নির্বাচন- সেই সত্য যা রচিবে তুমি by আলী ইমাম মজুমদার

পাঠক বুঝতে পারছেন শিরোনামটি মৌলিক নয়। রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতা থেকে চয়ন করা। তবে অনেক প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে আমাদের সমকালীন রাজনীতির প্রেক্ষাপটে।
উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশের হাল আমলের ঘটনাপ্রবাহ আর আলাপ-আলোচনা অনেকটাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। এটা স্বাভাবিক। কেননা, নির্বাচন হতে হবে ২০১৪ সালের ২৪ জানুয়ারির আগে যেকোনো দিন। আর এটাও দ্বারপ্রান্তে।

আমাদের সংবিধান নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্ব অর্পণ করেছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। তাদের কাজ অংশগ্রহণকারী সব দলের জন্য সমতার সুযোগ সৃষ্টি ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি নির্বাচন আয়োজন করা। এটা করতে গিয়ে অনেক আইনি, বিধিগত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে হয় কমিশনকে। এর একটি হচ্ছে নির্বাচন আচরণবিধি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ক্ষমতায় থাকা দলের অধীনে ও সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের বিধান করায় এ আচরণবিধি অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আচরণবিধির মাধ্যমে কমিশন কীভাবে সুযোগের সমতা বিধান করে, তা জানতে কৌতূহলী সবাই। সংবাদপত্রদৃষ্টে জানা যায়, কমিশন এ বিধির খসড়া প্রণয়নের কাজ করেছে কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে। অথচ নিবন্ধনকৃত দলগুলো ও সুশীল সমাজের সঙ্গে পূর্ব আলোচনা একে সমৃদ্ধ করতে সহায়ক হতো। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন করবে। তাদের অন্ধকারে রেখে আচরণবিধির খসড়া তৈরি কতটা যৌক্তিক, এ জিজ্ঞাসা অনেকের। অবশ্য খসড়া তৈরির পর ৩ নভেম্বর ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। ৯ নভেম্বর পর্যন্ত পরামর্শ যা পাওয়া যাবে, তা বিচার-বিশ্লেষণ করে কমিশন চূড়ান্ত করবে। এভাবে অনেক কিছুই ঘটে চলছে রাখঢাক করে। তারা যা রচনা করবে, তা-ই সত্যি বলে আমাদের ধরে নিতে হবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায় বেশ কিছু।
আচরণবিধি প্রণয়নের পাশাপাশি আলোচনায় আসছে, এ ধরনের বিধি প্রয়োগের সক্ষমতা কিংবা সদিচ্ছা কমিশনের আছে কি না? নিকট অতীতের নির্বাচনগুলো বিশ্লেষণ করলে এর নেতিবাচক জবাবই আসবে। চারটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় একটিতে একদিন জনৈক প্রতিমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। রাজশাহী ও সিলেটে নির্বাচনী প্রচারে সরকারি গাড়ি ব্যবহূত হওয়ার সচিত্র প্রতিবেদন গণমাধ্যমে এসেছে। প্রচারণার শেষ দিনে সিলেটে রাজপথ বন্ধ করে নির্বাচনী সভা হয়েছে। জাতীয় সংসদের বরগুনার একটি আসনে নিকট অতীতের উপনির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী আগে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। পদত্যাগ করে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন। মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেছেন পরিষদের জিপে। এগুলোর সব কটিই আচরণবিধির লঙ্ঘন। কমিশন কোন ক্ষেত্রে কোন ব্যবস্থা নিয়েছে, এমন তো জানা যায় না। তাহলে কি সক্ষমতা কিংবা সদিচ্ছার অভাব? অথবা উভয়টিরই? আর শুধু বিধি প্রণয়নের জন্যই কি আমরা তা করব? অন্যদিকে যারা ভাঙার, তারা ভেঙে চলবে। এটাই তো সত্যি বলে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে।
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে নিবন্ধন করা দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের পূর্ব আলোচনার রেওয়াজ থাকলেও এবার তা হচ্ছে না বলে পত্রিকান্তরের খবরে প্রকাশ। বলা হচ্ছে, অনেকেই আলোচনায় আসবে না। আর সময়েরও অভাব। আবার সিইসি বলছেন, এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সময়ের তো অভাব ছিল না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হঠাৎ করে সামনে চলে আসেনি। আর এখন সময় কম হলেও কিছুটা আছে। বিষয়টি অতি প্রয়োজনীয়। কিন্তু এটাকে উপেক্ষা করে কমিশনের নির্বাচন তফসিল বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত দেওয়া সংগত হবে না।
জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২(জে) অনুচ্ছেদটির আকস্মিক সংশোধন নতুন প্রশ্নের অবতারণা করেছে। বিধান ছিল, কোনো দলের পক্ষ থেকে কেউ নির্বাচন করতে হলে মনোনয়ন লাভের আগে তাঁকে নিরবচ্ছিন্নভাবে তিন বছর সে দলের সদস্য থাকতে হবে। বিধানটি তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন যে কেউ দলের সদস্য হয়েই মনোনয়ন পাওয়ার আইনি অধিকার লাভ করলেন। নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী আইনে এ ধরনের মৌলিক পরিবর্তন দল ভাঙানোর ফাঁদ বলে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন। তাঁদের আশঙ্কাকে অমূলকও বলা যাবে না। আইন সংশোধনে কমিশনের সঙ্গে পরামর্শের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও নির্বাচন-সংক্রান্ত এ ধরনের বিষয়ে তা করাই সমীচীন ছিল। কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত হয়েও সংশোধনীর কোনো প্রতিবাদ করেনি। তাহলে ধরে নেওয়া অযৌক্তিক হবে না যে এতে তাদের সম্মতি আছে। এ বিধানটির বিলুপ্তি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশের অন্তরায়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এর আগে জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কতিপয় বিধান সংশোধনকল্পে নির্বাচন কমিশন সংসদে পেশ করতে সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। প্রথমে না থাকলেও পরে সে আদেশের ৯১(ই) অনুচ্ছেদ বাতিলের একটি প্রস্তাব প্রক্রিয়া করতে থাকে কমিশন। তাঁদের কেউ কেউ বিধানটির অকার্যকারিতা সম্পর্কেও মন্তব্য করেন। অথচ এ বিধানটিতে নির্বাচনী আইন বা আচরণবিধির বড় ধরনের বরখেলাপের জন্য কোনো প্রার্থীর
প্রার্থিতা বাতিলের ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে। এ যেন খেলার মাঠে হুইসেলবিহীন রেফারি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। দেশব্যাপী সুশীল সমাজে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শেষ পর্যন্ত সুমতি হলো। বিধানটি বাতিলের উদ্যোগ থেকে পিছু হটল কমিশন। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কমিশন নিজেদের ক্ষমতাহীন করার উদ্যোগটি তাদের দায়িত্ব এড়ানোর প্রয়াস বলে ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়েছে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে কমিশনের নিবন্ধন পেতে হলে কোনো দলকে বেশ কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। কিন্তু দেখা যায়, শর্ত পূরণে অক্ষম একটি দলকে বারংবার নিবন্ধনের সুযোগ দিচ্ছে কমিশন। উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, সে দলটি বর্তমান প্রধান বিরোধী দলের নাম ও কর্মসূচির প্রায় কাছাকাছি রূপে আছে। নির্বাচনী প্রতীকও তারা চেয়েছিল একেবারেই সদৃশ্য। বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই প্রধান বিরোধী দল ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু কমিশন এ দলটিকে যেনতেনভাবে নিবন্ধিত করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে বলে জানা যায়। এ ধরনের বিষয়াদি নিশ্চিতভাবে কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ঠিক তেমন রূপই দেখা যায় জাতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করার প্রাক্কালে কমিটির সুদীর্ঘ প্রচেষ্টায় প্রণীত প্রতিবেদনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধানটি শেষ মুহূর্তে দ্রুত ভিন্ন রূপ পেল। চলমান বাস্তবতাকে করা হয় উপেক্ষা। ধরে নেওয়া হয় এগুলো সত্য নয়। নির্বাচনকালীন ব্যবস্থা সম্পর্কেও আমরা সরকারের পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য পেয়েছি বিভিন্ন সময়ে। কখনো বলা হয়েছে, মেয়াদোত্তীর্ণের ৯০ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে। আবার বলা হয়েছে, সব দলের সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে। সেসব বক্তব্য থেকে পিছু হটতেও দেখলাম কিছু কাল। আবার সম্প্রতি সর্বদলীয় সরকারের আহ্বান। সাধুবাদ জানাল কেউ কেউ। প্রত্যাখ্যান করল প্রধান বিরোধী দল। এমনকি সংলাপের আহ্বানেও এখনতক কার্যকর কোনো সাড়া দেয়নি তারা। সর্বদলীয় সরকারের আহ্বানটি স্বয়ং সম্পূর্ণ না হলেও, আলোচনার একটি দ্বার উন্মুক্ত করেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। সেদিকে না তাকিয়ে তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান এবং সংলাপে অযাচিত অবজ্ঞা বিরোধী দলের জন্য যথার্থ হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও আসছে। তারাও ক্ষেত্রবিশেষে শর্ত আরোপ করছে। আর বিষয়টি নিয়ে সরকারও অযৌক্তিক বিলম্ব করেছে বলে অনেকের অভিমত। তাই একটি সফল সংলাপের জন্য দুই পক্ষের সদিচ্ছা সম্পর্কে জনগণ আশ্বস্ত হতে পারছে না। জাতির প্রত্যাশা একটি অংশগ্রহণমূলক, পক্ষপাতহীন শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন।
নির্বাচনের আগে মাঠপর্যায়ে প্রশাসন ও পুলিশে বদলির একটি রেওয়াজ আছে। পরিবর্তিত পরিপ্রেক্ষিতে এখানে কমিশনের অগ্রণী ভূমিকা আবশ্যক। কিন্তু এসব বিষয়ে তাদের মনোভাব তো প্রাচীন ভারতের যোগী পুরুষদের ন্যায় নির্লিপ্ত।
নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, এমনটি বলা হচ্ছে কমিশনের পক্ষ থেকে। তবে নিরাপত্তাবিষয়ক কোনো সমন্বিত কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন নিয়েছে কি না, এটা এখনো জানা যায়নি। জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সামরিক বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে বাদ দিলেও তাদের ছাড়া জাতীয় নির্বাচন করা যাবে না। তাদের তলব করার কথা বিলম্বে হলেও ইসি স্বীকার করে নিয়েছে।
উল্লেখ করা আবশ্যক, কমিশন শুধু সংবিধান ও আইনের কথা বলতে চায়। তাদের বক্তব্য উপেক্ষা করার নয়। তবে এটাই স্মরণে রাখা দরকার যে এগুলোর উৎসও কিন্তু রাজনীতি। এটা সত্যি যে নির্বাচন একটি সাংবিধানিক ও আইনি প্রক্রিয়া। পাশাপাশি এটি একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াও বটে।
আমরা চলমান ঘটনাকে অবলীলায় অবজ্ঞা করি। ক্ষেত্রবিশেষে এগুলোর সত্যতাও স্বীকার করা হয় না। যা করা হয়, তা-ই সত্যি বলে চালাতে চান সবাই। এ প্রসঙ্গে স্মরণে আসে রামায়ণ রচনা প্রসঙ্গে মহর্ষি বাল্মীকিকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতার কয়েকটি পঙিক্ত:
নারদ কহিল হাসি, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’
পৌরাণিক যুগে একটি মহাকাব্য রচনার জন্য এ কথাগুলো কবির কল্পনায় প্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু বর্তমান যুগে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশন যা করবে, তাকেই সত্য বলে ধরে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.