আদালতের প্রতি আবেদন- হরতালের নৃশংসতা থেকে রক্ষা করুন by মাহ্ফুজ আনাম

মঙ্গলবার দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রথম পাতায় প্রকাশিত ১৪ বছরের কিশোর মনিরের ছবির প্রতি আমরা যথাযথ শ্রদ্ধা এবং বিনয়ের সঙ্গে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারকদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। অনুগ্রহ করে মনিরের ও আট বছরের শিশু সুমির কাহিনি পড়ুন।
এই অস্বাভাবিক, বিশেষ আবেদনের জন্য আমরা আদালতের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু আইন, সংবিধান ও নাগরিক অধিকারের রক্ষক উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোথাও যাওয়ার নেই। কারণ, উচ্চ আদালতই আমাদের সর্বোচ্চ আস্থাভাজন ও শ্রদ্ধেয় রাষ্ট্রীয় অঙ্গ; অসহায় নাগরিকদের শেষ আশ্রয়।

১৯৯৯ সালের মে মাসে মাননীয় হাইকোর্ট হরতালকে একটি সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেন, তবে একই সঙ্গে বলেন, জবরদস্তিমূলকভাবে হরতাল চাপিয়ে দেওয়া অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ২০০৭ সালে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের সেই রায়ের প্রথম অংশ বহাল রাখেন, কিন্তু দ্বিতীয় অংশটি খারিজ করে দেন। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ রায়ের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এটিকে হরতালের প্রাক্কালে ও হরতাল চলাকালে যা ইচ্ছে তাই করার অবাধ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। তারই ফল কিশোর মনির ও শিশু সুমিসহ গত কয়েক দিনে কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ হওয়া ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারানো। গত কয়েক বছরের হিসাব নিলে হরতালে মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা হাজার পেরিয়ে যাবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনির ও সুমির বিষয়ে দায়ী করেছেন সরকারকে। তাঁর যুক্তি যেমন সরল তেমনই বিবেকবর্জিত: বিএনপি ও তার শরিকেরা একটা দাবি তুলেছে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে দাবি পূরণ করা হচ্ছে ততক্ষণ মনির ও সুমিদের পুড়িয়ে মারার স্বাধীনতা তাদের আছে। দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন দূরে থাক, কোনো নিয়মশৃঙ্খলা, শব্দপ্রয়োগে সতর্কতা বা তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের নিরস্ত করারও কোনো বালাই নেই! কোনো অনুশোচনা নেই, সহানুভূতিসূচক একটি শব্দও নেই; কচি প্রাণগুলোর জন্য উদ্বেগের লেশমাত্র নেই! তিনি একবাক্যে বলে দিলেন, ‘সরকার দায়ী’! আমরা মির্জা ফখরুলকে শুধু একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই, যাদের জ্বালানো আগুনে মনির ও সুমি দগ্ধ হয়েছে, তাদের প্রতি আপনি কী বার্তা পাঠালেন? যে নৃশংস কাজ তারা করেছে, সেটার পুনরাবৃত্তি করার সবুজ সংকেতই তারা পেল না? এই ধারার রাজনীতিই কি আপনারা চান? এই রাজনীতির মধ্যে কি আপনারা দেশ পরিচালনা করতে পারবেন, যদি ক্ষমতায় আসেন? এখন বিএনপি ক্রুদ্ধভাবে বলবে, ডেইলি স্টার ও এই লেখক এমন ভাব করছে, যেন এর আগে কেউ হরতালে মারা যায়নি বা অগ্নিদগ্ধ হয়নি! আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকার সময় তাদের দ্বারা সংঘটিত এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ তারা হাজির করবে। সত্য কথা যে তারা সে রকম অজস্র উদাহরণ খুঁজে পাবে।
এভাবে এক পক্ষের অন্যায়-অপরাধের দৃষ্টান্ত দিয়ে অপর পক্ষ একই অন্যায়-অপরাধের সাফাই গেয়ে চলবে, এক হত্যাকাণ্ডের জায়গা নেবে আরেক হত্যাকাণ্ড। বদলাবে শুধু তাদের পরিচয়। এই দোষারোপের খেলা চলতেই থাকবে এবং প্রায় একইভাবে আমরাও আমাদের শাসক বেছে নিতে এই দল বা ওই দলকে ‘ভোট’ দেওয়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে নিজেদের ধ্বংস করে চলব।
আমরা নিশ্চিত, আমাদের বিচারকেরা যখন হরতালকে ‘সাংবিধানিক অধিকার’ হিসেবে ঘোষণা করেন, তখন এ ধরনের হরতালের কথা তাঁরা ভাবেননি। আবেদন, তাঁরা যেন এ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করেন। বিচারকেরা প্রশ্ন তুলতে পারেন, হরতাল ডাকার ‘সাংবিধানিক অধিকার’ ভোগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা কী? যেকোনো সভ্য সমাজে প্রতিটি অধিকারের সঙ্গে থাকে সমমাত্রার দায়িত্বশীলতা। তাহলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ‘সাংবিধানিক অধিকার’ ভোগের পাশাপাশি তাদের দায়িত্বশীলতা কী? ‘সরকার দায়ী’—শুধু এইটুকু বলা?
আমাদের বিচার বিভাগ হরতালকে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করলেও প্রতিবেশী ভারতের বিচার বিভাগ এ বিষয়ে নাটকীয় রকমের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। প্রথমে কেরালার হাইকোর্টে ১৯৯৭ সালে এক মাইলফলক রায়ে ঘোষণা করা হয় জবরদস্তিমূলক বন্ধ্ (আমাদের হরতালের সমতুল্য) অবৈধ। হাইকোর্টের এ রায় ১৯৯৮ সালে সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখেন। এ ছাড়া, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ২০০২ সালে ঘোষণা করেন, জনসাধারণের কাজকর্ম জবরদস্তিমূলকভাবে বন্ধ করে দেওয়া বেআইনি। ২০০৩ সালে বোম্বে শহরে বন্ধ্ (হরতাল) ডাকার দায়ে বোম্বে হাইকোর্ট ২০০৪ সালের জুলাইতে শিবসেনা ও বিজেপিকে ২০ লাখ রুপি করে অর্থদণ্ড প্রদান করেন। একই বছরের নভেম্বরে কলকাতা হাইকোর্ট তৃণমূল কংগ্রেসের ডাকা বাংলা বন্ধেক অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে তা প্রত্যাহার করে সেই ঘোষণা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। ২০০৬ সালে কেরালা হাইকোর্ট কোনো রাজনৈতিক দল বন্ধ্ ডাকলে তার নিবন্ধন বাতিল করতে নির্বাচন কমিশনকে নির্দেশ দেন। ২০০৭ সালের জুনে দিল্লিতে ডাকা বনেধ নগরের ক্ষতি হয়েছিল সাত শ কোটি রুপি, সুপ্রিম কোর্ট সেটি আমলে নিয়েছিলেন।
কেরালার হাইকোর্ট যে মামলায় মাইলফলক রায়টি দিয়েছিলেন, সেটির আরজি পেশকারী ছিলেন দুজন সাধারণ নাগরিক ও রাজ্যের বিভিন্ন চেম্বার্স অব কমার্সের সদস্যরা। যুক্তি দেওয়া হয়েছিল যে বন্ধ্ ডাকার ফলে যেহেতু ভারতীয় সংবিধানের ১৯ ও ২০ অনুচ্ছেদ লঙ্ঘিত হয়, তাই তা ‘অসাংবিধানিক’ হিসেবে ঘোষিত হওয়া উচিত। কেরালা হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, কোনো সমিতি, সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের হরতাল ডাকা এবং তা পালন করা বেআইনি ও অসাংবিধানিক। আদালত এই মত ব্যক্ত করেন যে, যেসব সংগঠন এ ধরনের হরতাল ডাকবে, তারা ব্যক্তিমালিকানাধীন ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির জন্য সরকার, জনগণ ও সাধারণ নাগরিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে দায়বদ্ধ থাকবে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে সুপ্রিম কোর্ট তা বহাল রাখেন।
আমরা ভারতীয় এসব রায়ের কথা উল্লেখ করছি এ কারণে যে দক্ষিণ এশিয়ায় এক দেশের উচ্চ আদালতের রায় থেকে অন্য দেশের দৃষ্টান্ত গ্রহণের রীতি বেশ প্রচলিত।
আমাদের বিচার বিভাগেরও এই ধারায় চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যখন জনগণকে উদ্ধারে আসছেন না, তখন বিচার বিভাগ কেন এগিয়ে আসবেন না? ২৩ বছর ধরে আমরা গণতান্ত্রিকভাবে সরকার নির্বাচিত করে আসছি, প্রতিটি সংসদ সম্পূর্ণভাবে নির্বাচিত। অথচ প্রতিটি সংসদের মেয়াদকালে বিরোধী দলগুলো সংসদে তাদের বৈধ ও অধিকারসম্মত স্থান গ্রহণ না করে ইচ্ছাকৃতভাবে সংসদ বর্জন করে এসেছে, একের পর এক হরতাল চাপিয়ে দিয়ে নাগরিকদের অধিকার খর্ব করেছে, জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে।
আজ সাধারণ মানুষের জীবন-মরণ রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের মর্জির বিষয়, হরতাল সফল করতে গিয়ে হত্যা-জখম, মানুষের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো নৃশংস কাজ যারা অবলীলায় করতে পারে। আমরা শুনতে পাই, রাজনৈতিক দলগুলো এখন হরতালের সময় সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার সন্ত্রাসী-মাস্তানদের ভাড়া করছে। কে কতটি প্রাইভেট কার, বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ইত্যাদি ভাঙচুর করতে বা পোড়াতে পারল, তা হিসাব করে তাদের টাকা দেওয়া হয়। কিছু টাকা আগেই দেওয়া হয়, বাকিটা দেওয়া হয় কাজের ‘প্রমাণ’ হাজির করার পর (সাধারণত মোবাইল ফোনে ছবি তুলে)। হরতাল প্রতিরোধ করার নামে ক্ষমতাসীন দলেরও সহিংসতার নিজস্ব পরিকল্পনা থাকে।
হরতাল চলাকালে সহিংসতা বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হরতালের আগের দিনের সহিংসতা। হরতাল-পূর্ববর্তী সহিংসতায় এ বছর নিহত হয়েছেন ১৭ জন, আহত ৬৮১ জন। ১১৮টি যানবাহন পোড়ানো হয়েছে, ভাঙচুর করা হয়েছে ২০৬ (সূত্র: ডেইলি স্টার-এর বিভিন্ন প্রতিবেদন)। এসব ঘটেছে হরতালের আগের সন্ধ্যায়; হরতাল চলাকালে বা অন্য কোনো ঘটনার অনুষঙ্গ হিসেবে নয়। হরতাল চলাকালীন আর হরতাল-পূর্ববর্তী সহিংসতার মধ্যে তফাত কী? হরতালের ব্যাপারে পূর্বঘোষিত সময়সীমা থাকে। এ মুহূর্তে চলমান হরতাল সম্পর্কে ঘোষণা করা হয়েছে যে এটি সোমবার সকাল ছয়টায় শুরু হবে, শেষ হবে বুধবার সন্ধ্যা ছয়টায়। কিন্তু হরতাল শুরুর আগের দিনই, বিশেষ করে রোববার সন্ধ্যা থেকেই সহিংসতা শুরু হয়ে গেল। এর যুক্তি কী? আইনের শাসন দ্বারা পরিচালিত একটি দেশে, যার সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় সুনির্দিষ্টভাবে নাগরিকদের অধিকার ও দায়দায়িত্বের কথা বলা আছে, সেখানে আমাদের কেন এই ধরনের সহিংসতার শিকার হতে হবে?
এসব বিষয় এবং প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন আদালতের দেওয়া রায়গুলোর আলোকে উচ্চ আদালতে আমাদের আবেদন:
১. রাজনৈতিক দলগুলোর হরতাল আহ্বানের ‘সাংবিধানিক অধিকার’ ভোগের ক্ষেত্রে তাদের অধিকার ও বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হোক;
২. হরতালের আগের দিন যেহেতু ঘোষিত হরতালের নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পড়ে না, সেহেতু হরতাল-পূর্ববর্তী সময়ে হরতাল আহ্বানকারী রাজনৈতিক দলের ‘সাংবিধানিক অধিকার’ ভোগের কোনো প্রশ্ন নেই। এ সময়ের নাগরিক অধিকারগুলো বিবেচনায় নেওয়া হোক।
৩. হরতাল আহ্বানকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে হরতাল-পূর্ববর্তী সময়ে কোনো সহিংসতা ঘটবে না। এটা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হলে সহিংসতার দায়দায়িত্ব দলগুলোর নেতাদেরই নিতে হবে।
হরতাল কেবল ততক্ষণ পর্যন্তই গণতন্ত্রের অংশ, যতক্ষণ জনসাধারণ তাতে স্বেচ্ছায় অংশ নেয়। জোর করে হরতাল চাপিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে যায় স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ। এই দুই পরিস্থিতিকে একইভাবে বিচার করা যায় না। হরতাল এখন শুধু জবরদস্তিমূলকই নয়, বরং তা চাপিয়ে দেওয়া হয় অত্যন্ত ভয়ংকর ও নৃশংসভাবে, যা আমরা দেখলাম কিশোর মনির ও শিশু সুমির ক্ষেত্রে। আমাদের অধিকারগুলো যখন নৃশংস ও জঘন্যভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে, তখনো কি আমাদের উদ্ধার করতে সংবিধান ও আমাদের সব মানবিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের রক্ষক উচ্চ আদালত এগিয়ে আসবেন না?

ইংরেজি থেকে অনূদিত, ঈষৎ সংক্ষেপিত
মাহ্ফুজ আনাম: সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার।

No comments

Powered by Blogger.