টানা ১১ মাসের ভীতি

গাবতলী থানার নিরাপত্তায় প্রহরা
৩ জানুয়ারি রাতে বগুড়া পৌঁঁছার পর হোটেলকক্ষে বসেই কিছুক্ষণ পর পর ককটেলের শব্দ পাচ্ছিলাম। সাংবাদিকতা করতে প্রথমবারের মতো বগুড়া গিয়ে বিষয়টি আমার কাছে একটু ভীতিকর মনে হলো। একেকটি বিস্ফোরণের শব্দ পাই আর আমি মুঠোফোনে স্থানীয় প্রতিনিধি আনোয়ার পারভেজের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কারণ, আমার কাছে এসব ঘটনা ‘সংবাদের বিষয়বস্তু’ বলেই মনে হচ্ছিল। আমার উৎসুক ফোনের জবাবে প্রতিনিধির জবাব ছিল, এসব এখন কোনো বিষয়ই না। মামুলি ঘটনা। দু-একটা দিন থাকেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। চার দিন পর যখন ওই এলাকা ছেড়ে আসি, তখন কথাটি সত্য বলে মানতে বাধ্য হই। সাংবাদিকতার কল্যাণে এত দিনে জেনে গেছি, একই ঘটনা প্রতিনিয়ত যখন ঘটতে থাকে, তখন সেটির সংবাদমূল্যও কমতে থাকে। সেই অনুযায়ী, বগুড়ার ককটেল বিস্ফোরণ নিতান্তই সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এ কারণে তা আলাদাভাবে সংবাদমূল্য হারিয়েছে। সকালের শুরুটা কিংবা মাঝরাতে ককটেলের শব্দে ঘুম ভাঙার মুহূর্তগুলোকে আত্মস্থ করে ফেলেছে বগুড়ার মানুষ।
৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের খবর সংগ্রহে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে প্রতিনিয়ত। তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার রায়ের পর থেকেই বদলে যায় বগুড়ার চিরচেনা দৃশ্যপট। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে সহিংসতা শুরু। একের পর এক ঘটনায় জেলাটিতে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগীরা। তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য ছিল নিরাপত্তা বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন স্থাপনা। এই অবস্থার কারণে প্রায় এক বছর ধরে রুদ্ধশ্বাস এক পরিবেশের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন বগুড়ার সাধারণ মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রতিদিনের স্বাভাবিক জীবনযাপন সবই বিপন্ন। এই বিপন্নতা থেকে মুক্তির আকুতি ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের। ফিরে আসার দিন হোটেল ত্যাগের আগে হোটেল কর্মচারীর মুখেও তার প্রমাণ পাওয়া গেল। ‘স্যার, ঢাকা থেকে আসছেন। আপনারা তো দেশের অনেক খবর জানেন। কবে থেকে দেশ আবার স্বাভাবিক হবে? আমরা কবে আবারও শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারব?’ দীর্ঘদিন ধরে চলমান এই সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিল সদ্য শেষ হওয়া দশম সংসদ নির্বাচন। ভোটকে কেন্দ্র করে নির্বাচনী এলাকা গাবতলীর মডেল থানা আক্রমণ, কেন্দ্রে কেন্দ্রে হামলা, ভাঙচুর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ, মানুষের মল ছিটিয়ে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করার মতো ঘটনা ঘটেছে। সেই সঙ্গে ভোটের প্রহসন তো ছিলই।
ভোটের সব সরঞ্জাম নষ্ট করে ফেলার পরও গাবতলী উপজেলার বেশ কিছু কেন্দ্রে ভোটের প্রশ্নবিদ্ধ ফল প্রকাশের মতো ঘটনাও ঘটেছে। সংবাদপত্রের পাতায় সেসব খবর ছাপা হয়। বগুড়ায় অবস্থানকালে যে হোটেলে উঠেছিলাম, ‘দীর্ঘদিন বিরতির’ পর আমরাই ছিলাম সেটির প্রথম অতিথি। আমরা বলতে আমি এবং নির্বাচনী খবর সংগ্রহে যাওয়া ঢাকার আরেকটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রতিবেদক ও ক্যামেরাম্যান। হোটেলের মালিক নিজেই জানালেন, অনেক দিন ধরেই অতিথিশূন্য আবাসিক এই হোটেলটি। ফিরে আসার দিনে বগুড়ার বিখ্যাত সবজির বাজার মহাস্থানহাটে গিয়ে জানা গেল সবজিচাষিদের হাহাকারের কথা। বিক্রেতার অভাবে মাঠে সবজি ফেলে দেওয়ার কথা জানালেন অনেকে। এসব মানুষের কষ্টের কাছে অবরোধ ও হরতালের মধ্যে যানবাহনহীন অবস্থায় নানা পন্থায় ভেঙে ভেঙে নির্বাচনের খবর সংগ্রহে বগুড়ায় পৌঁছানোর কষ্ট হয়ে যায় অতিতুচ্ছ। জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগীদের তাণ্ডবে বগুড়ার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়েছে যে দিনদুপুরে ওই এলাকার মহাসড়কে চলতে গেলেও ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। যে মহাসড়ক ভারী যানবাহনে ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে ছিল যানবাহনের স্বল্পতা। কদাচিৎ কিছু যানবাহনের দেখা মেলে। যার বেশির ভাগ ছিল নছিমন, করিমন, রিকশা, ট্যাক্সি ও মোটরসাইকেল।
কিছু কিছু পণ্যবোঝাই ট্রাক দেখা গেল নিরাপত্তাবেষ্টনীতে চলাচল করতে। ভোটের আগের দিন ভোটারদের সঙ্গে কথা বলতে জেলার শাজাহানপুর উপজেলার একটি গ্রামে গেলাম আমরা কয়েকজন সাংবাদিক। মূল সড়ক থেকে কিছুটা মেঠোপথ পেরিয়ে ওই গ্রাম। মোটরসাইকেলের শব্দ শুনেই ওই গ্রামের উঠানে দাঁড়ানো পুরুষ-নারীরা তাড়াহুড়ো করে স্থান ত্যাগ করলেন। ভয়ে কাতর মানুষগুলো আশ্রয় নিলেন ঘরের ভেতর। পরে অবশ্য সাংবাদিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর কয়েকজন বাইরে বেরিয়ে এলেন। কথা বললেন। কথায় কথায় জানা গেল তাঁদের শঙ্কা, আতঙ্কের কথাও। প্রতিনিয়ত অজানা শঙ্কা তাড়িয়ে বেড়ায় এঁদের। তাই গাড়ির শব্দ, বেশি মানুষের আগমন মানেই তাঁদের কাছে ভয়। ভয়মুক্ত নয় বগুড়ায় কর্মরত সাংবাদিকেরা। একা একা কোথাও সংবাদ সংগ্রহে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ঝুঁকির কারণে ভোটের দিনেও দল বেঁধে যেতে হলো ভোটকেন্দ্রে। সর্বশেষ খবর নিয়ে জানা গেল, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরছে। গাড়ি চলছে, দোকানপাট খুলছে। ব্যবসা বাণিজ্যও জমতে শুরু করেছে। কিন্তু এরই মধ্যে যে ক্ষতি হয়ে গেছে সেটি পুষিয়ে নেওয়ার কাজটি হয়তো এত দ্রুত সম্ভব নয়। তবু নতুন করে আর যেন ক্ষতির মুখে পড়তে না হয় এই কামনা এখন বগুড়াবাসীর। সেসব মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, ভালো থাকুক বগুড়াবাসী, ভালো থাকুক প্রিয় স্বদেশ।
সুজয় মহাজন: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.