‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’ by সৈয়দ আবুল মকসুদ

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আজ কোথায় দঁাড়িয়ে? ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর শেষ ও চাবি-বাক্যটি ছিল: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতাঁর সংগ্রাম’। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতাঁ অর্জিত হয়েছে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৪৩ বছর আগে। বাংলাদেশের মানুষ চেয়েছিল স্বাধীনতাঁ ও মুক্তি—দুটির একটি নয়। মুক্তি বাদ দিয়ে শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাঁ তো নয়ই। আমার বয়সী লোকদের জিজ্ঞেস করলে আবোলতাঁবোল কথা বলবে, ৪৩ বছরের কম বয়স্ক কোনো মানুষকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে বাংলার মানুষ মুক্তি পেয়েছে কি না, পেলেও কতটা পেয়েছে৷
যেকোনো কারণেই হোক, একাত্তরে কোনো রকম ভূমিকা রাখার সুযোগ পাননি, বর্তমান সরকারের এমন একজন বলিষ্ঠ নেতাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ৭ মার্চের ভাষণে জোরটা ছিল কোন শব্দটির ওপর—স্বাধীনতাঁ না মুক্তির? বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির রেকর্ড তিনি বিভিন্ন দিবসে বহুবার শুনেছেন। তাঁই বললাম, স্বাধীনতাঁ শব্দটি তিনি একবার উচ্চারণ করেছেন, কিন্তু মুক্তি শব্দটি কি তিনি মাত্র একবারই বলেছেন? মাথা চুলকে তিনি বললেন, বোধ হয় একবারই।

নেতাঁকে বললাম, পাকিস্তাতাঁনি সামরিক জান্তাতাঁর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধটা হলো আশু দাবি স্বাধীনতাঁ অর্জনের জন্য, কিন্তু তাঁর নামটি কেন হলো মুক্তিযুদ্ধ। এরপর তাঁর জ্ঞাতাঁর্থে বললাম, দোকান থেকে একটি ক্যাসেট কিনে বাড়িতে গিয়ে বাজিয়ে দেখবেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেদিন বঙ্গবন্ধু ‘মুক্তি’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন—খুব ভেবেচিন্তেই উচ্চারণ করেছেন—একাধিকবার। ভাষণের শেষে গিয়ে নয়, শুরুতেই তিনি বলেছেন: ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বঁাচতে চায়, বাংলার মানুষ তাঁর অধিকার চায়’। ভাষণের মাঝখানে তিনি আরেকবার বলেছেন: ‘যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হচ্ছে, তত দিন খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো—কেউ দেবে না’। প্রকৃতপক্ষেই, তাঁর পর থেকে পাকিস্তাতাঁনি বাহিনীর আত্মসমর্পণ না করা পর্যন্ত কেউ ট্যাক্স-খাজনা দেয়নি।
যে দলের নেতৃত্বে স্বাধীনতাঁসংগ্রাম হয়েছিল, তাঁর নেতৃত্বাধীন মহাজোটের সরকারই আজ রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায়। নেতাঁরা প্রতিদিন অসংখ্যবার ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে স্লোগান দিচ্ছেন। তাঁরা কি তাঁর ওই কথা তিনটি মনে রেখেছেন—বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বঁাচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়? বাংলার মানুষ মুক্তি যদি না পেয়ে থাকে তো না-ই পাক, যদিও চেয়েছিল মুক্তি, অন্তত স্বাভাবিক জীবনযাপন করে বঁাচতে তো চায়। বাংলার মানুষ মানবিক অধিকারটুকু তো চায়। কোনো নাগরিকের মানবিক অধিকার খর্ব করার ক্ষমতাঁ কোনো রাষ্ট্রের থাকতে পারে না। একাত্তরের রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের জন্মের মাসে বাংলার মানুষ মুক্ত ছিল না। ছিল খঁাচায় বন্দী। তাঁর বঁাচার অধিকার ছিল না, প্রতিদিন শত্রুর হাতে জীবন দিত। মানুষ হিসেবে তাঁর কোনো রকম অধিকার ছিল না। ২০১৪ অব্দের মে মাসেও যদি সেদিনের অবস্থা হয়, তাঁর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কী হতে পারে?
একাত্তরের পয়লা মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত যে মানুষ ঢাকায় ছিল না, জিন্নাহ (বঙ্গবন্ধু) অ্যাভিনিউ, বিশ্ববিদ্যালয়, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি—প্রভৃতি এলাকায় ঘোরাফেরা করেনি, তাঁর পক্ষে সেদিনের বাংলাদেশকে উপলব্ধি করা কঠিন। শান্তিতে বঁাচতে এবং তাঁর অধিকার রক্ষায় যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে সেদিন প্রতিটি মানুষ প্রস্তুত ছিল। ওরা গণতাঁন্ত্রিক অধিকার দেবে না, বাংলার মানুষ তাঁর অধিকার আদায় না করে ঘরে ফিরে যাবে না। এখন চেতনার কথা বলে যঁারা প্রতিদিন টেবিলে থাপ্পড় মারেন, মানুষের গণতাঁন্ত্রিক অধিকার কী, সে সম্পর্কে তাঁদের প্রচুর ধারণা আছে বলে মনে হয় না। অদক্ষতাঁ ও অযোগ্যতাঁ ক্ষমা করা যায়—সদিচ্ছার অভাব নয়। তাঁ ছাড়া, মুখের ভাষাটা টিক্কা খানের ভাষার বাংলা তরজমার মতো হবে কেন?
রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রে একটি সুবিধা হলো অমাত্য ও আমলাদের দিয়েই শাসনকাজ চালানো যায়। সঙ্গে পাইক, পেয়াদা, লেঠেল, বরকন্দাজ থাকলেই হলো। গণতাঁন্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রয়োজন নেতৃত্বের। সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নেতৃত্ব চাই। বাংলাদেশের সংবিধানেও বলা হয়েছে ‘নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানের ওপর...স্থানীয় শাসনভার’ দিতে হবে। আরও বলা হয়েছে ‘স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত...প্রতিষ্ঠানসমূহে কৃষক, শ্রমিক এবং মহিলাদিগকে যথাসম্ভব বিশেষ প্রতিনিধিত্ব’ করতে দিতে হবে। সেটা করতে দিতে হলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ছাড়া সম্ভব নয়।
ক্ষমতাঁসীন দল ও প্রশাসন হস্তক্ষেপ করলে মানুষ তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে না। তাঁ যে পারে না তাঁর সাক্ষী হয়ে রইল ২০১৪-এর সাধারণ নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচন। ২০০৮ পর্যন্ত বাংলার মানুষ এক রকম নির্বাচনী ব্যবস্থা দেখে এসেছে এবং তাঁ মেনে নিয়েছিল। ২০১৪–তে সব ধূলিসাৎ হয়ে গেল। নির্বাচনের আগের রাতেই প্রিয় প্রার্থীর ভোটের বাক্স ভরে গেল ব্যালট পেপারে। যেখানে সম্ভব হয়নি সেখানে ভোটকেন্দ্রে বসে বসে খাতিরজমায় নির্বাচন কর্মকর্তাতাঁরাই ছাপ মারেন প্রকাশ্যে।
নেতৃত্ব তৈরি হয় ধাপে ধাপে—নিচ থেকে ওপরের দিকে। উপযুক্ত গণতাঁন্ত্রিক সংস্কৃতি নেতৃত্ব তৈরি করে। বাংলাদেশে নেতৃত্ব তৈরির প্রক্রিয়াটি বন্ধ আশির দশক থেকে। আগামী চার-পঁাচ বছরের মধ্যে জাতি এক চরম নেতৃত্বহীন অবস্থায় পড়বে। ষাট ও সত্তরের দশকে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করতে করতে যঁারা নেতাঁ হয়েছেন এবং এখনো রাজনীতি করছেন, তাঁরা আজ বৃদ্ধ। শ্রেণিগত রোগ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ প্রভৃতির চিকিৎসায় তাঁদের ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, আমেরিকা করতে হয়। ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করার জন্য তাঁদের অনবরত আমেরিকা যেতে হয়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই তাঁরা শারীরিকভাবে অসমর্থ হয়ে পড়বেন। আল্লাহ না করুন, কেউ-বা—।
এই জগতে কোনো স্থানই শূন্য থাকে না। অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি পদ্য আছে, যার প্রথম পঙ্ক্তি এ রকম: ‘মহাত্মাজি যদি মারা যান,/ আকাশ হবে না খান্ খান্/ সূর্য উঠবে।’ গান্ধীজির মতো মানুষ মারা গেলে সূর্য ওঠে ঠিকই, কিন্তু সে সূর্যের আলো ম্লান। উচ্চতাঁসম্পন্ন নেতাঁর স্থানটি অপূর্ণ থাকে না বটে, তবে তাঁ পূরণ হয় খাটোদের দ্বারা।
দুটি প্রধান দলের কার্যনির্বাহী পরিষদের বৈঠকের দিকে তাঁকালে (টিভিতে দেখা যায়) মনে হয়, বৃদ্ধাশ্রমের সদস্যরা খাওয়া-দাওয়া করে বসে বসে জীবনের সুখ-দুঃখের গল্প করছেন। তাঁদের আর দেশকে দেওয়ার কিছুই নেই। তাঁরা যে অন্যায় কাজটি করেছেন তাঁ হলো, নতুন নেতৃত্ব তৈরি হতে দেননি। সিকি শতাঁব্দী যাবৎ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হতে দেয়নি সরকারগুলো। তাঁর ফলে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন খুব বড় ব্যবসায়ী ও কালোটাকার মালিকেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন।
গণতাঁন্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তে রাজনীতিতে চালু হয়েছে একটি সামন্তবাদী প্রথা। উত্তরাধিকারের রাজনীতি। যেন রাজনীতিটা নেতাঁর জমিদারি। কোনো নেতাঁ মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিধবা স্ত্রী, পুত্র, কন্যা বা পুত্রবধূকে উপনির্বাচনে দঁাড় করিয়ে তাঁর স্থান পূরণ করা হয়। তাঁর ফলে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না। সেখানকার মেধাবী ও যোগ্যদের ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে সামনে এনে মঞ্চে বসিয়ে দেওয়া হয় কারও ছেলে, মেয়ে বা স্ত্রীকে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষিত নেতাঁ তৈরির পথ বন্ধ, সেখানে তৈরি হচ্ছে দুর্ধর্ষ ক্যাডার, স্থানীয় পর্যায় থেকেও নেতৃত্ব তৈরির দরোজা বন্ধ।
উপযুক্ত শিক্ষা ও ভালো দীক্ষা ছাড়া সুনেতৃত্ব তৈরি হয় না। বাঙালির শিক্ষার মানের সুনাম ছিল। আজ শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের উপক্রম হয়েছে৷ অথচ দেশে মেধাবী ছেলেমেয়ের সংখ্যা লাখ লাখ। অব্যবস্থার কারণে তাঁদের মেধা বিকশিত হতে পারছে না। শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার প্রধানতম কারণ নষ্ট রাজনীতি। মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া রাজনীতি মানসম্মত হবে না। যোগ্য নেতাঁ তৈরি হবে না। দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্বল ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্ব তৈরি হয়। দুর্বল আমলা তৈরি হয়। রাষ্ট্র চালান রাজনৈতিক নেতাঁ ও আমলারা যৌথভাবে। সেই নেতাঁ ও আমলারা যদি উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, জাতির মুক্তি তখন অসম্ভব হয়ে পড়ে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো যা টেকসই গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য, তাঁ ধ্বংস হয়ে যায়।
রাষ্ট্রীয় অনাচার ও অব্যবস্থা থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাঁশা ও ক্ষোভের জন্ম নেয়। ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে একবার, রোজ রোজ নয়। ব্যক্তিস্বাধীনতাঁ ও গণতন্ত্র সমার্থক। নতুন চিন্তাতাঁ ও মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতাঁ না থাকলে সহিংস উপায়ে সরকার পরিবর্তনের আয়োজন হতে থাকে ভেতরে ভেতরে। নেতৃত্বহীন অবস্থায়ও আকস্মিক বিস্ফোরণে পুরোনো শাসকশ্রেণি উড়ে যায়। তাঁর ফলাফল যে সব সময় ভালো হয়, তাঁ নয়। আমরা সাম্প্রতিক সময়ে আরব বসন্তে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে সেই অবস্থা দেখেছি। স্বৈরশাসন থেকে নৈরাজ্য হয়েছে, সরকারের পতন হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে। যোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া জনগণের মুক্তি আসে না। মধ্যযুগের শাস্ত্রশাসিত রাষ্ট্র আর একনায়ক শাসিত রাষ্ট্র দুই–ই সমান ক্ষতিকর। দুটিই মানুষের মুক্তির পথে সমান বাধা।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷

No comments

Powered by Blogger.