হাসান রুহানির হারানো সুযোগ

হাসান রুহানি
ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির ব্যক্তিত্বের চমক ফুরিয়ে গেছে। তাঁর এই চমক বেশ ভালো কাজ করেছিল গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময়, যখন তাঁর সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব করার ছিল: ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে একটা চুক্তি—এমন আশা জাগানো যে ইরানের কঠোর পররাষ্ট্রনীতি এবার নমনীয় হবে। কিন্তু সম্প্রতি জেনেভায় সিরিয়া নিয়ে দ্বিতীয় দফার সম্মেলনে ইরানকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন যখন প্রত্যাহার করলেন, তখন বোঝা গেল, রুহানির দেশের বিচ্ছিন্নতা দূর করতে হলে তাঁর ব্যক্তিত্বের আরও চমৎকারিত্ব প্রয়োজন; কিংবা এমনকি তুর্কি প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের তেহরান সফরের প্রয়োজন। রুহানি তাঁর পূর্বসূরি মাহমুদ আহমাদিনেজাদের স্থূল নেতৃত্বকে অতীতের গহ্বরে পাঠিয়ে দেওয়ার কাজটি ভালোভাবেই করতে পেরেছেন।
আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের কাছে ইরানের দরজা খুলে দেওয়া, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদিতে পরিমিতি-সংযমের আহ্বান জানানো এবং এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে স্বাক্ষরিত পরমাণুবিষয়ক সমঝোতা চুক্তি মেনে চলার যেসব উদ্যোগ রুহানি নিয়েছেন, ইরানি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সেসবের প্রতি সমর্থন জুগিয়েছে। বস্তুত, ইরানের পরমাণু কর্মসূচিবিষয়ক সমঝোতা চুক্তিটি যদি ইরানের ভেতরে ও আন্তর্জাতিকভাবে যথেষ্ট মাত্রায় স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে, তাহলে সেটাই হবে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের থেকে এ পর্যন্ত ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অর্জন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করায় বিষয়টি আরও প্রতিশ্রুতিময় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরান সরকারের সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা মধ্যপ্রাচ্যে একটা উদ্বেগের উৎস হিসেবেই রয়ে গেছে। কারণ, এর ফলে ইরান আরও শক্তিশালী হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমের প্রতি রুহানির অপেক্ষাকৃত উদার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে ইরানের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না।
জেনেভায় ইরানকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়টি বান কি মুন স্থগিত করেছেন যুক্তরাষ্ট্র ও সিরিয়ার আসাদবিরোধী পক্ষের  চাপের মুখে। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইরান সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারকে জরুরি অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে। সেই সঙ্গে তাঁর লেবাননি মিত্র শক্তিশালী হিজবুল্লাহ গেরিলাদের সংগঠিত করে সিরিয়ায় আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়তে মদদ দিচ্ছে। ইরান নিঃসন্দেহে সিরীয় সমীকরণের একটা অংশ; সিরিয়ার ব্যাপারে কোনো বন্দোবস্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ইরানের সংশ্লিষ্টতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সিরিয়ার বিষয়ে একটা দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করে রুহানি কোনো বিবৃতি প্রকাশ করেননি; আসাদ সরকারের সংগঠিত নির্যাতন-গণহত্যার চিত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখার পরেও রুহানি সিরিয়ার বিষয়ে কোনো শক্ত কথা বলেননি। তাঁর এই ব্যর্থতা সিরিয়াবিষয়ক আলোচনায় ইরানকে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়নি। ইরানের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করার একটা সুযোগ রুহানি সম্প্রতি পেয়েছিলেন দাভোসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে। কিন্তু তিনি সেই সুযোগ ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের সম্পর্কে তিনি শুধু এটুকু মন্তব্য করেছেন যে জনগণকে বোঝা ও জনগণের সঙ্গে যুক্ত থাকার সামর্থ্য তাঁদের নেই। দাভোসে সমবেত বিশ্বনেতাদের প্রত্যাশা ছিল, রুহানি হয়তো সিরিয়া ও অন্যান্য আঞ্চলিক সমস্যার ব্যাপারে একটা দৃঢ় বিবৃতি দেবেন। কিন্তু তিনি তা না করে জাতীয়তাবাদী বাগাড়ম্বরপূর্ণ একটা বক্তৃতা দিয়েছেন, ‘ইরানবিরোধী পক্ষপাত’ অবসানের কথা বলেছেন। রুহানির নিশ্চয়ই জানা ছিল যে সিরিয়ায় মানবিক বিপর্যয় সম্পর্কে তিনি কিছু না বললে তাঁর কূটনৈতিক নীতিকৌশল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁর ব্যর্থতার কারণ হতে পারে দুটি: হয় বিদ্যমান নীতি পরিবর্তনের পক্ষে ইরানের শাসকদের মধ্যে মতৈক্য নেই, নয় তাঁরা আসাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে ঐক্যবদ্ধ।
এ দুইয়ের কোনোটাতেই কোনো চমৎকারিত্ব নেই; এ কারণেই রুহানি সিরিয়ার ব্যাপারে তাঁর দেশের অবস্থান পরিষ্কার করেননি। এ সপ্তাহে এরদোয়ানের তেহরান সফর সিরিয়া নিয়ে উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক হতে পারে। এ বিষয়ে তুরস্ক ও ইরানের অবস্থান পরস্পর বিপরীত। কিন্তু এরদোয়ানের তেহরান সফরের ফলে ইরানের শাসকদের মধ্যকার বিভাজন দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম; কট্টরপন্থীরা আসাদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করতে রাজি হবেন—এমন সম্ভাবনাও নেই। ফলে এই সফরের তাৎপর্য অনিশ্চিত। সিরিয়ার ব্যাপারে একটা শক্ত অবস্থান নিতে অস্বীকৃতি জানানোর মধ্য দিয়ে রুহানি ২৩ লাখ সিরীয় শরণার্থীর স্বার্থের চেয়ে বড় করে দেখছেন নিজের স্বার্থকে। যে এক লাখ ৩০ হাজার সিরীয় নিহত হয়েছেন, আরও যে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং অবশিষ্ট যে বিপুলসংখ্যক মানুষ সীমাহীন বিপদ ও দুঃখ-কষ্টের মধ্যে রয়েছেন, তাঁদের স্বার্থও হাসান রুহানি উপেক্ষা করছেন। আরও গুরুতর বিষয় হলো, সিরিয়ায় এই মানবিক বিপর্যয়ে ইরানের ভূমিকা স্বীকার করতে রুহানি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। দাভোসে তিনি যখন বলেন, ‘এই অঞ্চলে আমরা আমাদের ভাইদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি নির্বিকার থাকতে পারি না’, তখন হয়তো তিনি সব দায়দায়িত্ব চাপাতে চেয়েছেন আসাদ সরকার ও তার সহযোগীদের কাঁধে। সিরিয়ার জনগণের যা প্রয়োজন, তা বাগাড়ম্বর বা ক্যারিশমা নয়। তাদের প্রয়োজন সক্রিয় পদক্ষেপ। ইরান সেই পদক্ষেপ নিতে অক্ষম বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। সে কারণেই হাসান রুহানির ব্যক্তিত্বের চমক এটা প্রমাণ করতে যথেষ্ট নয় যে ইরান নামের ইসলামি প্রজাতন্ত্রটি শীতল অতীত থেকে বেরিয়ে আসতে প্রস্তুত।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
বুলেন্ত আরাস: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সাবানসি ইউনিভার্সিটি, ইস্তাম্বুল। গ্লোবাল ফেলো, উইলসন সেন্টার, ওয়াশিংটন ডিসি।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

No comments

Powered by Blogger.