ফেনীতে বর্বরতা: গডফাদার কে?

অশান্ত আর আতঙ্কের জনপদ এখন ফেনী। উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হকের নির্মম হত্যার প্রতিবাদে ফুলগাজীতে পালিত হচ্ছে হরতাল। বর্বর এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মুখর জনতা। গুলি করার পর আগুন দিয়ে হত্যা- এ বর্বরতা মেনে নিতে পারছেন না কেউই। ফেনীর মানুষের মুখে মুখে খলনায়কের নাম। যদিও মামলা হয়েছে বিএনপির এক নেতাসহ ৩৬ জনের বিরুদ্ধে।
একাধিক সূত্রের দাবি, চাপের মুখে এ মামলা দায়ের করতে বাধ্য হয়েছেন নিহতের ভাই রেজাউল হক জসিম। তাকে লোভও দেখানো হয়েছে। একরামের স্ত্রী মামলা দায়ের করতে চাইলেও তার ভাইকে দিয়ে মামলা করানো হয়েছে। মামলায় বিএনপি নেতারা আসামী হলেও ফেনীতে একরামুল হকের কর্মীদের দাবি ভিন্ন। এ নির্মম হত্যার জন্য ফেনী সদর আসনের এমপি নিজাম হাজারীকে দায়ী করেছেন তারা। একরামুল হকের সমর্থকদের শ্লোগান দিতে শোনা গেছে, একরাম ভাই মরল কেন? নিজাম হাজারীর ফাঁসি চাই। পুলিশ এ পর্যন্ত সন্দেহবশত বেশ কয়েকজনকে আটক করলেও ঘটনার ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি। ফেনীর স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, একসময় জয়নালী হাজারীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন নিজাম হাজারী এবং একরামুল হক। পরে ফেনীর রাজনীতি থেকে জয়নাল হাজারীকে দূরে রাখতে তারা দুই জন বড় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু সম্প্রতি নিজাম হাজারী এবং একরামুল হকের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। গত সংসদ নির্বাচনে ফেনীর দুটি আসন থেকে নিজাম হাজারী এবং একরামুল হক মনোনয়ন চান। নিজাম হাজারী মনোনয়ন পেলেও একরামুল হক মনোনয়ন পাননি। একরামের সমর্থকদের ধারণা এতেও নিজাম হাজারীর হাত ছিল। পরে ফুলগাজী উপজেলা নির্বাচনেও একরামের বিরোধিতা করেন নিজাম হাজারী। একরাম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি নিজাম হাজারীর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়ে যান। তবে নিজাম হাজারী একরামের ওপর চূড়ান্ত ক্ষুদ্ধ হন একটি জাতীয় দৈনিকে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের পর। যে সংবাদে নিজাম হাজারী কম সাজা ভোগ করে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন বলে দাবি করা হয়। এ সংবাদ প্রকাশে একরামের হাত ছিল বলে নিজাম হাজারীর পক্ষের অনেকেই মনে করেন। এ ঘটনার জেরে একরাম খুন হতে পারেন বলে ফেনীতে গুঞ্জণ রয়েছে।
প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা একরামুল হককে হত্যার ঘটনায় স্বদলীয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সন্দেহের তালিকায় প্রথমে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ গোয়েন্দা সূত্রগুলো৷ এ ঘটনার পর স্থানীয় সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারীর সঙ্গে একরামের দ্বন্দ্বের কথা ফেনীতে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে৷ নিহত একরামের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রের দাবি, হামলাকারীদের অনেককে চেনা গেছে৷ এতে কিছু ভাড়াটে সন্ত্রাসীকেও ব্যবহার করা হয়েছে৷ জানতে চাইলে ফেনী জেলা পুলিশ সুপার পরিতোষ ঘোষ বলেন, পুলিশ বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত শুরু করেছে৷ কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে৷ সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আর কিছু বলতে পারছি না৷
স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময়ের সন্ত্রাসের গডফাদার হিসেবে পরিচিত জয়নাল হাজারীকে ফেনীর আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজাম হাজারী ও একরাম ছিলেন এককাট্টা৷ একজনের বিপদে আরেকজন ছুটে যেতেন৷ একরাম ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আর নিজাম হাজারী ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক৷
খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত একরামের সঙ্গে নিজাম হাজারীর মধ্যে দৃশ্যত সুসম্পর্ক থাকলেও বছর খানেক ধরে তাঁদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব চলে আসছিল৷ ফেনীর বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের উন্নয়নকাজের দরপত্রের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতেন একরাম৷ এ নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে৷
সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরামকে চরম নৃশংসতায় নির্মমভাবে কারা খুন করল, কে ষড়যন্ত্রকারী, কারা সরাসরি এ হামলায় অংশ নিয়েছেন এসব প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজা হচ্ছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, অন্য কেউ নয়, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপিই জড়িত। বিএনপির দাবি, তাদের কেউই এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়। স্থানীয় লোকজন সমকালকে জানিয়েছেন, এখানে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা এতই দুর্বল যে, এমন নৃশংস ঘটনা ঘটানোর মতো সাহস তাদের নেই। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেই একরামুল হক একরাম নিহতহয়েছেন। একরামের জানাজা শেষে ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে। বিক্ষুব্ধ কিছু লোক তার কুশপুত্তলিকাও দাহ করে। থানায় একরামের ছোট ভাই যে মামলা করেছেন, তাতে আসামি বিগত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী ও একরামের প্রতিদ্বন্দ্বী গার্মেন্ট ব্যবসায়ী মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী মিনার। স্থানীয় বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে আলাপকালে বারবার হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর নামই উঠে এসেছে। অবশ্য নিজাম হাজারী গণমাধ্যমের কাছে এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, একটি স্বার্থান্বেষী মহল এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাকে জড়ানোর চেষ্টা করছে।
নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত সাবেক এমপি জয়নাল হাজারী বলেছেন, হত্যার পরিকল্পনাকারী কে, সব খবর তিনি জানেন। তিনি কারও নাম বলেননি। ফেনী থেকে প্রকাশিত হাজারীর দৈনিক পত্রিকা হাজারিকা-য় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, একরাম গুম কিংবা খুন হতে পারেন।
যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পেশাদার হত্যাকারী ভাড়া করে সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য গাড়িতে গানপাউডার ছড়িয়ে আগুন দেয়া হয়। একরাম যাতে গাড়ি থেকে বের হতে না পারেন সে বিষয়টি খুনিরা কাছ থেকে নিশ্চিত করেছে। একরামুলকে সরিয়ে দিতে তার রাজনৈতিক শত্র“রা তিন কোটি টাকায় কিলার ভাড়া করে। কিলিং মিশনে অংশ নেয় ২০ জন। ফেনী ছাড়াও ঢাকা থেকে কিলার আনা হয়। পুলিশ কিলারদের অনেককেই শনাক্ত করেছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তাদের গ্রেফতার করছে না। জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হককে চিরতরে সরিয়ে দিতে বিপুল অংকের এই টাকার জোগান দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতা নামধারী কতিপয় দুর্বৃত্ত। তবে এসব দুর্বৃত্তের বেশিরভাগই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে ।

No comments

Powered by Blogger.