সুজাতা হাসিনার ভাবনা by আমিরুল ইসলাম কাগজী

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বলে গেছেন, গণতন্ত্রের স্বার্থেই বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়া উচিত। ঢাকা সফরের সময় তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও
কর্মকর্তাদের স্পষ্টভাবেই জানান, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে অবহিত হয়েই এসেছেন তিনি। আর প্রধানমন্ত্রী তাকে বিশেষ বিমানে বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন। সফরের প্রথম দিন তিনি মন্তব্য করেছিলেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকুক, এমনটাই চায় ভারত। এ ব্যাপারে তিনি নেপালের প্রসঙ্গ তুলে বলেছিলেন, একটি দল নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিলেও শেষ পর্যন্ত সেখানে নির্বাচন হয়েছে। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে ওই নির্বাচন অপরিহার্য ছিল। এ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বারবার বলার চেষ্টা করেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক দল অংশগ্রহণ করুক, সেটাই চায় ভারত। প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বাধীন জোট বাইরে থাকলে তাতে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়বে না, এমনটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন সুজাতা সিং। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বারস্থ হওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না সুজাতার মতো একজন জন্মগত সূত্রের কূটনীতিকের। তিনি এরশাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে মূলত এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, ভারত সরকার চায় শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে তিনি যেন থাকেন। তাহলে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার পথ রুদ্ধ হবে।
প্রতিবেশী একটি দেশের অনেক কিছু চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে। কেমন সরকার থাকলে তাদের সুবিধা হয়, এটাও প্রকাশ করতে পারে। তাই বলে তাদের চাওয়া-পাওয়া সেদেশের জনগণের ওপর চাপিয়ে দেবে, এটা কেমন গণতন্ত্র? ভারত নিজেকে গণতান্ত্রিক দেশ দাবি করলে বাংলাদেশের জনগণের মতামতের কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে? এরা কেমন প্রতিবেশী? তিনি নেপালের উদাহরণ দিয়েছেন। বাংলাদেশ আর নেপাল এক নয়। এখন নেপালে ভারতীয় মুদ্রার দাপট রয়েছে। তাদের স্বাধীন মত প্রকাশ এখনো নির্ভর করে ভারতের চাওয়া-পাওয়ার ওপর। বাংলাদেশের জনগণ সেই অবস্থান থেকে অনেক আগেই সরে আসতে সক্ষম হয়েছে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে। এখন তারা গণতন্ত্রচর্চা করতে শিখেছে। এই স্বতঃসিদ্ধ বিষয়টি নিশ্চয়ই জেনে এসেছিলেন সুজাতা সিং? আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের মানুষ কেবল ভোট দেয়াকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ বুঝলেও শাসকশ্রেণীর বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কেও টনটনে অভিমত ব্যক্ত করে থাকে। তাই তো তারা নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে চায়। তাদের এখন একটাই চাওয়া, আর সেটা হলো— সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচন। আর সেটা নিশ্চিত করতে হলে কোনো দলীয় সরকারের অধীনে সম্ভব নয়। এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। দেশের ৯০ ভাগ মানুষ সেটা মানলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেটা মানতে নারাজ। আর সেজন্য তিনি বাংলাদেশের মানুষকে তার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে জনগণকে বাধ্য করাচ্ছেন। এটা জেনে-শুনেই বাংলাদেশে পা দিয়েছিলেন সুজাতা সিং। কিন্তু তিনিও নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একগুঁয়েমিকে প্রাধান্য দিয়ে এরশাদকেও তার সঙ্গে কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন।

এখন বোঝা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা কেন গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে একটা ভোটারবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তার পাশে তো ভারত রয়েছে। তাহলে তিনি বিএনপিকে কেন পাত্তা দেবেন? দেশের সাধারণ মানুষ না জানলেও শেখ হাসিনা তো জানেন তিনি কীভাবে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেছেন? একটি সাধারণ জাতীয় নির্বাচনে ১০ শতাংশ ভোটার নির্বাচনী কার্যক্রমে লিপ্ত থাকেন। আর ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর আরও বেশ কিছু লোক মারা যান। ফলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ কখনোই ভোট দিতে পারেন না। কিন্তু নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭৪টি আসনে ভোট পড়েছিল ৯০ থেকে ৯৪.৫ শতাংশ ভোট এবং ১৩৪ আসনে পড়েছিল ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ভোট। আওয়ামী লীগ জোটকে জিতিয়ে আনতেই ভোটের হিসেবে এমন গড়বড় করা হয়েছিল।
এমন একটি ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর প্রথম রাতেই বিড়াল মারা হলো। ঘটনা পরস্পরায় এমনটি মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রথমত বিডিআর ধ্বংস করতে পিলখানায় মঞ্চস্থ করা হলো বিদ্রোহের নাটক। হত্যা করা হলো ৫৭ সেনা অফিসারকে। প্রধানমন্ত্রী আবার বিদ্রোহীদের সঙ্গে বৈঠকও করলেন। বিচার বসালেন। বিডিআর নাম পরিবর্তন করে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ করা হলো। আর হত্যাকাণ্ডের শিকার কর্মকর্তাদের নামে ফ্ল্যাট দেয়ার অছিলায় বেগম খালেদা জিয়াকে তার সেনাকুঞ্জের মইনুল রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হলো। এক ঢিলে দুই পাখি নয়, বহু পাখি মারলেন প্রধানমন্ত্রী। সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী বিডিআরের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হলো, মেধাবী ৫৭ অফিসারকে হত্যা করা হলো এবং বেগম জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হলো। নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ল একটা বাহিনী। যে কারণে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত ফেলানীর লাশ দু’দিন কাঁটাতারে ঝুলে থাকলেও তা উদ্ধারে কোনো তত্পরতা দেখা যায় না।
শেয়ারবাজারে ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীকে পথের ফকির বানানো, হলমার্কের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লুট করা, দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু না হওয়া, বিরোধী দলকে মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামতে না দিয়ে সরকার মূলত প্রতিনিয়ত তার জনপ্রিয়তা হারিয়ে একেবারে তলানিতে নিয়ে ঠেকায়। এটা আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুঝেছিলেন যে, স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন হলে এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের জয় সুদূর পরাহত। তাই বিএনপি যাতে নির্বাচনে না আসে তার ব্যবস্থা করতেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করলেন। তার অধীনে বিএনপি কোনো কালেই নির্বাচনে যাবে না, এটা তিনি জেনে-শুনে-বুঝেই কাজটি করেছেন। এখন এজন্য তো তাকে খেসারত দিতেই হবে, সারা বিশ্ব এখন এক মেরুতে। কেবল ভারত শেখ হাসিনার পক্ষে। ভারত চায় নির্বাচন ছাড়াই শেখ হাসিনা যুগ যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকুক আর তাদের সেবা করুক। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ কি সেটা মেনে নেবে? নেপালে একটি দল নির্বাচনে না এলেও জনগণ ভোট দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো ভোটই দিতে হবে না। সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাবেন। ভোট ছাড়াই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সরকার কি এক দিনও শান্তিতে দেশ চালাতে পারবে?

No comments

Powered by Blogger.