। কিন্তু এ বিষয়ে সবাই চোখ বুজে থাকেন যে আমরা এটা অপব্যবহারের সুযোগ রেখে দিলাম। আর এ বিষয়ক আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক গ্রহণযোগ্যতা ও মান বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মাত্রার হেরফের হলেও প্রায়ই অভিযোগ আসে দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির। তাই মৌখিক পরীক্ষার নম্বর হ্রাস করাতেই বরং স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার বলয় কিছুটা টেনে রাখা যেত। তবে তা করেও রাখা যায়নি। রাখা যায়নি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী কিংবা প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় মৌখিক অংশে নামমাত্র নম্বর রাখার বিধান। সে পরীক্ষাগুলোতে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর নির্বিচারে অপব্যবহারের অভিযোগ আসে। এসব পরিপ্রেক্ষিতে কোটার বেড়াজালে বন্দী বিসিএসে কিছু সুবিচার করার জন্য আবশ্যক ছিল মৌখিক পরীক্ষার নম্বর পুনরায় ১০০ করা। এটা বাড়ানোর চিন্তা করা যাবে তখনই যখন আমরা সাবেক সিএসএস কিংবা ভারতের আইএএস পরীক্ষার মানদণ্ডে পরীক্ষা নিতে সক্ষম হব। আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পিএসসি কখনো কখনো তাদের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে সক্ষম হলেও তা স্থায়িত্ব ও ধারাবাহিকতা লাভ করেনি। বরং বিপন্ন হয়েছে বারংবার।
প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নম্বর বাড়ানো কিংবা কাঠামো পরিবর্তন করলেও ৩৪তম বিসিএসের মতো প্রিলিমিনারি পর্যায়ে কোটা প্রয়োগ করা হলে অনেকটা অভিন্ন ফলাফলই আসবে। খুব বেশি প্রার্থীকে এখানে বাদ দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। তদুপরি বড় সমস্যা হবে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে। ৩৪তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী অর্ধলক্ষ পরীক্ষার্থীর বিশাল অংশ মৌখিকের জন্য মনোনীত হবেন বলেই মনে হয়। তখন তাঁদের ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন দুরূহ হবে। সব প্রার্থীর প্রতি সুবিচার করা যাবে কি না, এমনটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। বরং এতে সৃষ্টি হতে পারে অকারণ অসন্তোষের। তা ছাড়া, প্রাধিকারের কল্যাণে কম মেধাসম্পন্ন প্রার্থীরা নিয়োগ পাবেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিতে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়। মেধার বিকল্প কিছু নয়৷
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এ বাস্তবতাটি মেনে নিয়ে তাদের শাসনকাজ পরিচালনা করে। প্রাচীনকালে প্রার্থীদের উঁচু পদে নিয়োগের ভিত্তি ছিল মূলত আভিজাত্য। তাকে ঝেড়ে ফেলে দুই হাজার বছর আগে চীনে প্রথম মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিসের সূচনা হয়। আর দেড় হাজার বছর আগে সে ব্যবস্থাটি ওই দেশে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দী থেকে পাশ্চাত্য এ ব্যবস্থার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তা গ্রহণ করতে থাকে। ব্যবস্থাটি মূলত চীনের উপহার। পাশ্চাত্যে ১৫৫৪ সালে প্রথম এটা গ্রহণ করে ফ্রান্স। তারপর অন্যান্য দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। অভিজাত শ্রেণির পরিবর্তে মেধাবীরা সরকারের উঁচু পদে নিয়োগের সূচনা হয়। আমাদের উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিসের সূচনা করেছিল। তা সত্ত্বেও সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ছিল সামান্য কিছু ব্যতিক্রম। এ ব্যতিক্রমের বিলুপ্তি কেউ চায় না। তবে চায় এর সঠিক অনুপাত ও ন্যায়ত যাঁদের পাওয়ার কথা তাঁরাই পাক। সবার প্রত্যাশা সমাজে মেধাবীদের অবদান রাখার সুযোগ উপেক্ষিত না হোক। যা হওয়ার হয়ে গেছে। তবে এ দুর্ভাগ্যজনক সংস্কৃতির ইতি টানার সময় কিন্তু দ্বারপ্রান্তে উঁকি দিচ্ছে। এর জন্য নিতে হবে উপযুক্ত ব্যবস্থা। বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে বা কমিয়ে সময়ের দাবিতে সাড়া দেওয়ার কোনো সুযোগ কিন্তু নেই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.