শেখ ফরিদকে বাঁচতে দিন!

বাংলাদেশের পাখির বৈজ্ঞানিকভাবে তালিকা করতে গেলে, যে পাখিটি প্রথমে আসবে তার নাম কালা তিতির। স্থানীয় লোকজনের কাছে পাখিটি শেখ ফরিদ ও বনমুরগি নামেই পরিচিত। পুরুষ পাখি যখন ডাকে, তখন তার ডাকের শব্দটি বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, পাখিটি শেখ ফরিদ নাম ধরে কোনো মানুষকে ডাকছে। তাই লোকে এ পাখিকে নাম দিয়েছেন শেখ ফরিদ। আবার পাখিটি দেখতে মুরগির মতো, তাই অনেকে পাখিটিকে বলে বনমুরগি। এ পাখি একসময় অনেক ছিল তেঁতুলিয়ার ঝোপঝাড়ে। কিন্তু বসতি ধ্বংস ও স্থানীয় শিকারিদের কারণে হারিয়ে গেছে ৯৯ শতাংশ পাখি। বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার কাজীপাড়ার গ্রামের পাঁচ-ছয় শ একর কৃষিজমি, কয়েকটি চা-বাগান ও কিছু গুল্ম উদ্ভিদ ঝোপই জানামতে এ পাখির শেষ প্রাকৃতিক আবাসস্থল। বলা যায়, কালা তিতির কাজীপাড়ায় এন্ডিমিক হয়ে গেছে (এন্ডিমিক প্রজাতি বলতে কোনো নির্দিষ্ট একটি প্রজাতির নির্দিষ্ট একটি ভৌগোলিক স্থানে সীমাবদ্ধ হয়ে যাওয়া বোঝায়)।
২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বছরের বিভিন্ন সময়ে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, পাখিটি সাধারণত আখখেত, গম, ভুট্টা, তিল, শ্বেতদ্রোণ, বুনো গুল্মের ঝোপ, চা-বাগান, ছনঘাসের বাগান, মেলাস্টোমা বা দাঁতরাঙা ফুলগাছের ঝোপে বিচরণ করে। খুব সকালে ও শেষ বিকেলে খাবার খেতে পাখিটি একটু খোলা জায়গায় চলে আসে। তবে, সব সময়ই দেখা গেছে, নিজেকে আড়াল করা যায় এমন গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে শেখ ফরিদ হেঁটে বেড়ায়। প্রজনন সময় পুরুষ পাখিটি বেশি ডাকাডাকি করে, আর দেখা পাওয়া কিছুটা সহজ। মেয়ে পাখিটির দেখা কালেভদ্রে মেলে। ঝোপ থেকে খাবার খাওয়ার প্রয়োজন হলে ছেলে পাখিটিই প্রথম বের হয়ে। এর কিছুক্ষণ পর মেয়ে পাখিটি এক বা দুই পা করে বের হয়। এদের চলাফেরা আমাদের মুরগির মতোই। খেতের ভেতর থেকে কোনো আল বা খোলা জায়গা পার হতে হলে মেয়ে পাখিটি ছেলে পাখিটির পিছু পিছু হেঁটে বেড়ায়। আবার মানুষের দেখা পেলে মেয়ে পাখিটিই দ্রুত উড়ে বা দৌড়ে পালায়। মানুষ দেখলেই পাখিগুলো পালানোর জন্য দিশেহারা হয়ে পড়ে। দেখা গেছে, প্রায় আধা কিলোমিটার দূর থেকে এ পাখি মানুষ দেখলেই পালিয়ে যায় ঝোপের ভেতর। মানুষকে কেন এ পাখি ভয় পায়?
তবে তেঁতুলিয়ার এক ছেলে আমাকে বলেছে, সে নিজেই প্রায় এক হাজার শেখ ফরিদ পাখি জবাই করেছে। উল্লেখ্য, সেই ছেলেটির বাবা ছিলেন তেঁতুলিয়ার নামকরা পাখি শিকারি। প্রতিদিন তিনি শেখ ফরিদ শিকার করতেন এবং বাজারে বিক্রি করতেন। পাখিটি একসময় আমাদের মধুপুরের শালবনে, চট্টগ্রামের পত্রঝরা বনে ও সিলেটে ছিল, কিন্তু বসতি ধ্বংস ও মানুষের শিকারের কারণে এসব জায়গা থেকে পাখিটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। কালা তিতির পার্বত্য চট্টগ্রামের সাঙ্গু ভ্যালিতে শেষবার দেখা গেছে ২০০৬ সালে, মধুপুরে শেষবার দেখা গেছে ২০০৩ সালে এবং সিলেটে ১৯৮৮ সালে। তেঁতুলিয়ায় স্থানীয় অনেক শিকারি ও মানুষ পাখিটি শিকার করেছে, এমন তথ্য অনেক। পাঁচ বছর ধরে পাখিটির সন্ধানে ও ছবি তোলা এবং সংরক্ষণকাজে সেখানে যাওয়া-আসার ফলে স্থানীয় জনগণ কিছুটা সচেতন হয়েছেন। প্রতিবারই সেখানকার মানুষকে বোঝানো হয়েছে। আর স্থানীয়ভাবে কাজীপাড়ার যে জমিতে পাখিটি বিচরণ করে, সেই জমির মালিক কাজীবাড়ির কর্তৃপক্ষও পাখিটি শিকার তাদের জমিতে নিষিদ্ধ করেছে। তাই পাখিটি শিকার একটু কমেছে। বিভিন্ন সময় যাওয়া-আসার ফলে দেখা গেছে, এখানে ২০-৩০টি পাখি এখনো টিকে আছে। কাজীপাড়ার চারদিকে ভারতের চা-বাগান থাকায় এটি টিকে আছে। ভারতের চা-বাগানগুলো না থাকলে পাখিটি অনেক আগেই বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেত। চা-বাগানের ভেতর পাখিটি লুকিয়ে পড়লে তাকে ধরা ও শিকার মুশকিল।
আর এসব চা-বাগানে শিকারিদের ঢোকার কোনো সুযোগ নেই এবং ভারতে পাখি শিকার নিষিদ্ধ। সাধারণত বাসা করার মৌসুমে পাখিটি সবচেয়ে বেশি শিকার হয়। কারণ, পাখিটি গুল্মের ঝোপে, ছনঘাসের বনে, চা-বাগানে, আখখেতের ভেতর মাটিতে বাস করে। যখন স্থানীয় লোকজন মাঠে কাজ করে এবং খেতে আগাছা পরিষ্কার করতে আসে, তখন তারা বাসা দেখতে পায়। তারপর রাতে গিয়ে পাখিটি জাল বা ঝাঁপি দিয়ে ধরে ফেলে। তা ছাড়া লোকজন আখখেতে ও চা-বাগানের দুই দিকে জাল পেতে অন্য দুই দিক থেকে ধাওয়া করলে পাখি দৌড়ে গিয়ে পাতা জালে আটকা পড়ে। পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Francolinus francolinus এবং ইংরেজি নাম Black Francolin। কালা তিতির উঁচু ঘাস, কৃষি খামার, চা-বাগানে একাকী ও জোড়ায় চলে। এরা খোলা মাঠ, ঝোপ ও ঘাসের ভেতর খাবার খোঁজে। খাদ্যতালিকায় আছে ঘাসবীজ, আগাছা, শস্যদানা, কচি ফল ও পোকামাকড়। উষা ও গোধূলিবেলায় এরা কর্মচঞ্চল থাকে। শেখ ফরিদ বা কালা তিতির পাখিটি আর কত দিন টিকে থাকবে বাংলাদেশে, তা নির্ভর করছে মানুষের ওপরই। ছোট্ট এক চিলতে জায়গায় ওর বাস। যদি সরকার ও কাজীপাড়ার মানুষ এগিয়ে আসে পাখিটি সংরক্ষণের জন্য, তা হলে কালা তিতির টিকে থাকবে অনাগত সময় নিয়ে। আমরাও চাই না মায়াবী এ পাখিটি হারিয়ে যাক আমাদের দেশ থেকে।
সৌরভ মাহমুদ, পাখি ও উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।
nature.surav@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.