সমাধান তাহলে হয়েই গেল! by মনির হায়দার

অবশেষে পাশে নেই যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত। অন্যসব শরিক দলের নেতারা যথারীতি খালেদা জিয়ার দুই পাশেই ছিলেন। বক্তৃতাও করেছেন তারা।
পুরনোদের সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছেন খণ্ড-বিখণ্ড জাতীয় পার্টির সর্বশেষ অংশের নেতা কাজী জাফর আহমদ। অবশ্য এই জোটে তাঁর যুক্ত হওয়ার কোন ঘোষণা কোন পক্ষ থেকেই দেয়া হয়নি। তবে বহুকাল পর তাকে দেখা গেল বিএনপির কোন সমাবেশে বক্তৃতা করতে। এলডিপি’র অলি আহমদ ও বিজেপির আন্দালিব রহমান পার্থসহ অন্য সব শরিক দলের নেতারাও বক্তৃতা করেছেন। সোমবার বিকালে এমনই ছিল সোহরাওয়ার্দী  উদ্যানের দৃশ্যপট। যদিও সমাবেশটি ছিল বিএনপির। তবুও সেখানে ১৮ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর প্রায় সব নেতাই হাজির ছিলেন। দেখা যায়নি কেবল জামায়াত নেতাদের। নিঃসন্দেহে এ এক নতুন দৃশ্য। অন্তত বিগত পাঁচ বছরে এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায়নি। কাগজে কলমে কখনও চারদলীয়, আবার কখনো ১৮দলীয় জোট বলা হলেও বাস্তবে প্রতিপক্ষ বরাবরই এটাকে ‘বিএনপি-জামায়াত জোট’ হিসেবেই অভিহিত করেছে। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, জামায়াতকে ছাড়া বিএনপির পথ চলাই যেন অসম্ভব। আর এটাকেই সবচেয়ে বড় ইস্যু হিসেবে সামনে নিয়ে আসে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা।

সামপ্রতিক বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা বিএনপিকে অভিযুক্ত করেছে মূলত জামায়াতের সঙ্গে মাখামাখির দায়ে। চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্যও তারা বিএনপির জামায়াতপ্রীতিকেই দায়ী করেছে। ‘জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করলে বিএনপির সঙ্গে কোন আলোচনা বা সমঝোতা নয়’- কথাটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তার দলের নেতারা কত হাজার বার যে বলেছেন, তার কোন হিসাব নেই। এই ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের, বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সমর্থনও আদায় করতে পেরেছেন তারা। এই প্রেক্ষাপটেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া গত সপ্তাহে বিবিসিকে বলে বসেন যে, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কটা সাময়িক। বিএনপির ঘাড়ে থাকা জামায়াতি বোঝার ভার অনেকটাই স্পষ্ট হয় খালেদা জিয়ার এই কথায়। সর্বশেষ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের গৃহীত প্রস্তাবেও জামায়াত-হেফাজতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছেদের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এ অবস্থায় গত ক’দিন ধরে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে নানা গুঞ্জন। নাজুক দশা কাটিয়ে উঠতে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের অনেকেই নাকি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছেন দলনেত্রীকে। এছাড়া, ঢাকায় দায়িত্বরত বিদেশী কূটনীতিকদের অনেকেই বিএনপিকে একই পরামর্শ দিয়েছেন বলে শোনা যায়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই জামায়াতকে ‘মডারেট মুসলিম ডেমোক্রেট’ সার্টিফিকেট দিয়ে আসছে। তা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন-সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব ক্রমশ বাধা হিসেবেই স্পষ্ট হতে থাকে। অন্যদিকে জামায়াতের অভ্যন্তরেও রণকৌশল পরিবর্তনের চাপ তৈরি হয়েছে বলে পত্রিকার খবরে প্রকাশ। এছাড়া, ময়দানের সহিংসতায় অগ্রভাগে থাকা দলটির নেতাদের বড় একটি অংশ বিএনপির ওপর নাখোশ বলেও খবর বেরিয়েছে।
এমন পটভূমিতেই সোমবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হয়ে গেল বিএনপির জনসভা। গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট অবরুদ্ধ-লণ্ডভণ্ড দশার পর এটিই ছিল দলটির প্রথম শোডাউন। আর সেখানেই দেখা গেল প্রায় অচেনা এক দৃশ্য। ১৮ দলীয় জোটভুক্ত প্রায় সবগুলো দলের নেতা সেখানে মঞ্চে হাজির ছিলেন। জোটের বাইরের নেতা বর্ষীয়ান রাজনীতিক কাজী জাফর আহমদকেও দেখা যায় খালেদা জিয়ার পাশে। তবে দেখা যায়নি শুধু জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের। মঞ্চের সামনে উপস্থিত জনতার মধ্যেও আগের সমাবেশগুলোর মতো জামায়াত-শিবিরের আধিপত্য দেখা যায়নি। গোটা সমাবেশস্থলের কোথাও ছিল না তাদের কোন ব্যানার-ফেস্টুনও। হঠাৎ এমন দৃশ্য দেখে নিশ্চয়ই আশান্বিত হয়ে উঠেছে হতাশাক্লান্ত  জাতি। রাজনৈতিক সমঝোতার পথে মূল বাধা বুঝি দূর হয়ে গেল! অন্তত ক্ষমতাসীন মহলের কথা অনুযায়ী।
একটানা দীর্ঘদিনের সংঘাত-সহিংসতা ও দমন-পীড়নে গোটা সমাজ আজ বিপর্যস্ত। বেঘোরে মানুষের প্রাণহানিতে ব্যক্তি নিরাপত্তা আজ উধাও। এ অবস্থায় শঙ্কা আর আতঙ্কের ঘোর অমানিশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পথে বিএনপি-জামায়াতের মাখামাখিটাই যদি মূল প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে থাকে, তাহলে সোমবারের সমাবেশ নিশ্চয়ই সেই বাধা অতিক্রম করার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। সুতরাং এই প্রশ্ন এখন খুবই প্রাসঙ্গিক যে, তাহলে রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান কি হয়েই যাচ্ছে?

No comments

Powered by Blogger.