কেন্দ্রবিন্দুতে রাজনীতি by ড. মাহফুজ পারভেজ

বাংলাদেশ এবারই প্রথমবারের মতো বিশ্বব্যাপী আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে প্রধানত রাজনৈতিক কারণে। প্রাকৃতিক বা অর্থনৈতিক বা দুর্নীতিবিষয়ক ইস্যুতে অতীতে বিশ্ব শিরোনাম হলেও এবার বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার মূল-কারণ রাজনীতিক।
১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কতটুকু গণতন্ত্রসম্মত হয়েছে এবং সে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বৈধতার প্রসঙ্গটি এখন দেশ-বিদেশের অন্যতম আলোচিত বিষয়। এই পরিস্থিতিতে বিগত মাসগুলোর বিপর্যস্ত অবস্থান থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সঠিক, সমন্বিত ও শান্তিপূর্ণভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে কিনা, সেটাও উল্লেখিত হচ্ছে। রাজনীতি ঠিক না হলে যে, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, আইন-শৃঙ্খলা ছন্দ ফিরে পাবে না, এমন শঙ্কাও রয়েছে। অতএব, যে সংসদ, সরকার ও বিরোধী দল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তা রাজনৈতিকভাবে সত্যিই সফল হতে পারে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। এক্ষেত্রে কেবল ক্ষমতার ভাগাভাগিজনিত নির্বাচন-পূর্ব সাফল্য নয়; বরং নির্বাচন-পরবর্তী সাফল্যের তুলাদণ্ডেই পরিমাপ করা হবে নতুন সরকারকে। অন্যদিকে বিরোধী দলীয় কার্যক্রমের সাফল্য-ব্যর্থতার বিষয়গুলোকেও পুরোপুরি আড়াল করে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাদেরকেও আত্মসমালোচনার আয়নায় নিজেদের প্রকৃত চেহারা দেখার সময় এসেছে। নেতৃত্ব, সংগঠন, কৌশল ও কর্মসূচির দিক থেকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তারা কি করেছেন এবং ভবিষ্যতে কি করবেন, সেটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করাও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করার জন্যই এসব অতি জরুরি চিন্তা-ভাবনা-আত্মসমালোচনা তাদেরকে করতে হবে। বস্তুত, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন সত্যিকার অর্থেই পাড়ি দিচ্ছে সন্ধিক্ষণ। অতীতের দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার কাঠামো একটি প্রবল পালাবদলের মুখে। সরকার ও বিরোধী, যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, দেশের রাজনৈতিক শক্তিসমূহকে নানা রকমের পট-বদল ও পরীক্ষার বিরূপ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই যেতে হচ্ছে। সরকারে আসীন আওয়ামী লীগের পরীক্ষা একরকম আর ক্ষমতার বৃত্ত থেকে সদ্য ছিটকে-পড়া বিএনপির পরীক্ষার ধরন স্বাভাবিক কারণেই আরেক রকমের। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি, যেমন জাতীয় পার্টি ও জামায়াত, এরাও পরীক্ষার বাইরে নেই। অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকাশের পথে নানা পরীক্ষার সামনে পড়েছে দল দুটি। সন্দেহ নেই, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপরের ঘটনা-প্রবাহ বাংলাদেশের এ যাবৎকালে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বিন্যাসের মূল ধরে টান দিয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎও এ টানাটানির কারণে শঙ্কামুক্ত নয়। একটি সুপ্ত ও চাপা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা মোটেও আড়াল করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সামনের দিনগুলোর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক চিত্র সম্পর্কে কেউই আশাবাদী উপসংহার টানতে পারছেন না। কেননা, খোদ রাজনীতিই যদি আক্রান্ত বা বেপথু হয়, তখন সুশাসনসহ সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইন-শৃঙ্খলা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সেটার ঝাপটা এসে লাগবেই। রাজনীতিকে সঠিক পথে আনার জন্য ক্রেডিবল, পার্টিসিপেটরি, ইনক্লুসিভ, ফ্রি-ফেয়ার, ট্রান্সপারেন্ট নির্বাচনের কথা ছাড়া অন্য কোন পন্থার কথা কেউ বলতে পারবেন না। অন্য কথা বা পথ যারা বাতলে দিচ্ছেন, তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে কাজ করছেন বলা যাবে না। অতএব সব কিছুই করতে হবে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থার শাশ্বত নীতিকে মেনেই। ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার গতানুগতিক রাজনীতির একমুখী লক্ষ্য থেকে আরও বৃহত্তর পরিসরকে বিবেচনায় না নেয়া হলে, ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী, কেউই দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে পারবেন না। এবং সন্ধিক্ষণের সঙ্কটাবর্তে বিপর্যস্ত রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে যথাযথ স্থানে ও মর্যাদায় তুলে আনতেও পারবেন না।

No comments

Powered by Blogger.