বাংলাদেশ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রচার কাদের স্বার্থে? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
আমেরিকার
প্রভাবশালী দৈনিক ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’ গত ২০ নভেম্বর (২০১৩) বাংলাদেশ
সম্পর্কে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে চারদিকে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
নিবন্ধটির শিরোনাম ‘পলিটিক্যাল ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ’ লেখাটিতে যেভাবে
হাসিনা সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্যাংশনস
(অর্থনৈতিক) আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে, তাতে দেশটির অনেকে শংকিত হয়ে
ভাবছেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে আমেরিকা আবার তার একাত্তরের বিদেশনীতিতে ফিরে
যাচ্ছে কিনা?
বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার রিপাবলিকান নিক্সন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রকাশ্যে পাকিস্তানের হানাদারদের পক্ষাবলম্বন করেছিল এবং মার্কিন মদদে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাংলাদেশে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় উৎসাহিত হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যাতে সফল না হয় সেজন্য আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরও পাঠাতে চেয়েছিল। এ সময় ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন (সাবেক) এবং পূর্ব ইউরোপীয় তখনকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না দাঁড়ালে বাংলাদেশ সহসা স্বাধীনতা অর্জন করত কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষা পেত কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। এ সময়ে ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’-এর ভূমিকা ছিল নিক্সন প্রশাসনের বাংলাদেশবিরোধী নীতির পক্ষে। তারপর দীর্ঘ চার দশকের বেশি কেটে গেছে। বাংলাদেশে আবার নতুন করে যে রাজনৈতিক পোলারাইজেশন ঘটেছে, তা গত শতকের সত্তরের দশকের অনুরূপ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির মধ্যে একটা বড় রাজনৈতিক পোলারাইজেশন ঘটেছে। একাত্তরে যে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তারা এখন আবার বিএনপির নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ। তারা ক্ষমতায় আসীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক সরকারকে যে কোনোভাবে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদে বদ্ধপরিকর। সেজন্য আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী জামায়াতের সহায়তায় দেশে নানা রকম ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তা আন্দোলন নয়, তা নিষ্ঠুর সন্ত্রাস।
এখন আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট ওবামা প্রশাসন ক্ষমতায়। তারা নিক্সন আমলের কিসিঞ্জার-ডকট্রিন দ্বারা প্রভাবিত নয় বলেই অনেকের ধারণা। তাছাড়া আমেরিকা এখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ওয়ার এগেইনস্ট টেরোরিজম বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। এই সন্ত্রাস ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী সন্ত্রাস। বাংলাদেশে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এই মৌলবাদী সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয়ার জন্য আমেরিকা কর্তৃক সমালোচিত হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই উগ্র মৌলবাদী সন্ত্রাস দমনে সাফল্য দেখানোর পর মার্কিন ডেমোক্র্যাট প্রশাসন কর্তৃক একাধিকবার প্রশংসিত হয়েছে।
এখন হঠাৎ সেই আমেরিকাই একটি বিশ্বময় পঠিত ও প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা বিএনপির নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ উগ্র মৌলবাদী শক্তির পাশে অবস্থান গ্রহণ করে ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে কীভাবে অপপ্রচারে অংশ নেয় তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এ জন্যই অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে কিসিঞ্জার ডকট্রিনের প্রেতাত্মা কি এখনও প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে এবং ওবামার ডেমোক্র্যাট প্রশাসনও কি বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের সত্তরের ব্যর্থ ও পরিত্যক্ত নীতিতে ফিরে যেতে চাইছে? গত ২০ নভেম্বর দি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধটি কি তারই আভাস বহন করছে?
দি নিউইয়র্ক টাইমসের ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট’ শীর্ষক নিবন্ধটি পাঠ করে বিস্মিত হয়ে ভাবতে হয়, বিশ্বের একটি বহুল প্রচারিত প্রথম শ্রেণীর ইংরেজি দৈনিকে তৃতীয় বিশ্বের কোনো তৃতীয় শ্রেণীর কাগজের মতো এত অসত্য ও দায়িত্বহীন কথা কী করে বলা হতে পারে? নিউইয়র্ক টাইমসের মন্তব্য যদি সত্য ও সঠিক বলে মানতে হয় তাহলে মানতে হবে বর্তমান হাসিনা সরকার আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সাবেক কোনো স্বৈরতন্ত্রের মতো একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার। বিরোধী দল, মানবাধিকার কর্মীদের এই সরকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করছে। আদালত বিচার ব্যবস্থায় ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ডও বজায় রাখছে না।
পত্রিকাটির মতে, এই সংকটের জন্য শেখ হাসিনাই একমাত্র দায়ী। তিনি ক্ষমতায় ঝুলে থাকার জন্য সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধানটি মুছে ফেলেছেন। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও আসলে হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনের একটা হাতিয়ার। জামায়াতকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিয়ে বস্তুত তাদের রাস্তার আন্দোলনে নামতে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে তারা রাস্তায় নেমেছে। সিরিজ অব হরতালে দেশটিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘর্ষে শত শত লোক মৃত্যুবরণ করেছে। সুতরাং এসব অবস্থার প্রতিকার ও হাসিনা সরকারকে স্বৈরতন্ত্রের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্যাংশনসসহ বিভিন্ন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে এই মার্কিন দৈনিকটি সুপারিশ করেছে।
এই ‘ইনফরমেশন এজের’ একটি আন্তর্জাতিক দৈনিক হয়ে মার্কিন এই পত্রিকাটি কী করে বাংলাদেশ সম্পর্কে এত অসত্য ও মনগড়া কথা ছড়াল, তা ভেবে বিস্মিত হই। যে ‘মরাল হাই গ্রাউন্ড’ মেনে আমেরিকার প্রশাসন ও মিডিয়া কথা বলে তার সঙ্গে এই প্রচারণার কোনো মিল আছে কি? এটা বাংলাদেশের বিএনপির হ্যান্ডবিলে যেসব কথা বলা হয় তার পুনরুক্তি মাত্র। প্রথম কথা, হাসিনা সরকার বিপুল ভোটে নির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক সরকার। বিএনপির মতো স্বৈরশাসন, অপশাসন ও নির্বাচন-জালিয়াতির কোনো রেকর্ড তার নেই। দেশকে সুশাসন দিতে তার অনেক ব্যর্থতা আছে, ভুলত্র“টি আছে। কিন্তু এই সরকার মূলত অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক। একে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার বলা সত্যের ডাহা অপলাপ। দেশকে সুশাসন উপহার দিতে ব্যর্থ হওয়ার নজির মার্কিন প্রশাসনেরও রয়েছে।
হাসিনা সরকার জনগণকে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ যেসব নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন করে চলেছে। নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করা কি স্বৈরতান্ত্রিক কাজ? এক সময় সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। এখন সময়ের পরিবর্তনে সেই ব্যবস্থা পরিবর্তন করে আবার পুরনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়েছে। তাও সংসদে বিতর্ক ও আলোচনার পর। বিএনপি এই বিতর্কে সংসদে আসেনি। সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে, তাও সুপ্রিমকোর্টের রায় মেনে। এখানে শেখ হাসিনা স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় কোথায় সংবিধান ছিঁড়ে-খুঁড়ে (ঝপৎধঢ়ঢ়বফ) ফেললেন? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তো কংগ্রেসে বা সিনেটে বাধা পেলেও নিজের ডিসক্রেশনারি ক্ষমতার জোরে অনেক বিল পাস করেন। তা কি সংবিধান লংঘন? শেখ হাসিনা তো তাও করেননি।
নিউইয়র্ক টাইমস কোথায় পেল বাংলাদেশের আদালতগুলো বিচার ব্যবস্থায় নিুতম নিয়মকানুন ও মান বজায় না রেখে অভিযুক্তদের দণ্ড দেন? তাহলে একটি বড় ধরনের দুর্নীতির মামলায় তারেক রহমানের সহযোগী দণ্ডিত হন এবং তারেক রহমান কী করে খালাস পান? আমেরিকায় যেখানে রাশিয়ার কাছে আণবিক গোপন তথ্য পাচারের অভিযোগে (সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়) বিখ্যাত বিজ্ঞানী রোজেনবার্গ দম্পতিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে, বিশ্ববাসীর প্রাণ ভিক্ষাদানের আবেদনে পর্যন্ত কর্ণপাত করা হয়নি, সেখানে বাংলাদেশে ’৭১-এর বর্বর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে শুধু মানবতা বোধ থেকে বয়সের বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, তা কি দেশটির বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা, মান ও সুবিবেচনার পরিচয় বহন করে না?
আমেরিকা তার স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও কোলাবরেটরদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। অনেককে বিনা বিচারে হত্যা করেছে। সেই দেশটির একটি পত্রিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং ঘাতক ও দালালদের বিচার সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না বলে মায়াকান্না জুড়েছে এবং এই ঘাতক ও দালালদের হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ (চড়ষরঃরপধষ ঙঢ়ঢ়ড়হবহঃং) হিসেবে চিত্রিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের আপামর মানুষের দাবি। এটা হাসিনা সরকারের নির্বাচনী কমিটমেন্ট। এ কমিটমেন্ট থেকে একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার সরে আসে কী করে? তাছাড়া ২০০৯ সালে গঠিত বিশেষ আদালত যেসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও দণ্ড দিয়েছেন তারা ৪০ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধী, ঘাতক ও দালাল হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। হঠাৎ দি নিউইয়র্ক টাইমস আবিষ্কার করল, এই দণ্ডিত ও বিচারাধীন ব্যক্তিরা আসলে যুদ্ধাপরাধী নয়, তারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং আওয়ামী লীগ সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য এই বিচারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এত বড় মিথ্যাচার দি নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকা কীভাবে করে এবং কী উদ্দেশ্যে? তাহলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নাৎসি ঘাতক হিটলার, মুসোলিনী কি যুদ্ধাপরাধী ছিল না? ছিল কেবল চার্চিল ও রুজভেল্টের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ? এবং এই প্রতিপক্ষকে দমনের জন্যই কি তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে?
নিউইয়র্ক টাইমসের অদ্ভুত যুক্তি, জামায়াতের মতো সন্ত্রাসী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিয়ে রাস্তায় আন্দোলন সৃষ্টি করার জন্য ঠেলে দেয়া হয়েছে। জামায়াতকে শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া নয়, দলটিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার দাবি সারা দেশের। আওয়ামী লীগ সরকার এই দেশব্যাপী দাবির মুখেও জমায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। দলটির সন্ত্রাসী চরিত্রের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাতিল করে দিয়েছে। এটা যদি অন্যায় হয়, তাহলে আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক দেশে মহাযুদ্ধের ৬৮ বছর পরও নাৎসি পার্টি নিষিদ্ধ কেন?
আমেরিকায় ঢুকতে হলে ভিসা পেতে যে ফরম পূরণ করতে হয় তাতে লেখা আছে আপনি নাৎসি পার্টির সমর্থক হলে অথবা ওই পার্টির সঙ্গে অতীতে কোনো যোগাযোগ থাকলে আমেরিকায় প্রবেশের অনুমতি পাবেন না। তাহলে বাংলাদেশের নব্য নাৎসিদের প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের এত অনুকম্পা কেন? জার্মানির নাৎসি পার্টি এবং ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টি যেমন সঠিক অর্থে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, তেমনি বাংলাদেশের জামায়াতও কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। এটি দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসী দল। কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই এ ধরনের সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি দেয়া হয় না।
বিএনপি এই সন্ত্রাসীদের সাহায্যে বাংলাদেশে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে এটা কি বাস্তব সত্য? আর রাজনৈতিক দল-উপদলগুলোর সংঘর্ষে মানুষ মারা যাচ্ছে, এটাও নিউইয়র্ক টাইমসের আবিষ্কার। বাংলাদেশে জনসমর্থনপুষ্ট কোনো গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে না পারায় জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডারদের সহায়তায় বিএনপি রাজপথে আকস্মিক হামলা চালিয়ে গাড়ি-বাড়ি পুড়িয়ে, ঘুমন্ত বাসযাত্রী হত্যা করে দেশে ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তার বাইরে তারা কিছু করেনি। তাও পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
অন্যদিকে জামায়াত-শিবির ও তাদের ভাড়াটে গুণ্ডাদের অতর্কিত হামলায় গাড়িতে অগ্নিসংযোগের দরুন অধিকাংশ মৃত্যু ঘটেছে। এমনকি জামায়াতের ক্যাডারদের হামলায় নিহত পুলিশের সংখ্যাও কম নয়। এগুলোকে মার্কিন পত্রিকাটি রাজনৈতিক দল-উপদলের সংঘর্ষে নিহত বলে চালিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার যে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করেছে, তাদের একজন আদালত কর্তৃক ‘হঠাৎ সম্পাদক’ হিসেবে বর্ণিত এবং তার মিথ্যা প্রচার সাংবাদিকতার সব মানকে অতিক্রম করেছিল। আর মানবাধিকার দলটি ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশে পুলিশ অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে বলে নিহতদের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা গেছে এই নামে কেউ নেই। সবটাই দুরভিসন্ধিমূলক প্রচারণা। আমেরিকায় মার্কিন স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের বানানো অভিযোগে হাওয়ার্ড ফাস্ট, চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিখ্যাত মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন। সেই দেশের একটি কাগজ বাংলাদেশে মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক দলনের নামে মায়াকান্না জুড়েছে, তা আর বিচিত্র কী?
উন্নয়নশীল বিশ্বের যেসব দেশে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে, সেসব দেশে গণতন্ত্রের বিকাশে বাধাদানে এবং সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার কাজে অপপ্রচারে দি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কোনো জুড়ি নেই। একটি উদাহরণ দিই। ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক ও গণবিরোধী মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে প্রদেশে নতুন সরকার গঠন করে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে এই গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ আমেরিকা তার স্বার্থের অনুকূল মনে করেনি। ফলে শুরু হয় হক সাহেবের বিরুদ্ধে চক্রান্ত।
ফজলুল হক বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। তিনি তার এক পুরনো রোগের চিকিৎসার জন্য এ সময় কলকাতায় যান। সেখানে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। যে কলকাতায় বসে ছয় বছর তিনি অবিভক্ত বাংলার সরকার পরিচালনা করেছেন, দেশভাগের পর সেই কলকাতায় এসে বিপুল সংবর্ধনা পেয়ে তিনি অভিভূত হন এবং সংবর্ধনার জবাবে বলেন, ‘আমি দেশের রাজনৈতিক বিভাজনে কোনো গুরুত্ব দেই না।’ হক সাহেবের এই সংবর্ধনার সময় দি নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিক ক্যালাহান তার কাগজে রিপোর্ট পাঠান- হক সাহেব কলকাতায় বলেছেন, ‘আমি দেশ ভাগ মানি না।’
মার্কিন পত্রিকার রিপোর্টার কর্তৃক ফজলুল হকের মুখে পুরে দেয়া এই বক্তব্য ঢাকায় ও করাচিতে মুসলিম লীগপন্থী কাগজগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। ফজলুল হক ঢাকায় ফিরে এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ক্যালাহান সাহেবের এই রিপোর্টকে ভিত্তি করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে এবং মুখ্যমন্ত্রী হক সাহেবকে গৃহবন্দি করে। তাকে বলা হয়, ‘হিন্দুর দালাল, ভারতের চর’। আজ থেকে ৫৯ বছর আগেও এটাই ছিল দি নিউইয়র্ক টাইমসের সৎ সাংবাদিকতার নমুনা।
৫৯ বছর পর দি নিউইয়র্ক টাইমস একই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে স্বাধীন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে এবং দেশটির সাম্প্রদায়িক ও উগ্র মৌলবাদী সন্ত্রাসী শিবিরের সমর্থক সেজেছে। হাসিনা সরকারকে শায়েস্তা করার জন্য আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্যাংশনস আরোপেরও সুপারিশ করেছে। এই স্যাংশনস আমেরিকা সাধারণত আরোপ করে তার শত্র“ দেশগুলোর ওপর। বাংলাদেশও কি তাহলে এখন আমেরিকার শত্র“ দেশ? দি নিউইয়র্ক টাইমস এ স্যাংশনস আরোপের জন্য যতই উস্কানি দিক, ওবামা প্রশাসন তাতে কান দেবে অথবা সুপারিশটিকে গুরুত্ব দেবে তা মনে হয় না। সত্তরের দশকের ব্যর্থ বিদেশনীতিতে আমেরিকা ফিরে যেতে চাইবে তা বিশ্বাস করার কোনো কারণ এখনও ঘটেনি।
বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার রিপাবলিকান নিক্সন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন প্রকাশ্যে পাকিস্তানের হানাদারদের পক্ষাবলম্বন করেছিল এবং মার্কিন মদদে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাংলাদেশে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় উৎসাহিত হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যাতে সফল না হয় সেজন্য আমেরিকা বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরও পাঠাতে চেয়েছিল। এ সময় ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন (সাবেক) এবং পূর্ব ইউরোপীয় তখনকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না দাঁড়ালে বাংলাদেশ সহসা স্বাধীনতা অর্জন করত কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষা পেত কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ আছে। এ সময়ে ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’-এর ভূমিকা ছিল নিক্সন প্রশাসনের বাংলাদেশবিরোধী নীতির পক্ষে। তারপর দীর্ঘ চার দশকের বেশি কেটে গেছে। বাংলাদেশে আবার নতুন করে যে রাজনৈতিক পোলারাইজেশন ঘটেছে, তা গত শতকের সত্তরের দশকের অনুরূপ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের শক্তির মধ্যে একটা বড় রাজনৈতিক পোলারাইজেশন ঘটেছে। একাত্তরে যে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, তারা এখন আবার বিএনপির নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ। তারা ক্ষমতায় আসীন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক সরকারকে যে কোনোভাবে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদে বদ্ধপরিকর। সেজন্য আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী জামায়াতের সহায়তায় দেশে নানা রকম ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। তা আন্দোলন নয়, তা নিষ্ঠুর সন্ত্রাস।
এখন আমেরিকায় ডেমোক্র্যাট ওবামা প্রশাসন ক্ষমতায়। তারা নিক্সন আমলের কিসিঞ্জার-ডকট্রিন দ্বারা প্রভাবিত নয় বলেই অনেকের ধারণা। তাছাড়া আমেরিকা এখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ওয়ার এগেইনস্ট টেরোরিজম বা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। এই সন্ত্রাস ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী সন্ত্রাস। বাংলাদেশে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে এই মৌলবাদী সন্ত্রাসকে প্রশ্রয় দেয়ার জন্য আমেরিকা কর্তৃক সমালোচিত হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই উগ্র মৌলবাদী সন্ত্রাস দমনে সাফল্য দেখানোর পর মার্কিন ডেমোক্র্যাট প্রশাসন কর্তৃক একাধিকবার প্রশংসিত হয়েছে।
এখন হঠাৎ সেই আমেরিকাই একটি বিশ্বময় পঠিত ও প্রচারিত দৈনিক পত্রিকা বিএনপির নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ উগ্র মৌলবাদী শক্তির পাশে অবস্থান গ্রহণ করে ক্ষমতাসীন গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে কীভাবে অপপ্রচারে অংশ নেয় তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এ জন্যই অনেকের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে কিসিঞ্জার ডকট্রিনের প্রেতাত্মা কি এখনও প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে এবং ওবামার ডেমোক্র্যাট প্রশাসনও কি বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের সত্তরের ব্যর্থ ও পরিত্যক্ত নীতিতে ফিরে যেতে চাইছে? গত ২০ নভেম্বর দি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধটি কি তারই আভাস বহন করছে?
দি নিউইয়র্ক টাইমসের ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট’ শীর্ষক নিবন্ধটি পাঠ করে বিস্মিত হয়ে ভাবতে হয়, বিশ্বের একটি বহুল প্রচারিত প্রথম শ্রেণীর ইংরেজি দৈনিকে তৃতীয় বিশ্বের কোনো তৃতীয় শ্রেণীর কাগজের মতো এত অসত্য ও দায়িত্বহীন কথা কী করে বলা হতে পারে? নিউইয়র্ক টাইমসের মন্তব্য যদি সত্য ও সঠিক বলে মানতে হয় তাহলে মানতে হবে বর্তমান হাসিনা সরকার আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সাবেক কোনো স্বৈরতন্ত্রের মতো একটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকার। বিরোধী দল, মানবাধিকার কর্মীদের এই সরকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করছে। আদালত বিচার ব্যবস্থায় ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ডও বজায় রাখছে না।
পত্রিকাটির মতে, এই সংকটের জন্য শেখ হাসিনাই একমাত্র দায়ী। তিনি ক্ষমতায় ঝুলে থাকার জন্য সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধানটি মুছে ফেলেছেন। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও আসলে হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমনের একটা হাতিয়ার। জামায়াতকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিয়ে বস্তুত তাদের রাস্তার আন্দোলনে নামতে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে তারা রাস্তায় নেমেছে। সিরিজ অব হরতালে দেশটিতে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর সংঘর্ষে শত শত লোক মৃত্যুবরণ করেছে। সুতরাং এসব অবস্থার প্রতিকার ও হাসিনা সরকারকে স্বৈরতন্ত্রের পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্যাংশনসসহ বিভিন্ন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার বলে এই মার্কিন দৈনিকটি সুপারিশ করেছে।
এই ‘ইনফরমেশন এজের’ একটি আন্তর্জাতিক দৈনিক হয়ে মার্কিন এই পত্রিকাটি কী করে বাংলাদেশ সম্পর্কে এত অসত্য ও মনগড়া কথা ছড়াল, তা ভেবে বিস্মিত হই। যে ‘মরাল হাই গ্রাউন্ড’ মেনে আমেরিকার প্রশাসন ও মিডিয়া কথা বলে তার সঙ্গে এই প্রচারণার কোনো মিল আছে কি? এটা বাংলাদেশের বিএনপির হ্যান্ডবিলে যেসব কথা বলা হয় তার পুনরুক্তি মাত্র। প্রথম কথা, হাসিনা সরকার বিপুল ভোটে নির্বাচিত একটি গণতান্ত্রিক সরকার। বিএনপির মতো স্বৈরশাসন, অপশাসন ও নির্বাচন-জালিয়াতির কোনো রেকর্ড তার নেই। দেশকে সুশাসন দিতে তার অনেক ব্যর্থতা আছে, ভুলত্র“টি আছে। কিন্তু এই সরকার মূলত অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক। একে স্বৈরতান্ত্রিক সরকার বলা সত্যের ডাহা অপলাপ। দেশকে সুশাসন উপহার দিতে ব্যর্থ হওয়ার নজির মার্কিন প্রশাসনেরও রয়েছে।
হাসিনা সরকার জনগণকে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ যেসব নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন করে চলেছে। নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করা কি স্বৈরতান্ত্রিক কাজ? এক সময় সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। এখন সময়ের পরিবর্তনে সেই ব্যবস্থা পরিবর্তন করে আবার পুরনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া হয়েছে। তাও সংসদে বিতর্ক ও আলোচনার পর। বিএনপি এই বিতর্কে সংসদে আসেনি। সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে, তাও সুপ্রিমকোর্টের রায় মেনে। এখানে শেখ হাসিনা স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় কোথায় সংবিধান ছিঁড়ে-খুঁড়ে (ঝপৎধঢ়ঢ়বফ) ফেললেন? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তো কংগ্রেসে বা সিনেটে বাধা পেলেও নিজের ডিসক্রেশনারি ক্ষমতার জোরে অনেক বিল পাস করেন। তা কি সংবিধান লংঘন? শেখ হাসিনা তো তাও করেননি।
নিউইয়র্ক টাইমস কোথায় পেল বাংলাদেশের আদালতগুলো বিচার ব্যবস্থায় নিুতম নিয়মকানুন ও মান বজায় না রেখে অভিযুক্তদের দণ্ড দেন? তাহলে একটি বড় ধরনের দুর্নীতির মামলায় তারেক রহমানের সহযোগী দণ্ডিত হন এবং তারেক রহমান কী করে খালাস পান? আমেরিকায় যেখানে রাশিয়ার কাছে আণবিক গোপন তথ্য পাচারের অভিযোগে (সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়) বিখ্যাত বিজ্ঞানী রোজেনবার্গ দম্পতিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে, বিশ্ববাসীর প্রাণ ভিক্ষাদানের আবেদনে পর্যন্ত কর্ণপাত করা হয়নি, সেখানে বাংলাদেশে ’৭১-এর বর্বর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে শুধু মানবতা বোধ থেকে বয়সের বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, তা কি দেশটির বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা, মান ও সুবিবেচনার পরিচয় বহন করে না?
আমেরিকা তার স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী ও কোলাবরেটরদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। অনেককে বিনা বিচারে হত্যা করেছে। সেই দেশটির একটি পত্রিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এবং ঘাতক ও দালালদের বিচার সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না বলে মায়াকান্না জুড়েছে এবং এই ঘাতক ও দালালদের হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ (চড়ষরঃরপধষ ঙঢ়ঢ়ড়হবহঃং) হিসেবে চিত্রিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশের আপামর মানুষের দাবি। এটা হাসিনা সরকারের নির্বাচনী কমিটমেন্ট। এ কমিটমেন্ট থেকে একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার সরে আসে কী করে? তাছাড়া ২০০৯ সালে গঠিত বিশেষ আদালত যেসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও দণ্ড দিয়েছেন তারা ৪০ বছর ধরে যুদ্ধাপরাধী, ঘাতক ও দালাল হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। হঠাৎ দি নিউইয়র্ক টাইমস আবিষ্কার করল, এই দণ্ডিত ও বিচারাধীন ব্যক্তিরা আসলে যুদ্ধাপরাধী নয়, তারা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং আওয়ামী লীগ সরকার তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য এই বিচারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এত বড় মিথ্যাচার দি নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকা কীভাবে করে এবং কী উদ্দেশ্যে? তাহলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের নাৎসি ঘাতক হিটলার, মুসোলিনী কি যুদ্ধাপরাধী ছিল না? ছিল কেবল চার্চিল ও রুজভেল্টের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ? এবং এই প্রতিপক্ষকে দমনের জন্যই কি তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে?
নিউইয়র্ক টাইমসের অদ্ভুত যুক্তি, জামায়াতের মতো সন্ত্রাসী দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দিয়ে রাস্তায় আন্দোলন সৃষ্টি করার জন্য ঠেলে দেয়া হয়েছে। জামায়াতকে শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া নয়, দলটিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার দাবি সারা দেশের। আওয়ামী লীগ সরকার এই দেশব্যাপী দাবির মুখেও জমায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। দলটির সন্ত্রাসী চরিত্রের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ বাতিল করে দিয়েছে। এটা যদি অন্যায় হয়, তাহলে আমেরিকার মতো গণতান্ত্রিক দেশে মহাযুদ্ধের ৬৮ বছর পরও নাৎসি পার্টি নিষিদ্ধ কেন?
আমেরিকায় ঢুকতে হলে ভিসা পেতে যে ফরম পূরণ করতে হয় তাতে লেখা আছে আপনি নাৎসি পার্টির সমর্থক হলে অথবা ওই পার্টির সঙ্গে অতীতে কোনো যোগাযোগ থাকলে আমেরিকায় প্রবেশের অনুমতি পাবেন না। তাহলে বাংলাদেশের নব্য নাৎসিদের প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের এত অনুকম্পা কেন? জার্মানির নাৎসি পার্টি এবং ইতালির ফ্যাসিস্ট পার্টি যেমন সঠিক অর্থে কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না, তেমনি বাংলাদেশের জামায়াতও কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। এটি দুর্বৃত্ত সন্ত্রাসী দল। কোনো গণতান্ত্রিক দেশেই এ ধরনের সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি দেয়া হয় না।
বিএনপি এই সন্ত্রাসীদের সাহায্যে বাংলাদেশে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে এটা কি বাস্তব সত্য? আর রাজনৈতিক দল-উপদলগুলোর সংঘর্ষে মানুষ মারা যাচ্ছে, এটাও নিউইয়র্ক টাইমসের আবিষ্কার। বাংলাদেশে জনসমর্থনপুষ্ট কোনো গণআন্দোলন সৃষ্টি করতে না পারায় জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডারদের সহায়তায় বিএনপি রাজপথে আকস্মিক হামলা চালিয়ে গাড়ি-বাড়ি পুড়িয়ে, ঘুমন্ত বাসযাত্রী হত্যা করে দেশে ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা করছে। তার বাইরে তারা কিছু করেনি। তাও পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে।
অন্যদিকে জামায়াত-শিবির ও তাদের ভাড়াটে গুণ্ডাদের অতর্কিত হামলায় গাড়িতে অগ্নিসংযোগের দরুন অধিকাংশ মৃত্যু ঘটেছে। এমনকি জামায়াতের ক্যাডারদের হামলায় নিহত পুলিশের সংখ্যাও কম নয়। এগুলোকে মার্কিন পত্রিকাটি রাজনৈতিক দল-উপদলের সংঘর্ষে নিহত বলে চালিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার যে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করেছে, তাদের একজন আদালত কর্তৃক ‘হঠাৎ সম্পাদক’ হিসেবে বর্ণিত এবং তার মিথ্যা প্রচার সাংবাদিকতার সব মানকে অতিক্রম করেছিল। আর মানবাধিকার দলটি ঢাকায় হেফাজতের সমাবেশে পুলিশ অসংখ্য লোককে হত্যা করেছে বলে নিহতদের যে তালিকা প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা গেছে এই নামে কেউ নেই। সবটাই দুরভিসন্ধিমূলক প্রচারণা। আমেরিকায় মার্কিন স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের বানানো অভিযোগে হাওয়ার্ড ফাস্ট, চার্লি চ্যাপলিনের মতো বিখ্যাত মানুষ নির্যাতিত হয়েছেন। সেই দেশের একটি কাগজ বাংলাদেশে মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক দলনের নামে মায়াকান্না জুড়েছে, তা আর বিচিত্র কী?
উন্নয়নশীল বিশ্বের যেসব দেশে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে, সেসব দেশে গণতন্ত্রের বিকাশে বাধাদানে এবং সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার কাজে অপপ্রচারে দি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার কোনো জুড়ি নেই। একটি উদাহরণ দিই। ১৯৫৪ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক ও গণবিরোধী মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে প্রদেশে নতুন সরকার গঠন করে। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে এই গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ আমেরিকা তার স্বার্থের অনুকূল মনে করেনি। ফলে শুরু হয় হক সাহেবের বিরুদ্ধে চক্রান্ত।
ফজলুল হক বয়োবৃদ্ধ ছিলেন। তিনি তার এক পুরনো রোগের চিকিৎসার জন্য এ সময় কলকাতায় যান। সেখানে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। যে কলকাতায় বসে ছয় বছর তিনি অবিভক্ত বাংলার সরকার পরিচালনা করেছেন, দেশভাগের পর সেই কলকাতায় এসে বিপুল সংবর্ধনা পেয়ে তিনি অভিভূত হন এবং সংবর্ধনার জবাবে বলেন, ‘আমি দেশের রাজনৈতিক বিভাজনে কোনো গুরুত্ব দেই না।’ হক সাহেবের এই সংবর্ধনার সময় দি নিউইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিক ক্যালাহান তার কাগজে রিপোর্ট পাঠান- হক সাহেব কলকাতায় বলেছেন, ‘আমি দেশ ভাগ মানি না।’
মার্কিন পত্রিকার রিপোর্টার কর্তৃক ফজলুল হকের মুখে পুরে দেয়া এই বক্তব্য ঢাকায় ও করাচিতে মুসলিম লীগপন্থী কাগজগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। ফজলুল হক ঢাকায় ফিরে এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ক্যালাহান সাহেবের এই রিপোর্টকে ভিত্তি করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল ভোটে নির্বাচিত হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে এবং মুখ্যমন্ত্রী হক সাহেবকে গৃহবন্দি করে। তাকে বলা হয়, ‘হিন্দুর দালাল, ভারতের চর’। আজ থেকে ৫৯ বছর আগেও এটাই ছিল দি নিউইয়র্ক টাইমসের সৎ সাংবাদিকতার নমুনা।
৫৯ বছর পর দি নিউইয়র্ক টাইমস একই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে স্বাধীন বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে এবং দেশটির সাম্প্রদায়িক ও উগ্র মৌলবাদী সন্ত্রাসী শিবিরের সমর্থক সেজেছে। হাসিনা সরকারকে শায়েস্তা করার জন্য আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্যাংশনস আরোপেরও সুপারিশ করেছে। এই স্যাংশনস আমেরিকা সাধারণত আরোপ করে তার শত্র“ দেশগুলোর ওপর। বাংলাদেশও কি তাহলে এখন আমেরিকার শত্র“ দেশ? দি নিউইয়র্ক টাইমস এ স্যাংশনস আরোপের জন্য যতই উস্কানি দিক, ওবামা প্রশাসন তাতে কান দেবে অথবা সুপারিশটিকে গুরুত্ব দেবে তা মনে হয় না। সত্তরের দশকের ব্যর্থ বিদেশনীতিতে আমেরিকা ফিরে যেতে চাইবে তা বিশ্বাস করার কোনো কারণ এখনও ঘটেনি।
No comments