ঢাকা বেড়াতে আসাই কাল হলো শান্তর by মোর্শেদ নোমান

‘আমার পোলাডার কী অইব? ক্যান যে ঢাকা আইছিল! আর ক্যান যে আমার লাইগ্যা খাওন লইয়্যা গেছিল!’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ইউনিটের ২০৪ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে মোহাম্মদ সোবহানের এ রকম বিলাপ আর বুকফাটা কান্নায় থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন সবাই।
চেষ্টা করছিলেন সান্ত্বনা দেওয়ার। কিন্তু কীভাবে শান্ত হবেন সোবহান? তার বড় ছেলে ১১ বছরের শান্ত ওই ওয়ার্ডেই চিকিত্সা নিচ্ছে। গতকাল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবের সময় জামায়াত-শিবির ও পুলিশের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে গিয়ে মাথা ও পিঠে গুলিবিদ্ধ হয় শান্ত। চিকিত্সকেরা তার অবস্থা আশঙ্কাজনক নয় বললেও আশ্বস্ত হতে পারছেন না সোবহান।
সোবহান জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে মা আসমা বেগমের সঙ্গে থাকে শান্ত (১১) ও ছোট ভাই শাওন (৯)। তিনি নিজে একসময় ছাপাখানায় কাজ করলেও এখন মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুলের সামনে চায়ের দোকানদারি করেন। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে ফকিরাপুলের চেয়ারম্যান গলিতে খালার বাসায় বেড়াতে এসেছিল দুই ভাই। রূপগঞ্জের একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে শান্ত। ছোট ভাই শাওন একই স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে।

সোবহান জানান, ঘটনার দিন দুপুরে শান্ত ও শাওন খালার বাসা থেকে তার জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিল। খাওয়া শেষে টিফিন বাক্সটি নিয়ে বাসায় ফেরার পথে জামায়াত-শিবির ও পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যায় শান্ত। ‘ওই দিনকার পরিস্থিতি দেইখ্যা তাগোরে কইছিলাম, গ্যাঞ্জাম অইতে পারে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিইর্যা যাইতে কইছিলাম। কিন্তু পোলপাইন মানুষ। রাস্তায় এইডা ওইডা দেখতে দেখতে বাসায় যাইতেছিল। সত্যি সত্যি পইড়া গেল গ্যাঞ্জামে।’

ওই ওয়ার্ডের শেষ মাথায় গিয়ে দেখা গেল শান্তকে। মাথায় ব্যান্ডেজ। স্যালাইন চলছে শিরায়। গায়ে আগের দিনের পরা জামাটাই রয়েছে। রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে। শান্তর বিছানায় বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছিলেন মা আসমা বেগম। আর কাউকে দেখলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছিলেন। তিনি জানালেন, সারা রাতই অসহ্য যন্ত্রণায় চিত্কার করেছে শান্ত। ইনজেকশন দেওয়ার পর ঘুমিয়েছে। আসমা বেগম জানালেন, ছুটি পেলেই খালার বাসায় বেড়াতে আসে শান্ত আর শাওন। কিন্তু এই বেড়াতে আসাটাই কাল হয়েছে তার। শান্তর চিকিত্সা আর ভবিষ্যত্ অবস্থা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই আসমার।

শান্তর অবস্থা জানতে চাইলে কর্তব্যরত চিকিত্সক নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী সার্জন পীযূষ কান্তি মিত্র প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, শান্তর অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সে বাসায় ফিরতে পারবে। কিন্তু শান্তর শরীরে যেসব ছররা গুলি রয়েছে, সেগুলো বের করা সম্ভব হবে না। কারণ, এগুলো বের করতে গেলে প্রচুর কাটাছেঁড়া করতে হবে। রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকবে। তাতে ভালোর চেয়ে খারাপই হবে বলে মনে করেন এই চিকিত্সক। তাই সারা জীবনই শান্তকে এসব গুলি শরীরে বয়ে বেড়াতে হবে।

শরীরে থাকা এসব গুলি ভবিষ্যতে শান্তর জন্য ক্ষতির কারণ হবে কিনা, জানতে চাইলে পীযূষ কান্তি মিত্র বলেন, ‘সাধারণত গুলির সোডিয়াম ডাই অক্সাইডের কারণে শরীরে পচন ধরে। কিন্তু এসব গুলিতে সোডিয়াম ডাই অক্সাইড এক ন্যানোগ্রামেরও কম রয়েছে। তাই পচন ধরা কিংবা অন্য কোনো জটিলতার আশঙ্কা নেই।’

এসব বিষয়ে শান্তর মা আসমা বেগম বলেন, ‘আমার পোলাডা যে কষ্ট করতাছে হেইডার কী অইব? ওই দিন তো হরতাল আছিল না, অবরোধ আছিল না। তাইলে ক্যান রাস্তায় বাইর অইয়া আমার এই শিশু পোলার এই অবস্থা অইছে? এই রকম য্যান কারও না অয়। কোনো মায়ের বুকের ধন য্যান এই রকম অবস্থায় না পড়ে।’ ঘটনার সময় শান্তর সঙ্গে থাকা শাওন অক্ষত রয়েছে বলেও জানান আসমা। তবে ভাইয়ের অবস্থা দেখে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে শাওন।

ওয়ার্ড থেকে বের হওয়ার সময়ও দেখা গেল মোহাম্মদ সোবহান তখনো বুকফাটা আর্তনাদ করছেন। সান্ত্বনা দিতে চাইলে ক্ষুব্ধ হয়েই তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা তো শ্রমিক মানুষ। কাম কইর্যা খাই। কুনো রাজনীতি করি না। আমগো বাচ্চা বা আমরা কী রাস্তায় বাইর অইতে পারুম না? নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারুম না। আমার নিজের দেশেই যদি ঠিকমতো নিরাপদে চলতেই না পারি, থাইকতে না পারি, তাইলে যামু কই? লিইখ্যা দ্যান পত্রিকায়।’

No comments

Powered by Blogger.